হাড় কাঁপানো শীতের পাশাপাশি ঘন কুয়াশাও বেশ দাপট দেখিয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, এ বছর কুয়াশার কারণে দৃষ্টিসীমা ১০০ মিটারেও নেমে এসেছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মনোয়ার হোসেন জানান, কুয়াশার কারণে দৃষ্টিসীমা তিন হাজার মিটার বা তার কম হলে তাকে ‘পুওর ভিজিবিলিটি’ বলা হয়। সাধারণত বিমানবন্দরে দৃষ্টিসীমা কমে গেলে বিমান চলাচল ব্যাহত হয় বলেও জানান তিনি।
‘তিন হাজার মিটার বা তার নিচে এলেই আমরা এভিয়েশন ওয়ার্নিং দিই, দুই হাজার বা তার নিচে এলে তখন বিমান নামতেও পারে না’, বলেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘সোমবার সকালে বাংলাদেশে দৃষ্টিসীমা ১০০ মিটারে নেমে এসেছিল।’
এর আগের বছরগুলোতেও জানুয়ারি মাসে এ ধরনের ভিজিবিলিটি বা দৃষ্টিসীমা ছিল বলেও জানান আবহাওয়াবিদ মিস্টার হোসেন।
সোমবারের আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়, সারাদেশে মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা অব্যাহত থাকতে পারে।
নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা শবনম মোশফিকা অনি বলেন, অন্য বছরগুলোর তুলনায় এবছর শীতে বেশ ঘন কুয়াশা দেখেছেন তিনি। বিশেষ করে সকাল বেলা কুয়াশা বেশ ঘন থাকে বলে জানান তিনি।
‘এতো কুয়াশা থাকে যে এক হাত দূরের কিছু দেখা যায় না,’ বলেন তিনি।
কুয়াশা কীভাবে সৃষ্টি হয়?
আবহাওয়াবিদ মনোয়ার হোসেন বলেন, ‘কুয়াশাকে আমরা লো ক্লাউড বলি।’
শীতের সময় তাপমাত্রা কম থাকে এবং মাটিতে থাকা আদ্রতা উপরে উঠে গিয়ে কুয়াশা তৈরি করে।
এছাড়া ‘অ্যাডভেকশন ফগ’ বা মাটির তুলনায় বাতাস উষ্ণ এবং আদ্রতা বেশি থাকার কারণে যে কুয়াশা তৈরি হয়ে ভেসে বেড়ায়- এ ধরনের কুয়াশা ভারত থেকে বাতাসের তোড়ে বাংলাদেশে চলে আসে বলেও জানান এই আবহাওয়াবিদ।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ও আবহাওয়াবিদ মোহাম্মদ শাহ আলম বিবিসিকে বাংলাকে বলেন, কুয়াশা তৈরির পেছনে বাতাসের আদ্রতা ও তাপমাত্রার পার্থক্য দায়ী থাকে। তবে এবার রাতে তাপমাত্রা কমে যাওয়ার আগেই কুয়াশা তৈরি হয়ে যাচ্ছে। আর বাতাস কম থাকার কারণে কুয়াশা সরে যেতে পারছে না।
‘কুয়াশা আইসের (বরফের) একটা অংশ। এটা আমাদের দেশে ছোট থাকে, অন্যান্য দেশে তাপমাত্রা অনেক কমে যায় বলে সেটা বড় আকার ধারণ করে ঝড়ে পড়ে, যাকে স্নো বলে। আমাদের দেশে তাপমাত্রা কিছুটা বেশি থাকে বলে স্নো হয় না, তবে মাঝে মাঝে বৃষ্টির মতো ছোট ছোট ফোটা হয়ে ঝড়ে পড়ে,’ শাহ আলম বলেন।
বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকা এবং চীনেও কুয়াশা তৈরি হয়।
বাংলাদেশে ঘন কুয়াশার কারণ কী?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. হাফিজা খাতুন বলেন, পৌষ মাসে বা পৌষ মাসের শেষে কুয়াশা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে ঘন কুয়াশা তৈরির পেছনে কিছু কারণ রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘জলীয়বাষ্প ঘনীভূত হয়ে মেঘের মতো হয় কিন্তু নিচের মাটি ঠান্ডা থাকার কারণে এটি উপরে ওঠে না। এর সাথে যোগ হয় ধুলা এবং গাড়ির ধোঁয়া।’
ঢাকা দূষণের শহর হওয়ার কারণে এখানে ধুলা এবং ধোঁয়ার আধিক্য থাকে। যার কারণে কুয়াশাও ঘন হয়।
এক্ষেত্রে ভারতের রাজধানী দিল্লির উদাহরণ টেনে ড. হাফিজা খাতুন বলেন, ‘সেখানে ঘন কুয়াশার অন্যতম কারণ পরিবেশ দূষণ। আমাদের দেশেও বিশেষ করে ঢাকা শহরে একই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে।’
এছাড়া যেখানে তাপমাত্রার উঠানামা বেশি থাকে সেখানেই কুয়াশা তৈরির সুযোগ বেশি থাকে।
একই বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. নাজনীন আফরোজ হক বলেন, ‘দূষণ বেশি হলে কুয়াশাও বেশি হবে।’
এশিয়াতে বাংলাদেশ এবং ভারতে ঘন কুয়াশা বেশি হয়। পাকিস্তানে কুয়াশা হলেও ঘন কুয়াশা কম হয় বলে জানান তিনি।
কুয়াশা থাকলে কী হয়?
কুয়াশার কারণে সূর্যের কিরণ ঢুকতে না পারার কারণে তাপমাত্রা কম থাকে এবং শীত অনুভূত হয়। এছাড়া সূর্যের কিরণ গাছপালায় পৌঁছাতে না পারায় পাতায় সালোক-সংশ্লেষণের পরিমাণ কমে যায়। এতে একদিকে গাছের খাদ্য কম পরিমাণে তৈরি হয়ে এবং গাছ পুষ্টি কম পায়, অন্যদিকে একই কারণে অক্সিজেনের উৎপাদনও কমে যায়।
পরিবেশবিদ ড. হাফিজা খাতুন বলেন, ‘শীতে কুয়াশার কারণে রবি শস্যের উৎপাদন কমে যায়।’
‘পোকা-মাকড়ের ক্ষেত্রেও তাই। কারণ তাদেরও ইকোলজিক্যাল একটা ব্যাপার থাকে,’ তিনি বলেন।
এই পোকামাকড়ের কারণে শস্যে পরাগায়ন কমে যায়। আবার নানা ধরনের ক্ষতিকর পোকার আক্রমণেও ফসল কম হয়।
ধুলাবালি নিয়ন্ত্রণ করা গেলে, শিল্প-কারখানা ও যানবাহনের ধোঁয়া বাতাসে মিশতে না দিলে এবং নির্মাণ কাজ থেকে তৈরি হওয়া ধুলা নিয়ন্ত্রণ করা গেলে কুয়াশার ঘনত্ব কমিয়ে আনা সম্ভব বলেও মনে করেন তিনি।
Development by: webnewsdesign.com