ইউক্রেনের পক্ষে বাংলাদেশের ভোট

শনিবার, ২৬ মার্চ ২০২২ | ১২:২২ অপরাহ্ণ

ইউক্রেনের পক্ষে বাংলাদেশের ভোট
apps

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে আনা একটি প্রস্তাবে এবার ইউক্রেনের পক্ষে ভোট দিয়েছে বাংলাদেশ। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার কারণে সৃষ্ট মানবিক সংকটের অবসানে বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি ত্রাণ কার্যক্রমের সুযোগ দিতে সাধারণ পরিষদে এ প্রস্তাব আনা হয়েছিল। এর আগে রাশিয়ার বিপক্ষে সাধারণ পরিষদে আনা একটি প্রস্তাবে বাংলাদেশ ভোট দান থেকে বিরত ছিল। এ নিয়ে ঢাকায় নিযুক্ত রাশিয়ান রাষ্ট্রদূত কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কয়েক ঘণ্টা পরই নতুন আরেকটি প্রস্তাবের ওপর সাধারণ পরিষদে ভোটাভুটি সম্পন্ন হয়। সেখানে বাংলাদেশ ইউক্রেনের পক্ষে ভোট দেয়। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইউক্রেন ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থান পরিবর্তন হয়েছে। তবে কোনো চাপে পড়ে নয়, মানবিক কারণে বাংলাদেশ ইউক্রেনের পক্ষ নিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন। বৃহস্পতিবার নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে সাধারণ পরিষদের বিশেষ জরুরি অধিবেশনে প্রস্তাবটি ১৪০ ভোটে পাস হয়।

সেই সঙ্গে ঠিক এক মাস আগে শুরু হওয়া রুশ আগ্রাসনের ফলে ইউক্রেনে যে গুরুতর মানবিক সংকটের সৃষ্টি হয়েছে, সেজন্য রাশিয়ার সমালোচনা করা হয় ওই প্রস্তাবে। জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য দেশের মধ্যে ইউক্রেনের তোলা ওই প্রস্তাবের পক্ষে বাংলাদেশসহ ভোট দেয় ১৪০টি দেশ। রাশিয়া, বেলারুশ, উত্তর কোরিয়া, ইরিত্রিয়া ও সিরিয়া- এই পাঁচটি দেশ প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়। ৩৮টি দেশ ভোটদানে বিরত ছিল। এই প্রস্তাবের খসড়া তৈরির পর্যায়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল ৬৭ দেশ। দক্ষিণ আফ্রিকার আনা আরেকটি প্রস্তাবের ওপরও ভোটাভুটি হয়েছিল। যেখানে রাশিয়ার নামই আনা হয়নি। শেষ পর্যন্ত যথেষ্ট ভোট না পাওয়ায় সেটি আর চূড়ান্ত ভোটাভুটিতে যায়নি।

গত ২৪শে ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরুর পর মার্চ মাসের শুরুতে রাশিয়াকে আক্রমণ বন্ধ করে সেনা প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘে আরেকটি প্রস্তাব আনা হয়েছিল। সেই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছিল ১৪১ দেশ। বাংলাদেশসহ ৩৫টি দেশ ভোটদানে বিরত ছিল। বাংলাদেশের ওই অবস্থানের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন বলেছিলেন, ওই প্রস্তাবের লক্ষ্য ছিল রাশিয়ার সমালোচনা করা, যুদ্ধ বন্ধ করা নয়। সেখানে যুদ্ধের অবসান চাওয়া হয়নি। ওটা ছিল কাউকে দোষারোপ করার জন্য। আমরা শান্তি চাই, সেজন্য আমরা যুদ্ধ চাই না। যুদ্ধের বিরুদ্ধে আমরা। যুদ্ধের স্বপক্ষে আমরা ভোট দিইনি। ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ শুরুর পর থেকেই সেখানকার পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার কথা বলে আসছে বাংলাদেশ। সরকারের তরফ থেকে এক বিবৃতিতে আলোচনার মাধ্যমে সংকট নিরসনের আহ্বান জানানো হয়েছে সব পক্ষকে। দক্ষিণ এশিয়ার বড় দেশ ভারত এখন পর্যন্ত সরাসরি রাশিয়ার সমালোচনা করেনি কিংবা যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানায়নি। গত ২রা মার্চের মতো বৃহস্পতিবারও তারা জাতিসংঘে ভোটদানে বিরত ছিল। শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানও একই পথ অনুসরণ করে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের রাজনীতি বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড সমপ্রতি তার বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলঙ্কা সফরে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রসঙ্গও তোলেন। ঢাকায় বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারিত্ব সংলাপের শুরুতেই তিনি বলেন, বৈশ্বিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে, বিশেষ করে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের ফলে যখন ‘গণতন্ত্র ও আন্তর্জাতিক আইন হুমকির মুখে’, তখন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করতে চায়। মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারির সফরের পর ইউক্রেন ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থানের পরিবর্তন ঘটতে পারে বলে মনে করছিলেন বিশ্লেষকরা। তবে কোনো চাপের মুখে নয়, মানবিক কারণেই বাংলাদেশ এবার জাতিসংঘে ইউক্রেনের তোলা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন। শুক্রবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এই প্রস্তাবে মানবিক কারণে নির্যাতিত ও আহতদের জন্য সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। যেহেতু আমরা চাই, নির্যাতিত লোকের মঙ্গল হোক। সেই কারণে আমরা এই প্রস্তাবে সমর্থন করেছি। মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ডের সফরের আলোচনা এবং পশ্চিমা দেশগুলোর চাপের মুখে এই সিদ্ধান্ত কি-না, এমন প্রশ্নে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন না, সে কারণে হয়নি। এ প্রসঙ্গে মোমেন বলেন, চাপতো আমাদের কাছে অনেক আছে। কিন্তু চাপে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কখনো ভ্রুক্ষেপ করেন না, এটা আপনাকে অবশ্যই জানতে হবে। তিনি হচ্ছেন বঙ্গবন্ধুর মেয়ে। বাংলাদেশের মঙ্গলের জন্য যা যা করার, তিনি তাই করেন। কোনো চাপের বশবর্তী হয়ে শেখ হাসিনা কাজ করেন না। আপনারা নানারকম চিন্তা, হইচই করেন। এগুলো অলিক। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইসড প্রফেসর ড. আলী রীয়াজ মনে করেন, ইউক্রেনের পক্ষ থেকে উত্থাপিত বৃহস্পতিবারের প্রস্তাবে অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধের কথা বলা হয়েছে এবং ইউক্রেনের শহরগুলোতে রাশিয়ার সৈন্যরা যে অবরোধ তৈরি করেছে তা তুলে নেয়ার দাবি করা হয়েছে, যা কার্যত রাশিয়ার সৈন্যদের প্রত্যাহারেরই আহ্বান। এই প্রস্তাব ২রা মার্চ জরুরি বিশেষ অধিবেশনে গৃহীত প্রস্তাব থেকে ভিন্ন কিছু নয়। এই প্রস্তাবের পক্ষে মোট ভোট পড়েছে ১৪০টি, ভোট দানে বিরত থেকেছে ৩৮টি দেশ। বিপক্ষে রাশিয়াসহ ৫টি দেশ ভোট দিয়েছে। এই প্রস্তাব গৃহীত হলো জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়ার একটি প্রস্তাব নাকচ হয়ে যাওয়ার পর। নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়ার প্রস্তাবে বেসামরিক ব্যক্তিদের সুরক্ষা এবং সেখানে সাহায্য পাঠাবার জন্য সুযোগ তৈরির কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু ওই প্রস্তাবে রাশিয়ার প্রসঙ্গ উল্লিখিত ছিল না। লক্ষণীয় যে নিরাপত্তা পরিষদে ওই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছিল রাশিয়া এবং চীন, বাকি ১৩টি সদস্য দেশ ভোটদানে বিরত থাকে। ফলে প্রস্তাব পাস হয়নি। তিনি বলেন, বাংলাদেশের আজকের (বৃহস্পতিবার) ভোট সকলের মনোযোগ দাবি করে। কেননা, ২রা মার্চ এই বিষয়ে প্রস্তাবে বাংলাদেশ ভোটদানে বিরত ছিল। সেই সময় এর পক্ষে সরকার যুক্তি দিয়েছিল যে তাদের এ অবস্থান ‘নিরপেক্ষতার’ স্মারক। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন বলেছিলেন, বাংলাদেশ ‘যুদ্ধ টুদ্ধের’ বিরুদ্ধে বলে ভোট দানে বিরত থেকেছে। অতীতের এসব তথ্যাদির দিকে নজর না দিয়ে কোনো কোনো বিশ্লেষক সরকারের ভাষ্যকে সমর্থন করে অনেক ধরনের কথা বলেছেন। তারা এই জন্য সরকারের প্রশংসা করতে কুণ্ঠিত হননি। তারা বাংলাদেশের এই অবস্থানকে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থে বাস্তবোচিত বলেও বর্ণনা করেছেন। এখন বাংলাদেশের এই অবস্থান বিষয়ে তাদের কাছে নিশ্চয় ভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা শোনা যাবে। কিন্তু নতুন এই প্রস্তাবে বাংলাদেশের সমর্থনসূচক ভোট গুরুত্বপূর্ণ বলেই বিবেচনা করা দরকার।

ড. রীয়াজ আরও বলেন, বাংলাদেশের ভূমিকার বাইরেও আজকের ভোট আবারো প্রমাণ করছে যে, কূটনীতির মাঠে রাশিয়া অনেকটাই পিছিয়ে আছে। এর আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে ইউক্রেনের এই প্রস্তাবের পাশাপাশি দক্ষিণ আফ্রিকা একটি প্রস্তাব আনতে চেয়েছিল, যেখানে রাশিয়ার ভূমিকা বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। সেই প্রস্তাব সাধারণ পরিষদ বিবেচনায় নেয়নি। ইউক্রেনের পক্ষে বাংলাদেশের অবস্থানকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান। তিনি বলেন, বাংলাদেশের এই ভোট আসলে মানবিক অবস্থানের পক্ষে। রেজ্যুলেশনে রাশিয়াকে আগ্রাসন থেকে সরে আসার আহ্বানও জানানো হয়েছে। তবে এখানে মানবিক সহায়তার বিষয়টিই মুখ্য হয়ে এসেছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীর বিষয় টেনে এনে তিনি বলেন, মানবিক কারণে যেমন বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের জায়গা দিয়েছে, তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছে। একই আঙ্গিকে মানবিক সহায়তার ইস্যুতে সকলেরই উচিত ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন দেয়া। রাশিয়া-ইউক্রেন ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. সাহাব এনাম খান। তিনি বলেন, ইউক্রেনে আক্রমণ হয়েছে এবং সেখানে মানবিক বিপর্যয় ঘটছে- এটা ডকুমেন্টেড। তাই দেশটিতে মানবিক সহায়তা প্রদানের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। এখানে পক্ষে ভোট দেয়ায় বাংলাদেশের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। বাংলাদেশকেও শরণার্থী সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এতে বহুপাক্ষিক সহায়তা প্রাপ্তির একটা বিষয় রয়েছে। সুতরাং, মানবিক সহায়তার ইস্যুতে বাংলাদেশ নিরপেক্ষ অবস্থান নেয়নি। বাংলাদেশের সংবিধান ও পররাষ্ট্রনীতি অনুযায়ী এটা করার সুযোগ নেই।

Development by: webnewsdesign.com