লালকুঠি থেকে নৌকায় করে লঞ্চে উঠে হাঁফ ছাড়লাম। সাধারণত লেট হয় না আমার। কিন্তু পুরান ঢাকার চক্করে পড়ে সব উল্টেপাল্টে গেল। বংশাল বামে রেখে নবাবপুর রোড ধরে ধোলাইখাল হয়ে লক্ষ্মীবাজার আসতেই বারোটা বেজে গেছে। ঘাটে না গিয়ে বিউটি বোর্ডিং চৌরাস্তা হয়ে লালকুঠি এসে নৌকা ঠিক করলাম একশো টাকায়। সঙ্গে একজন বোটমেট পাওয়ায় পঞ্চাশ পারসেন্ট কমিশন। একটু একটু করে লঞ্চের গতি বাড়ছে। এর মধ্যেই মাঝি আমাকে এবং আরেকজন যাত্রীকে তুলে দিয়ে নিরাপদে চলে গেল ঘাটে।
এদিকে রাতের ঢাকা বেশ ঝলমলে হলেও জলের গন্ধে গা ঘুলিয়ে বমি আসে। তাই বিজনেস ক্লাশ এসিতে একটা ফাঁকা সিটে বসে মনিটরে কারিনা কাপুরের নাচ দেখতে মনোযোগী হলাম। গন্ধ ভুলে থাকতে গিয়ে সুগন্ধের কথা মনে হল। এই লঞ্চের ছাদে টবে নানাজাতের ফুলের ফাঁকে রজনীগন্ধার চারা লাগিয়েছিলাম। জুতোর ফিতে একটু আলতো করে বেঁধে উঠে গেলাম ছাদে। চোখে সর্ষেফুল দেখার মত খালি ছাদে টব টুব কিচ্ছু নেই। কখনো এখানে জীবন্ত কিছু ছিল এরকম কোন চিহ্নই নেই। মতিন ভাই নিরাপত্তা প্রধান। তাঁকে ডাকতেই বুড়োমতন নিরীহ একজন এলেন। নেমপ্লেট পড়ে নাম জানলাম আফাজুদ্দিন। মতিন ভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করলে জানালেন, এই নামে কাউকে চিনেন না তিনি। তবে জানাতে পারলেন, লঞ্চের কাজ চলছে শেষ হতে আরও কয়েকমাস লাগবে। ট্রায়াল চলছে মাঝে মধ্যে। ছাদের গাছের কথা তিনি কিছুই জানেন না।
মাষ্টারব্রিজে গিয়ে খায়ের মামাকে পেলাম না। আজকের চালকের নাম মকবুল। তৃতীয় শ্রেণির মাষ্টার। বাড়ি জামালপুর জেলার ইসলামপুরে। কথা বলতে বলতে মুক্তারপুর ব্রিজ পেরিয়ে মুন্সিগঞ্জ ঘাটের কাছে চলে আসলো লঞ্চ। এখানে কলা আর গরমরুটি নিয়ে ফেরিওয়ালারা লঞ্চে উঠে। চাপাকলা আর গরমরুটি গরীবের জন্য অমৃত। ডেকের যাত্রীরা পাঁচ সাত মিনিটে ঝাঁকা খালি করে ফেলে। ছত্রিশ বছর ধরে এই পথে যাতায়াত। টানা তিন যুগের টান। প্রতিটি বাঁক। প্রতিটি ঘাট। প্রতিটি লাইটিং। প্রতিটি ভেঁপু। প্রতিবার অসংখ্য চেনা মানুষের দেখা মেলে এই লঞ্চের সিঁড়িতে, চায়ের স্টলে, ছাদে, টিকিটঘরে, কেবিনে, করিডোরে কিংবা বিজনেসক্লাশ এরিয়ায়। আজ কোন চেনামুখ নেই। চিরচেনা মুখগুলো এভাবে হারিয়ে যায় কেন! তবে কী আজ ভুল লঞ্চের যাত্রী হয়েছি লালকুঠির নৌকায় চড়ে পঞ্চাশ টাকা জরিমানা দিয়ে? এমন আগে কখনো হয়নি। এমভি পানিরাজ। ঢাকা-লক্ষ্মীপুর-নিঝুমদ্বীপ।
কলা কিংবা রুটি কিছুই পাইনি। ক্যান্টিনে গিয়ে দেখি বড়বড় পাত্রগুলো খালি হয়ে আছে। চুলায় ভাত বলকাচ্ছে। মিটিমিটি হেসে ইজারাদার ছলিমুল্লা জানালেন, সোনালী মুরগী রান্না হচ্ছে একটু বসেন। বলেই সহকারীকে পাঠিয়ে চায়ের স্টল থেকে কম চিনি দিয়ে দুইকাপ চা আনতে পাঠালেন। এই লোকটাকে আমি কেন যেন পছন্দ করি না। কিন্তু সে গায়ে পড়ে সব সময় কিছু না কিছু আলগা খাতির করবেই। মুখে অপছন্দের কথা বলা অশোভন তাই চুপ করে রইলাম। এই একজন অপছন্দের লোকছাড়া আজকের পানিরাজে আমার চেনা কেউ নেই। আমি কি খোয়াজ খিজিরের আত্মীয় যে পানিরাজে আমার চেনা-জানা লোক থাকবেই এই কথা জিজ্ঞেস করলাম আমাকেই। উত্তরের আশায় বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না, ক্যান্টিনের সহকারী আলগা পাতির রঙ চা গ্লাশে করে নিয়ে এসেছে। ছলিমুল্লার নির্দেশ অমান্য করে সে আমার পছন্দের চা এনে দিয়েছে বিষয়টা ভাবনার।
জিজ্ঞেস করলাম,
নাম কি?
ভুইল্লা গেছেন! ওস্তাদ মহসীন খান।
ওস্তাদটা কিসের?
আপনিই তো আমারে এই টাইটেল দিসেন। লঞ্চে সবাই আমারে ওস্তাদ কইয়াই ডাহে। ছলিমুল্লার এই সহকারীর কথা মনে পড়লো। খোয়াজ খিজিরের সাথে তারও একটা যোগসূত্র আছে। বছর তিনেক আগে তাঁকে এই লঞ্চে পাউরুটি বেচতে দেখে মনে হল কোন ভদ্রঘরের ছেলে ঘরপালিয়ে এমন কাজ করছে। কিন্তু পরে কথা বলে জানলাম, মহসীন খান জলের উপর ভাসমান পান্থনিবাসে জন্ম নিয়েছেন। তাঁর মা তাঁকে বিক্রি করে দিয়েছেন খানবাড়ির এক ধনীর কাছে। মহসীনকে কেনার দুই তিন বছরের মধ্যে সেই ধনী লোকের সন্তান হয়। এরপর কেনা জিনিষের প্রতি খানবাড়ির মায়া কিংবা টান কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। খানবাড়ির গিন্নির গয়না চুরি করে সে পালিয়ে এসেছে। তাঁকে বুঝালাম, পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত মানুষ চোর। কিন্তু তারা কেউ স্বীকার করে না। তুমি স্বীকার করেছ তুমি তাই ওস্তাদ। ওস্তাদ মহসীন খান। তুমি কাল থেকে ঘাটশালায় পড়তে শুরু কর। তোমাকে চাকরি পাইয়ে দেব। কিন্তু শর্ত একটাই। কাউকে নিজের জন্ম পরিচয় এবং বৃত্তান্ত বলা যাবে না। কিন্তু কেন! আমি তো মিথ্যা কিছু বলি না। তাঁকে বুঝালাম, সত্য মিথ্যা বিষয় না, মানুষ অন্যের জন্ম নিয়ে যেমন কৌতূহল দেখায় নিজ জন্মের জন্য একটুও বিস্মিত হয় না। লুকিয়ে ফেলাটাই জীবন। সকলের মতো সহজ করে লুকিয়ে ফেলতে পারাই জীবনের আনন্দ। যে সত্য অন্যকে করুনা এবং ঘৃণা করতে দেয় সে সত্য সুন্দর নয়। তাই এই সত্য লুকিয়ে থাকার সত্য। লুকিয়ে রাখারও। মহসীন এখন সকলের ওস্তাদ। আমার কাছেও সে ওস্তাদ হিসেবে দাঁড়ায়। ছলিমুল্লা দাঁত কেলিয়ে তরমুজের বিচির ফাঁক থেকে শব্দ করে বলে, মিয়াভাই ভাত নামছে। গরম তেলে দুইডা মরিচ ভাইজা দিই। ঘন ডাইলের লগে মচমচ কইরা ভাইঙ্গা খান। ওস্তাদ মিয়াভাইরে বড় পোয়ামাছটা দিয়ে একপ্লেট ভাত দে। সাড়ে এগারো ইঞ্চি সাইজের একটা পোয়া ঘনডাল আর দুই তিনটা ভাজা মরিচে ডিনার শেষ করে হাতধুয়ে বিল দিতে গেলে ছলিমুল্লা বলে ওঠে, করেন কি করেন কি আপনার কাছ থেকে বিল নিলে আমার ইজারা থাকবো নিহি। মহসীন টিস্যু বের করে বলে, হাত মোছেন। সোনালী মুরগি কইয়া পোয়ামাছ দিয়া চালাইয়া দিসে এর আবার বিল!
স্যার একটা সিগারেট ধরাইয়া দিই? না, সিগারেট টানা বন কইরা দিসি। হাত মুছে ছাদে চলে এলাম। পেছনে ওস্তাদ মহসীন খান। যাত্রীর চাপ তেমন নেই মুখে মাস্ক লাগানো ঢাউস আকৃতির মহিলার আনাগোনা যত্রতত্র। কিছু পুরুষও মাস্ক পরে পায়চারি করছেন কিন্তু এদের কাউকেই লঞ্চের যাত্রী মনে হচ্ছে না। সলিমুল্লা লঞ্চটাকে প্রমোদতরী বানাতে চায় একথা শুনেছি আগেই। মহসীন এর সাথে যোগ করলো আরও কিছু নতুন তথ্য। নির্মাণ কাজ শেষ হয়ে যাবার পরও লাইনে না দিয়ে আটকে রাখার ধান্দা আছে। লঞ্চের প্রতিটি কেবিন এক একটি বাইজিঘর। কত মেয়েরা যে আসে এর ইয়ত্তা নেই। ছলিমুল্লার কামাই এমন হয়েছে অল্পকিছু দিনের মধ্যে একটা লঞ্চ কিনতে যাচ্ছে। প্রমোদতরীর নামে নদীতে এখন পুরোদস্তুর বডিবিজনেস চলছে। মহসীনের মুখে ডিবিজনেস শব্দ শুনে চমকে উঠলাম। আজকাল এমন এমন টার্ম কানে আসছে আগে কল্পনা করতেও খুব কষ্ট হত। পানিরাজের ছাদে বসে আমার খুব তেষ্টা পেল। খাবার খেয়ে সঙ্গে সঙ্গে পানি খাই না এটা মহসীন জানে, তাই আমাকে বসিয়ে দ্রুত চলে গেছে নিচে। একটা নয় তিনটে পানির বোতল নিয়ে ছাদে চলে এসেছে নিমিষেই। এটা সাদা পানি, এটা কালাপানি আর এটা লালপানি। পানিরাজে এখন পানির ছড়াছড়ি। বলে ছিপি খুলে বলল, দেখেন লোকাল জিনিষ না ফরেন ইস্কটল্যান্ড থিকা আইছে কইল এম্পিসাবে।
পানিরাজে এখন এমপি সাবেরাও উঠে?
কী যে কন স্যার, ফরেন মাল আর অরিজিনাল মেশিন থাকলে এমপি কেন মন্ত্রীও চলে আসে ফুরফুর কইরা। হেইদিন আমগো কামাইপাতি ভালা। লাল পানি, নয়ানোট বখশিস তো হেরা ছাড়া কে দিব! সাদাপানির বোতলে লেভেল সাঁটা আছে জীবন। ছিপি খুলে একঢোঁক পান করে মনে হল ওস্তাদ মহসীন খান বোতলের জিনিষ এলোমেলো করে রেখেছেন। তিতকুটে জলের ধারা গলা বেয়ে নেমে যাচ্ছে পেটের দিকে। জ্বলে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাচ্ছে জলের চলাচল
পথ। মহসিন হাসছে খিলখিল করে। বলছে স্যার, কোন প্রবলেম?
প্রবলেম মনে করলেই প্রবলেম, মনে না করলে কিসের কী! দাও আরও এক বোতল দাও আর ছলিমুল্লারে এখানে আসতে বল।
হে অহন আইব না। ভিআইপি রুমে মডেল দিয়ামনি আছে আইজ যে বুকিং দিসে হে আহে নাইক্কা। এহন ইজারাদার আউস মিডাইয়া লইব।
মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে। বললাম, তুমি গিয়ে আমার কথা বল। আর স্কটল্যান্ডের বোতল নিয়া আসো আরেকটা। দিয়ামনি না কি নাম বলছ তারেও নিয়া আসো। মহসীন কিছু না বলে নিচে নেমে গেল। লঞ্চ তখন ষাটনল ঘাটের কাছ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। দূর থেকে আলো ফেলতে ফেলতে আসছে একটার পর একটা জলের দানব। উদরে হাজার হাজার মানুষ। কেউ নিতান্তই যাত্রী। কেউ শখের বশে। কেউ জীবন ও জীবিকার সন্ধানে ছুটে চলছে দিগ্বিদিক। মহসীনের মতো কেউ কেউ চিরভাসমান। ভাসতে ভাসতে জন্ম। ভাসতে ভাসতে বেঁচে থাকা।
মিয়াভাই আমারে ডাকছেন?
ছলিমুল্লার ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেলাম। আজ আবার টাইও পরেছে। খেয়াল করে দেখলাম ওর জুতো জামা প্যান্ট সার্ট সবকিছু এখন ঝকঝকে তকতকে। বললাম, বসেন। দিয়ামনি কোথায়? সবগুলো দাঁত বের করে বলে তোবা আস্তাগফিরুল্লা কি শুনতে কি শুনছেন জানি না এই কাম আমি ছাইরা দিসি পুরবী ১১ ছাড়ার পরই।
ছলিমুল্লা তুমি তো আমারে ছত্রিশ বছর ধইরা দেইখা আইতাছো। আমি কি কহনো তোমার লগে মজা মারছি?
না মিয়াভাই।
তাইলে ঐ মাল এখানে নিয়ে আসো। ৫ মিনিট টাইম দিলাম। আর মহসিনরে দিয়া এক বোতল ফরেন পাঠাও এর আগেই। বলেই কড়া করে একটা ধমক লাগালাম, যাও এখন জঙ্গলের বাচ্চা। ধমকে কাজ হয়েছে। ছলিমুল্লা নেমে গেছে নিচে। মহসিন ইসকটল্যান্ড থেকে আসা বোতল নিয়ে হাজির হয়েছে। সঙ্গে একটা বেডকভার। ছাদে বিছিয়ে উপরে বোতলগুলো সাজিয়ে রাখল। আর আড়চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে তেরছাভাবে। আমি যে বিষয়টি বুঝতে পারছি তা প্রকাশ না করে বললাম ইজারাদার নাটকীর পোর নাম যেন কি?
ছলিমুল্লা লস্কর। পাঁচ মিনিটের কয় মিনিট বাকি? বলতে না বলতেই ধুমসি মতো একটা মহিলা এসে পাশে বসে পড়লো কিচ্ছু না বলেই। ওর দিকে না তাকিয়ে মহসিনকে বললাম, একে ছয়ফিট দূরে বসতে বল। আর কে এই বেত্তরমিজ যে সালাম না দিয়ে বসার সাহস করে!
স্যার এই তো মডেল দিয়ামনি। এর জন্য পাগল এমপি মন্ত্রী সচিব পয়সাওয়ালারা।
খানকির পোলাগো রুচির ডায়াবেটিস অইসে। নইলে এই মটকা ধুমসির জন্য টাকা খরচ করে কেউ। কি আছে এই ড্রামের মধ্যে খোদা ভি মালুম। ইজারাদার বান্দির পুত কই ওরও তো লগে আসার কথা।
মহসিন পরিস্থিতি সামলে নিতে চেষ্টা করছে। স্যার এইখানে এইসব না কইয়া ভিআইপি কেবিনে আইসা বইয়া কইলে সুন্দর অইত না! ওস্তাদ এইডা কি হুনি আপনের মুক থেইকা! কুতুবমিনারের ইমামছাব দেহি পানিরাজে উইঠা পরছে। আপনি আমারে সুন্দর ভি হিগাইতে আইছেন ভালা তয় ছলিমুল্লারে নিয়া আহেন। এরপর দুইজনরে একলগে ভি ছুন্দর হিগাই। স্কচের বোতল থেকে র মেরে গলা ঝলসে নিলাম। গলা দিয়ে জলন্ত ইস্পাতের দানা ঢুকে চলে যাচ্ছে পাকস্থলীতে।
ছলিমুল্লা সামনে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে হাত চুল্কে বলছে, মিয়াভাই আপনি এহানে এমুন না কইরা ভিআইপি কেবিনে আইয়া দরকার অয় আমারে জুতা দিয়া
মারেন। মডেলের সামনে আমারে বেইজ্জতি কইরেন না।
তর ইজ্জতের মায়রে বাপ। বডিবিজনেস করবি তাও আবার পানির উপ্রে। এমপি মন্ত্রীর কথা কইয়া পার পাইতে চাস। বান্দির পো তুই তো জানস না পাঁচ বছর পর কত ফকিন্নির বাচ্চা এম্পি হয়। ঐ থাইকা কেউ কেউ ভি মন্ত্রীও অহে। তুই আর তর মডেল অইলি জলের জঙ্গল। এর থেইকা এম্পি মন্ত্রী অইয়া
হারাদেশ ভাইরাস ছড়ায়। ভাইরাসে নষ্ট অইয়া গেছে ছহরের তামাম জোয়ানকি পোলা-মাইয়া। তোর ঘরে নিজের বউ পোলাপান আছে। মাইয়ার বয়সী পোলাপানরে কাস্টমারের রুমে ঢুকাইয়া লঞ্চ কিনস। আর কস তোরে জুতা দিয়া মারতে। জুতার কি ইজ্জত নাই রে চুদির পো… তোরে আইজ জবাই কইরা গাঙ্গে ফালামু, মাছেও খাইবো না মাগিরদালাল।
ওস্তাদ মহসীন খান। মেশিনটা বাইর করেন। প্রথম গুলিটা কারে করবেন? মডেল নাকি ইজারাদার? টর্স কইরাও লওন যায়। না স্যার টাইম নাইক্কা। লোড করাই আছে প্রথম যারে কিনারে পামু তিনডা গুলি মাইরা দিমু। এরপর বাকি তিনডা আরেকজনরে। ইসমে আজম কইয়া লবি আর খিজিরের নামে জিকির না কইরা ট্রিগারে আঙ্গুল রাখবি না। ছলিমুল্লা কাঁপতাসে দিয়ামনি চোখ বড় বড় করে একবার মহসীন আরেকবার আমার দিকে তাকাচ্ছে। কি করবে বুঝতে পারছে না কেউ।
মহসীন, লঞ্চ এখন কোন পয়েন্টে আছে? মোহনপুর এরপর তিননদীর মোহনা। লাশ দুইটা ঐখানে ফেললে সাগরে ভেসে যাবে। বহুতদিন পর দুইডা ক্রিমিনালরে একলগে পাইছি। পুরা দেছের বারোটা বাজানের লাইগা গাঙ্গে হান্দাইয়া রইছে। কেমুন আরাম উরাম কইরা আখের গোছাইয়া নিতাসে ভাবছে, কেউ টেরও পাবে না। আইজ খাইছি দুইডারেই। কথা শেষ না হতেই সলিমুল্লা কিছু বুঝতে না দিয়েই ছাদের উপর থেকে লাফ দিয়ে পড়ে গেল। সামান্য একটা শব্দ হল ঝুপ।
দিয়ামনি এই প্রথম শব্দ করলো, স্যার আমার সাত মাসের একটা বাচ্চা আছে। ওর কসম খাইয়া কইতাসি জীবনে আর এমুন কাম করুম না। আমারে একবার সুযোগ দেন। আমার বাচ্চাটার কথা ভেবে জীবন ভিক্ষা দেন স্যার। আর এইপথে আমু না।
মহসীন, ওর রেকর্ড বাইর কর। স্যার, মিছা কতা কইতাছে। ওর বিয়াই হয় নাই। বাচ্চা আইব কইত্তে। গুলি তো এখনো ৬ টাই আছে না কি! হ স্যার ইজারাদার তো গুলি না খাইয়াই ফাল পারছে। সবগুলাই রেডি আছে। ওর পুরা আমলনামা পইরা শুনান।
আলেয়া আক্তার, পিতা জয়নাল আবেদিন, মাতা সুরাইয়া বেগম। ভাসানটেক, ঢাকা। প্রথম বনানীর কাকলী এলাকার হোটেল থেকে দেহব্যবসারত অবস্থায় ধরা পড়ে। এরপর লোকাল কাউন্সিলর এর তদবিরে ছাড়া পায়। প্রথম মামলা ইয়াবা চোরাচালান। টেকনাফ থেকে আড়াই লক্ষ পিস ইয়াবা নিয়ে ধরা পড়ে কেরানীরহাটে। হাজতে তিনমাস থাকার পর এক সাংসদের তদবিরে জামিন পায়। এরপর দেদারসে চালিয়ে আসছে বডি মদ ইয়াবা এলএসডি মারিজুয়ানা
সবকিছু। নদীপথের ফ্লোটিং প্রস্টিটিউশনের একটা অংশের লিড দেয়। তার খদ্দেরের তালিকায় শহরের অভিজাত পরিবারের যুবক থেকে শুরু করে ফরেন ক্লায়েন্ট সব আছে। এই পর্যন্ত হাজার তিনেক লোকের ইয়াবার যোগান সে নিশ্চিত করে। গতমাসে জাহরা নামের এক সহকারীকে খুন করে সিমেন্টের বস্তায় ভরে গাঙ্গে ফেলে দিয়েছে। শহরে এবং গ্রামে তার নামে মামলা আছে গোটা বিশেক। এর মধ্যে মাদক চোরাচালান, হত্যাচেষ্টা এবং প্রতারণার অভিযোগই বেশি। এই পর্যন্ত স্বামী হিসেবে ২১/২২ জনের পরিচয় দিলেও বিয়ের কোন রেকর্ড নাই। দুইবার এবোরশন করা হয়েছে। একটা খিলক্ষেত আরেকটা
যাত্রাবাড়ীতে। বাবা রিকশা চালাতেন এখন বরগুনায় অটোমোবাইল এর শো রুম এবং রেন্ট এ কার বিজনেস। অরিজিন মংডু মায়ানমার। রোহিঙ্গা শিবির থেকে সরে এসে বাংলাদেশী দালালদের মাধ্যমে সেটেলার হয়ে গেছে। জাতীয় পরিচয়পত্রের ঠিকানা ঝিলংজা কক্সবাজার। দিয়ামনি মডেল হিসেবে পরিচিত হলেও ভ্যারাইটি শো ছাড়া কোন প্রোডাক্টের বিজ্ঞাপন করেনি। মডেল সাইনবোর্ড এর আড়ালে সবই ফাঁদ।
ফাঁদ না ফাঁদ না এটা তো দেখছি একটা পুরা ইন্ড্রাষ্ট্রিজ। জলের আসল জঙ্গল। মহসিন মেশিনটা দে দেখি। মাউজারের ট্রিগারে হাত চেপে উপরের দিকে না দেখে টান দিলাম। একটা বাঁদুড় গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়লো মেয়েটির কোলে। বাদুড়ের ছটফটানিতে অস্থির হয়ে মেয়েটি একবার মহসিন আরেকবার আমার দিকে তাকিয়ে দেখছে ভালো করে। হঠাৎ একপলকে নিজের কোমর থেকে চকচকে রিভলবার বের করে তাক করলো আমার দিকে। কিছু ভাবার আগেই দুই দুইটা গুলি করে বসলো মাথা লক্ষ্য করে। সামান্য ঝুঁকে প্রথমটা পার করে দিলেও দ্বিতীয়টা ছিঁড়ে নিয়ে গেল কানের লতির একাংশ। ওস্তাদ মহসিন খান ঘটনার আকস্মিকতায়ঘাবড়ে গিয়ে দিয়ামনির রিভলবার বরাবর ঝেড়ে একটা ফ্লাইংকিক মেরে ফেলে দিলো। এরপর সে ওটা ধরতে গেলে পেছন থেকে সজোরে লাথি মেরে ফেলে দিলো নদীতে। ছলিমুল্লা পড়ার সময় শব্দ কম হয়েছিল এবার বেশ শব্দ হলো। উৎসুক মানুষেরা দেখতে চাইলো কি পড়েছে এমন করে। কিন্ত ততক্ষণে লঞ্চ এগিয়ে গেছে অনেকখানি। জলে ভাসমান জঙ্গলের সাথে আরেকটুকরো যোগ হয়েছে মাত্র। মহসিন একটা ওয়ানটাইম ব্যান্ডেজ দিয়ে কানের লতি ঢেকে স্কচ দিয়ে মুছে দিলো কানের নিচের অংশ। একটু আরাম আরাম লাগছে। জঙ্গল পরিস্কার করতে গেলে এমন হতেই পারে। ঘাটে নেমে একগ্লাস মাঠা খেলে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে।
Development by: webnewsdesign.com