শৈশবের স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরেই বেঁচে থাকে প্রতিটি মানুষের আত্মা। পরিপূর্ণ জীবনে হোক না সে ব্যারিস্টার কিংবা রাষ্ট্রপতি। কিন্তু শৈশবের স্মৃতির কাছে সে একজন খোকা। কোরমা-পোলাও খাওয়ার বাস্তবিক জীবনের থেকে শৈশবের কলার পাতায় পান্তা ভাত আর কাঁচা মরিচের স্বাদ মধুর থেকেও মধুরতর হয়ে থাকে। এ পৃথিবীতে যতো জ্ঞানী-গুণী কিংবা প্রতিষ্ঠিত যে কারোরই আত্মজীবনী পড়ে দেখুন। দেখবেন জীবনের প্রতিটি ক্ষণে তিনি তার শৈশবের নানা ঘটনাকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছেন। জীবনের নানাবিধ অভিজ্ঞতাকে তুচ্ছ জ্ঞান করে বারবার ফিরে যান তার শৈশবে। হোক না সে শৈশব কষ্টদায়ক কিংবা বিলাসিতার।
শৈশবের স্মৃতিহীন কোনো আত্মা বেঁচে থাকতে পারে না কখনো। শৈশবের স্মৃতির কথা মনে করতেই চোখের সামনে ভেসে আসে কতনা মধুর স্মৃতি। লুকোচুরি খেলা থেকে শুরু করে, গোল্লাছুট, চি-বুড়ি, কুতকুত, দাঁইড়ে খেলা, সাতধাপ্পা, চোর-পুলিশ খেলা, রাস্তা-পাকে খেলার মতো মজার সব খেলার স্মৃতি।
যুগের পরিক্রমায় কিংবা সময়ের আবর্তনে নয়তো মানুষের চিন্তা-চেতনার উন্নতি যে কারণরেই হোক না কেন নিজেদের অজান্তে আমরা হারিয়ে ফেলেছি অনেক মূল্যবান কিছু। আধুনিকতা আমাদের স্মৃতির পাতাকে অন্তসারশূন্য অবস্থায় নিয়ে ঠেকাতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে নিরলসভাবে। চলুন একটু পেছনে ফিরে দেখি। বেশি দূরে যাবো না। নব্বই দশকের ছেলে-মেয়েদের শৈশব ছিল সোনালী শৈশব। হাজারও প্রাকৃতিক সমারোহে আবৃত ছিল সে শৈশব। তখনকার সময়ে জন্ম নেওয়া প্রতিটি মানুষের কাছে শৈশবের গল্প মানেই সকাল সন্ধ্যায় দাদা-দাদির কোলে বসে নানা রকম মজার গল্প শোনা। বিকালে বাড়ির সামনে পড়ে থাকা জমিতে পাড়ার সব ছেলেমেয়েরা জড়ো হয়ে লুকোচুরি, গোল্লাছুট, চি-বুড়ি, কুতকুত, দাঁইড়ে খেলা, সাতধাপ্পা, চোর-পুলিশ খেলা, রাস্তা-পাকে খেলা। শীতের সকালে ঘুম থেকে উঠেই খেজুরগাছ থেকে গাছির রস পাড়ার দৃশ্য দেখতে ছুটে যাওয়া। আবার শিমুল ফুল কুড়াতে যাওয়া, ফটকল ফোটানোর জন্য। পাড়ার কারো কিংবা নিজেদের কুলগাছের কুল-বরই কুড়ানো। গরমের দিনে পাড়ার নামকরা মিষ্টি গাছের আম কুড়ানো। পাড়ার অন্য ছেলেমেয়েদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে কে আগে যেতে পারে। দুপুরে পাড়ার সব ছেলেমেয়েরা এক হয়ে নদীতে কিংবা পুকুরে লাফালাফি, ঝাঁপাঝাঁপি করা। মা, কিংবা বাবার তাড়া খেয়ে পানি থেকে উঠে বাড়ি দৌড়ানো। খেলার মাঠে গিয়ে ক্রিকেটের সময় ক্রিকেট খেলা, ফুটবলের সময় ফুটবল।
আধুকিতার এই যুগে আমাদের শিশুদের শৈশব বলে কিছু থাকছে না। ভালো রেজাল্ট আর শিক্ষিত এই দুই তকমা লাগানোর জন্য প্রতিটি অভিভাবকই এখন হন্যে প্রায়। আগে বলা হতো শিশুর বয়স হলে ছয়, ভর্তি কর বিদ্যালয়। আর এখন সেটা অনেকটা এমন যে ‘বাচ্চা যখন জন্ম নেয়, প্রাইভেট তার চালু হয়’। তিন বছরের শিশুর জন্যও সকাল-বিকাল দুই বেলা টিউটর রেখে দেওয়ার ঘটনা দেখায় যায়। এরপর সকালে প্রাইভেট। স্কুল শেষে বিকালে প্রাইভেট। স্কুলের কাজ, প্রাইভেটের কাজ এগুলো করতে করতে দিন শেষ। ছেলেমেয়েদের বিনোদন বলে কিছু নেই। নানা রকম সিলেবাস আর কারিকুলামের বেড়াজালে বিলীন হয়ে গেল রঙিন সেই শৈশব।
এরপর আধুনিকতার ছোঁয়া যখন আরও পেয়ে বসল তখন শিশুর শৈশব খেয়ে দিল মোবাইল ফোন। সকালে ঘুম থেকে উঠে চোখ মুছতে মুছতে গিয়ে আব্বু কিংবা আম্মুর ফোন ধরে। এরপর শুরু হয় গেম খেলা, নয়তো কার্টুন দেখা। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে বই রেখে ড্রেস না খুলেই বসে পড়ে ফোন নিয়ে। এটা তো গেল প্রাইমারি লেবেলের ছেলেমেয়েদের কথা। মাধ্যমিক পর্যায়ে পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের বেলায় এটা আরও ভয়ানক। এখন ক্লাস সেভেনে পড়া ছেলেমেয়েদেরও নিজস্ব টাচ ফোন থাকে। স্কুলে গিয়ে যখনই একটু সুযোগ হয় ফোন নিয়ে শুরু হয় গেমিং কিংবা ভিডিও দেখা। টিফিনে তো আছেই। ছুটি হলে অনেক ছেলে-মেয়ে বাড়িই ফেরে না। পথে বসেই শুরু করে দেয় গেমিং।
উন্নতির জোয়ারে গা ভাসিয়ে আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের শৈশবকে ডুবিয়ে দিচ্ছি আধুনিতার কড়াল গ্রাসে। আসুন আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের শৈশবকে প্রাকৃতিক ছোঁয়ায় ভরে তুলি। সুস্থ্য ও সুন্দর বিনোদনের আবহাওয়া বেড়ে ওঠার সুযোগ দিন। শৈশবের স্মৃতিতে আলোকিত হোক প্রতিটি সম্ভাবনাময় জীবন। ভালো থাকুক বাংলাদেশ।
Development by: webnewsdesign.com