মহীয়সী নারী সিন্ধুতাই সপকাল

শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৯ | ৩:১৮ অপরাহ্ণ

মহীয়সী নারী সিন্ধুতাই সপকাল
apps

এতিম শিশুদের ১৯৭৩ সাল থেকে দেখাশোনা করছেন বর্তমানে ৭১ বছর বয়সী এই মহীয়সী নারী । স্বামীর বাড়ি থেকে বিতাড়িত হবার পর থেকেই পথশিশু আর এতিমদের মা হয়ে উঠেন তিনি।
সিন্ধুতাই জন্ম নেন মহারাষ্ট্রের ওয়ারদা শহরে। কন্যাসন্তানের প্রতি নেতিবাচক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির মাঝে থেকেও গরীব বাবা তার মেয়ের প্রতি ভালোবাসা খুঁজে পান। পাঁচ বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি করানো হয় সিন্ধুতাইকে। কিন্তু বেশি দূরে এগোয়নি তাঁর পড়াশোনা। পুরুষশাসিত সমাজের চাপে মেয়েকে বিয়ে দিতে হয়। ১০ বছরের সিন্ধুতাইয়ের সঙ্গে বিয়ে হয় ২০ বছরের এক যুবকের।
স্বামীর সংসারে গিয়েই মুখোমুখি হন অকল্পনীয় পরিস্থিতির। ক্লান্তিহীন শারীরিক পরিশ্রম আর সেবা করেও মন জয় করতে ব্যর্থ হন স্বামী, শ্বশুর ও শাশুড়ির। এরই মধ্যে জন্ম দেন তিন তিনটি সন্তান। চতুর্থ সন্তান জন্মের আগে তার ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন বেড়ে যায়। একদিন তার স্বামী তাকে বেধড়ক মারধোর করেন। রেখে আসেন গোশালায়, বন্ধনহীন অনেক গরুর মাঝে।

তিনি বলেন, তাকে মারপিটের পর ওই গোশালায় রেখে দেওয়া হয়, যেনো গরুর পায়ের আঘাতে মৃত্যু হয় তার। এতে তার স্বামীর পরিবারের ওপর অভিযোগ উঠবে না, তারা তাঁকে মেরেছে। অনেক গরুর ছোটাছুটি দেখে ভয় পেয়ে যান তিনি। নিজের জীবনের ইতি এখানেই, মনে মনে ভাবেন তিনি। কিন্তু তার জীবনতো তার হাতে নেই। এতো ঈশ্বরের দেয়া। ‘রাখেন আল্লাহ, মারে কে’- প্রবাদেরই প্রমাণ তিনি। অন্য গরু যখন তার দিকে ছুটে আসছিলো, একটি গরু তার সামনে এসে দাঁড়ায়। সিন্ধুতাইয়ের মতো, ‘ওই গরু অন্য গরুদের বলে, ওকে আঘাত করবে না।’
ওই সময় নিজের চতুর্থ সন্তানকে পৃথিবীতে নিয়ে আসেন তিনি। চাকু-কেচির মতো কোনো কিছু না পেয়ে গোশালায় পাওয়া একটি পাথর দিয়ে নাড়ী কাটেন তিনি। একে একে ১৬বার আঘাত করার পরই মেয়ের সাথে নিজের নাড়ীর বিচ্ছেদ করেন সিন্ধুতাই।

এই বিপদসংকুল পরিবেশে সদ্যজাত সন্তানের মুখ দেখে কষ্টের কথা সাময়িক ভুলে যান তিনি। নিজের জীবন বাঁচানো গরুকে আসার সময় বলে আসেন, ‘আজ গরু হয়েও তুমি আমার সাথে মায়ের মতো আচরণ করলে। তোমার সুরক্ষামূলক আচরণে আমিও মা হলাম।’
সদ্য জন্ম নেয়া সন্তানকে নিয়ে নিকটবর্তী রেল স্টেশনে যান তিনি। আত্মাহুতি দেওয়াই ছিলো তাঁর উদ্দেশ্য। কিন্তু রেল স্টেশনে ভিক্ষুক আর এতিমদের দেখে নিজের কষ্টকে ছোট মনে হয় তাঁর। তিনিও শুরু করেন ভিক্ষাবৃত্তি। সিন্ধুতাই বলেন, ‘আমার দুধের শিশুকে নিয়েই আমি ভিক্ষা শুরু করি। তখনই আমি আমার মনে এক বড় ধরনের আকুতি শুনতে পাই, এতিমদের দেখাশোনা করার। আমি উপলব্ধি করি, ভিক্ষা করা আমার মধ্যে নিহত ছিলো।’

এরই মধ্যে বাস্তুছাড়া ভিক্ষুক ও এতিমরা তার নতুন পরিবারের সদস্য হন। এদের দেখভালের জন্য দিনভর তিনি ভিক্ষা করতেন। সন্ধ্যায় এসে খাওয়াতেন তাদের। রাস্তার এ পরিবার পেয়ে আত্মহত্যার কথা ভুলে গেলেও প্রতিদিনই জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছে তাঁকে। আত্মহত্যার চিন্তা বারবার উঁকি দিতো তাঁর মন-জগতে। একদিন আবারও আত্মহত্যার কথা ভাবেন তিনি। সেদিনই রাতে খাবার খাচ্ছিলেন এ অভাগিনী মা। প্রতিদিন অন্য ভিক্ষুকদের খাবার দিলেও সেদিন দেননি, নেননি খোঁজ-খবরও। সিন্ধুতাই বলেন, ‘ওই দিন তিনি কাউকে খাবার দেননি, কেননা পেটপুরে খেয়ে তিনি বিদায় নিতে চেয়েছিলেন পৃথিবী থেকে।’

ওই খাবারকে মনে করেছিলেন, তার শেষ খাবার। এমন সময় এক পুরুষ ভিক্ষুক আসে। ওই ভিক্ষুক জ্বরে কাঁপছিলেন, ক্ষুধায় কাতরাচ্ছিলেন। কান্না করছিলেন কিছু খেতে। আশপাশের মানুষের কাছে চাচ্ছিলেন পানি। সহ-ভিক্ষুককে দেখে মন গলে গেলো সিন্ধুতাইয়ের। শুধু পানি নয়, সাথে কয়েকটি গমের রুটিও দিলেন তাকে। এতে ওই ভিক্ষুক সুস্থ হয়ে উঠলেন। এবারের এ ঘটনা তাকে বাঁচালো আত্মহত্যা করা থেকে।
ওই ঘটনার স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে ওই ভিক্ষুক বেঁচে গেলেন। আবারও একবার আমি উপলব্ধি করলাম, জীবন কতটা শক্তিশালী। আর এর পরেই আমি জীবন ছেড়ে দিলাম ঈশ্বরের কাছে, ত্যাগ করলাম আত্মহত্যার পরিকল্পনার।’
এরপর নিজের নতুন পরিবারকে মনোযোগ দিয়ে গড়া শুরু করলেন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত তার হাতে পালিত সন্তানের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫শ। এদের মধ্যে রয়েছে ২৭০ জন জামাতা, ৪০ জনেরও বেশি ছেলের স্ত্রী এবং এক হাজারেও বেশি নাতি-নাতনি।

তার নিজের মেয়ে মমতাসহ এদের অনেকে হয়েছেন আইনজীবী, চিকিৎসক ও বিভিন্ন মর্যাদাশীল পেশার অধিকারী। মমতাও শুরু করেছেন তার নিজের এতিম আশ্রয় কেন্দ্র। তার এক পালিত সন্তান তারই জীবনকথা নিয়ে করেছেন পিএইচডি।
তাঁর এই জীবনযুদ্ধের ও মানবতাবাদী কর্মজীবনের জন্য সম্মানিত হয়েছেন দেশে বিদেশে। পেয়েছেন ২৭০টিরও বেশি পুরষ্কার। তাকে নিয়ে হয়েছে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রও, তার মায়ের ভাষা-মারাঠিতে। পুরষ্কারের সাথে সম্মাননা বাবদ যে অর্থ পান তিনি তা পালিত শিশুদের দেখভালে ব্যয় করেন। পুনে ও চিকালধারায় গড়ে তুলেছেন এতিমদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র।
এসব চালাতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তহবিল সংগ্রহ করতে সফর করেন তিনি। তার শেষ ইচ্ছা পুষ্টিহীন শিশুদের জন্য একটি আশ্রয়কেন্দ্র ও হাসপাতাল নির্মাণ করা। তিনি বলেন, ‘মানুষ এতিমদের বিষয়টি বুঝতে পারে, এ জন্য অনেকে অনুদানও দেয়। কিন্তু পুষ্টিহীন শিশুদের জন্য এ ধরনের মানবিক সাহায্য তেমন নেই। পুষ্টিহীনতার কারণেই মহারাষ্ট্রের প্রত্যন্ত এলাকায়, বিশেষ করে আদিবাসীদের মধ্যে শিশু মৃত্যুর হার বেশি।’

তাঁর ভাষ্যমতে, মহারাষ্ট্রে আদিবাসী এলাকায় অনেক স্বামী তাদের স্ত্রীকে ছেড়ে যান। না খেয়ে বেচে থাকেন গর্ভবতী নারীরা। মায়ের পেটে থাকার সময় থেকেই অপুষ্টিতে ভোগে অনেক শিশু।
তিনি বলেন, ‘আমি এ ধরনের গর্ভবতী নারীদের হাসপাতালে রাখতে চাই। সন্তান প্রসবের তিন মাস পর আমার বাড়িতে (আশ্রয়কেন্দ্র) রাখবো তাদের। এতে করে মা ও সন্তান সুস্থ ও বেচে থাকবে। এটা আমার স্বপ্নের প্রকল্প। এর মাধ্যমে আমি আমাকে এই পৃথিবীতে পদচিহ্ন রেখে যেতে চাই।’

Development by: webnewsdesign.com