নারীর প্রতি সহিংসতা: জঘন্য, অমানবিক ও মানবিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়

বুধবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০ | ৩:৫০ অপরাহ্ণ

নারীর প্রতি সহিংসতা: জঘন্য, অমানবিক ও মানবিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়
apps

মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। প্রত্যেকটা মানুষের জীবন অত্যন্ত পবিত্র ও মর্যাদাকর। বিবেকের জন্য পশু-পাখি আর মানুষের মাঝে পার্থক্য করা হয়। মানুষের বিবেক আছে আর পশু-পাখির বিবেক নেই। মূল কথাই হচ্ছে এটা। কিন্তু এই বিবেকবান মানুষের মধ্যে রয়েছে অমানুষ ও পশুর সমতুল্য মানুষ। যারা মানুষ নামের ট্যাগ ব্যবহার করে প্রতিনিয়ত করে চলেছে জঘন্য, ঘৃণিত ও নৃশংস কাজ।

কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর উপর যখন অন্য ব্যক্তি বা গোষ্ঠী হুমকি বা বল প্রয়োগ করে তাকে বলা হয় নির্যাতন। আর নারী নির্যাতন বলতে তাই যে কোনো বয়সের যে কোনো সম্পর্কের নারীকে নিগ্রহ, অত্যাচার ও প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা বুঝায়। নারী-পুরুষের একটি বড় অংশ সহিংসতা বলতে মারধরকেই বোঝেন। প্রায় কেউই স্বামীর হাতে ধর্ষণের ঘটনাকে নির্যাতন মনে করেন না। স্বামীর বকাঝকাও স্বাভাবিক আচরণ হিসেবে নেন। তবে উত্ত্যক্তকরণকে তাঁরা যৌন হয়রানি বলছেন।

সকল ধর্মই নারীর প্রতি যে কোন ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে। নারী যেন কোন সহিংসতার শিকার না হয় তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ধর্মসমূহ বিভিন্ন বিধান দিয়েছে, বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। অথচ কোন কোন ক্ষেত্রে ধর্মের নামে নারী নির্যাতিত হয়, সহিংসতার শিকার হয়। এর মূলে রয়েছে পুরুষের নারীকে বশীভূত রাখার অসুস্থ মানসিকতা এবং কখনো কখনো ধর্মের অপব্যাখ্যা ও অপব্যবহার। বর্তমান বিশ্বের সর্বত্র নারী নানাভাবে সহিংসতার শিকার।

নারীর প্রতি সহিংসতা বা নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা বা লিঙ্গ ভিত্তিক সহিংসতা এবং যৌনতা ও লিঙ্গ ভিত্তিক সহিংসতা হচ্ছে সহিংস অপরাধগুলো প্রধাণত বা কেবলই নারী বা বালিকাদের উপরেই করা হয়। এরকম সহিংসতাকে প্রায়ই ঘৃণাপূর্বক অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়, যা নারী বা বালিকাদের উপর করা হয় কেননা তারা নারী। নারীর প্রতি সহিংসতার খুব লম্বা ইতিহাস রয়েছে, যদিও এরকম সহিংসতার মাত্রা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ছিল, এমনকি আজও বিভিন্ন সমাজে এগুলোর মাত্রা ও ঘটনার ধরন বিভিন্ন হয়। এরকম সহিংসতাকে প্রায়ই নারীকে সমাজে বা আন্তঃব্যক্তি সম্পর্কে অধীনস্ত করার কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ব্যক্তি তার অধিকারপ্রাপ্তির বোধ, উচ্চস্থানের বোধ, নারীবিদ্বেষ, বা নিজের সহিংস প্রকৃতির জন্য নারীর প্রতি সহিংস আচরণ করতে পারেন।

সাধারণভাবে নারীর প্রতি সহিংসতা বলতে পুরুষ কর্তৃক নারীদেরকে কোনো না কোনো প্রকারে কষ্ট দেয়াকে বুঝায়। ব্যাপক অর্থে নারীর প্রতি সহিংসতা বলতে নারীদের উপর দৈহিক, মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক যে কোনো ধরনের নিপীড়ন ও নির্যাতনকে বুঝায়। নারীর যে কোনো অধিকার খর্ব বা হরণ করা এবং কোনো নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো বিষয় চাপিয়ে দেয়া বা কোনো ব্যক্তি গোষ্ঠীর ইচ্ছানুসারে কাজ করতে বাধ্য করাও নারী নির্যাতনের অন্তর্গত। সার্বজনীন নারী অধিকারের সুষ্পষ্ট লঙ্ঘনমূলক অপরাধ নারী নির্যাতন। ধারণাগতভাবে এটি আবার নারীর প্রতি সহিংসতা, নিপীড়ন এবং নারীর সাথে অপব্যবহার ইত্যাদিও বুঝায়। এটি সমাজে মহিলাদের প্রতি অমানবিক ও অনৈতিক আচরণের মধ্যেও প্রকাশ পায়। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, পৃথিবীব্যাপী এসব সহিংসতার শিকার হয়ে প্রতি বছর অসংখ্য নারীর মৃত্যু হচ্ছে। কারণ তারা মুখ ফুটে কথা বলতে পারে না, তাদের কথা বলতে দেওয়া হয় না। নির্যাতিত হওয়ার পর তাদের থাকতে হয় চাপের মুখে।

নারীর প্রতি সহিংসতার খুব লম্বা ইতিহাস রয়েছে, যদিও এরকম সহিংসতার মাত্রা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ছিল, এমনকি আজও বিভিন্ন সমাজে এগুলোর মাত্রা ও ঘটনার ধরন বিভিন্ন হয়। নারী ও বালিকাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা একটি পৃথিবীব্যাপি বিরাজমান সমস্যা। ইতিহাসের পাতা খুললেই দেখা যাবে যে, সূচনালগ্ন থেকেই নারীরা পুরুষশাসিত এই সমাজে সর্বদাই অত্যাচারিত, নির্যাতিত হয়ে আসছে।বলা হয়ে থাকে, মানবসভ্যতার বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের বুদ্ধি-বিবেচনাও সভ্য হয়ে যায় কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করলে দেখা যাবে যে আমরা শুধু উন্নয়নশীল দেশ হয়ে মানবসভ্যতাই বৃদ্ধি করতে পেরেছি তবে মানুষের বুদ্ধি-বিবেচনা অসভ্যই রয়ে গিয়েছে। প্রতিনিয়ত খবরের কাগজ বা ফেসবুক নিউজফিড দেখলেই শুধু একই খবর “নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে”। এমনকি করোনাকালিন সময়েও কমে নি নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা।

একজন নারী নিজের ভাই, বন্ধু, স্বামী কারোও সাথে নিরাপদ নয় এমনকি নিজের বাসাতেও সুরক্ষিত নয় সে।এই যদি অবস্থা হয় তাহলে পুলিশ পাহাড়া ছাড়া নারীদের সুরক্ষার আর উপায় দেখা যাচ্ছে না। নারী নির্যাতনের জন্য নারীদের পোশাক, আচার-আচরনকে দোষারোপ না করে পুরুষদের চিন্তা ভাবনা পরিবর্তন করানো উচিত। স্বাধীন রাষ্ট্রে সকলে স্বাধীনভাবে বসবাস করবে। প্রয়োজন শুধু নিজেদের চিন্তা ভাবনা বদলানোর। একটি কথা সকলের মনে রাখা উচিত,মানুষের মতো মানুষ হয়ে বেঁচে থাকাটাই জীবনের মূখ্য উদ্দেশ্য।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুারোর (বিবিএস) মানবজমিন পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, ১২হাজার ৫৩০ জন নারী নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে একটি জরিপ চালিয়ে নারী নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেন। তাতে দেখা গেছে স্বামীর মাধ্যমে শারীরিক নির্যাতনের শিকার ৬৫ শতাংশ নারী, ৩৬ শতাংশ যৌন নির্যাতন, ৮২ শতাংশ মানসিক এবং ৫৩ শতাংশ নারী স্বামীর মাধ্যমে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

নারী নির্যাতন ও সহিংসতা রোধে প্রচলিত আইন দ্বারা আইনের প্রয়োগ করতে হবে। বিশ্বে নারী অধিকার আদায়ে অনেক সংগঠন কাজ করে যাচ্ছে। যে নারীরা মুখ খুলে কথা বলতে ভয় পায় তাদেরকে সাহস দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।নারীর প্রতি সহিংসতা রোধের জন্য আইন ছাড়াও আমাদের প্রয়োজন ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে নারীর প্রতি নির্যাতন ও সহিংসতা প্রতিরোধ করতে হবে।

নারীর প্রতি সহিংসতা রোধের জন্য আইন ছাড়াও আমাদের প্রয়োজন ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনই নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ করতে পারবে। যার মাধ্যমে নারী পাবে সহিংসতার প্রতিকার। গড়ে উঠবে সহিংসতামুক্ত একটি সুন্দর সমাজ। তাই নারীদের প্রতি আমাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে পরিবার ও সমাজ তথা আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।

সহিংসতা প্রতিরোধে নারীদেরও সোচ্চার হতে হবে। নারীদের কথা বলতে হবে নিজের অধিকার আদায়ে। নির্যাতনকারী সমাজের যেই হোক না কেন, জোরালো কণ্ঠে কথা বলতে হবে তাদের বিরুদ্ধে। সচেতন হতে হবে নিজেদের প্রকৃত অধিকার প্রসঙ্গে। সচেতন হতে হবে শিক্ষা ও চিন্তায়। সর্বোপরি নারীকে নারী নয়, যখনই তাদের মানুষ হিসেবে দেখা হবে তখনই অনেকাংশে কমে আসবে নির্যাতন।

সাদিয়া নওশিন বিন্তি
প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী
পরিসংখ্যান বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

Development by: webnewsdesign.com