সুনামগঞ্জে হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ নিয়ে শংকিত কৃষক

বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারি ২০২০ | ৬:৩৫ অপরাহ্ণ

সুনামগঞ্জে হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ নিয়ে শংকিত কৃষক
apps
হাওরের জেলা সুনামগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলার হাওরে চলতি বছরের বোরো ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মান কাজে ব্যাপক অনিয়ম ও অপ্রয়োজনীয় বরাদ্ধ দেয়ার বিস্তর অভিযোগ উঠেছে।
স্থানীয় অনেক কৃষকই জানিয়েছেন ‘গত বছররের  নিমার্ণ করা অনেক বাঁধ এবার অক্ষত থাকলে ও চলতি বছরে অনেক বাঁধে অপ্রয়োজনীয় বেশী বরাদ্ধ’ থাকায় জনমনে নানান প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। জেলার জামালগঞ্জের হাওরের বোরো ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মন কাজে বরাদ্দ ও পিআইসি গঠন নিয়ে অনিয়মসহ লিখিত অভিযোগ রয়েছে। অপ্রয়োজনীয় বরাদ্দের পাশাপাশি অযোগ্যদের দিয়ে পিআইসি গঠন করায় উপজেলা কাবিটা বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটি বির্তকিত হচ্ছে। সম্প্রতি জামালগঞ্জ উপজেলার হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মানে পিআইসি ও সাংবাদিকদের নিয়ে আলোচনা সভায় সুনামগঞ্জের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক ও জেলা হাওররক্ষা বাঁধ বাস্তবায়ন কমিটির কর্মকর্তা ও পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলীর উপস্থিতিতে উপজেলা চেয়ারম্যান বীরমুক্তিযোদ্ধা ইউসুফ আলা-আজাদ কোন কোন বাঁধে বেশী বরাদ্ধের অভিযোগ তুলেন। ‘গত বছর জামালগঞ্জে ৫৩ টি পিআইসি বরাদ্ধ ছিল ৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। চলতি বছর ১৬ টি বাড়িয়ে ৬৯ টি পিআইসির জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে প্রায় সাড়ে ৮ কোটি টাকা’। গেল বছর বাঁধ বিনষ্ট কিংবা শতভাগ মাটি সরে না গেলেও বরাদ্দ বৃদ্ধির বিষয়টিতে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে উপজেলা জুড়ে।
হাওরের কৃষকরা বলেছেন, এই পিআইসি বাণিজ্যে লাভবান হবে তারাই, যারা তালিকার বাইরে থেকেও পিআইসি নামধারী অকৃষিজীবী আর্থিক সামর্থহীন মানুষগুলোকে ব্যবহার করছে। গত ক’দিন পূর্বে জেলা প্রশাসক বরাবরে ৪০নং পিআইসির আওতাভূক্ত জামালগঞ্জ-সুনামগঞ্জ সড়কের নোয়াগাঁওয়ের খাল ও সুরমা তীরবর্তী উজ্জ্বলপুর-জামলাবাজ মধ্যস্থলের বাঁধের বিরোদ্ধে জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনার সিলেট বাবারে অভিযোগ দেন শাহ্ মো: আবুল কাশেম। অভিযোগরে পর সরেজমিন দেখা গেছে ছোট-ছোট ভাঙ্গার জন্য যে আজগুবি ভাবে ১৭ লাখ ৪৭ হাজার ৭৭৯ টাকা বরাদ্ধ দেওয়া হয়েছে তা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অপ্রয়োজনীয় বলে জানান স্থানীয়রা। সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের পেট ভরাতেই এমন বরাদ্দ দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষকরা। অপরদিকে অভিযুক্ত ৩৯নং পিআইসির আরো ৮ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে বলে উল্লেখ্য। এলাকার প্রবীন এক মোরব্বী বলেন, চাচা এই হানে অত টেহার বরাদ্ধ কিয়ের লাগি দিছে ? কোন দিন দেখিনাই খাল দিয়া হাওরে ফানি যাইতে। এই টেহা কই যাইবো আল্লাই জানে। ওয়ার্ড মেম্বার বাবুল মিয়া জানান এই ছোট-খাটো কাজের জন্য এত টাকা বরাদ্দ কেন দেওয়া হল বিষটি এলাকায় সমালোচনা চলছে। ভীমখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আক্তারুজ্জামান শাহ বলেন, এই বরাদ্ধটা একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। এর সামনে এলজিইডির পাকা রাস্তা আছে। হঠাৎ যদি বাঁধ দেওয়াই লাগে তাহলে এত টাকা বরাদ্দের কোন প্রয়োজন নেই। এছাড়াও উপজেলার পাকনা হাওরে ও হালির হাওরে বেশী বরাদ্ধের অনেক প্রকল্পই ঘাস না সরিয়েই নতি মালা না মেনে বাঁেধর কাজ করছেন। ক’জন বলেন রেজাউ সাব দেখছেন কোন সমস্য নাই, এভাবেই চলব।
 খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৪নং পিআইসি সভাপতি ছুরত জামানের অধীনে শনির হাওর উপ-প্রকল্পের জন্য যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি। ২৩ লাখ ৫৪ হাজার ৭২২ টাকায় বরাদ্দকৃত এই পিআইসি মূলত অন্য আরেক জনের। সেখানে তালিকাভূক্ত ছুরত জামানকে কেবল কাজের লোক হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এ রকম অবস্থা প্রায় অধিকাংশ পিআইসির। ৪নং পিআইসি সভাপতি ছুরত জামান বলেন, আপনার কি হইছে, যেরা বরাদ্দ দিছে হেরা জাইন্যাই দিছে। এইখানে কাজ করতে বেশী টেকা দরকার, হের জন্যই বরাদ্দের পরিমাণ বেশি দেওয়া হইছে, বুজ্জইনি। জানা যায়, হালির হাওর উপ-প্রকল্পের জন্য নির্ধারিত ৬০নং পিআইসি সভাপতি বেহেলী ইউনিয়নের দুর্গাপুর গ্রামের বাসিন্দা নিরঞ্জন রায় একজন ফেরিওয়ালা। গ্রামে গ্রামে ফেরি করে পণ্য বিক্রি করাই যার প্রধান পেশা। নাম মাত্র কৃষক এই অভাবী মানুষটিকেই পিআইসির সভাপতি করা হয়েছে। যার নুন আনতে পানতা ফুরোয় অবস্থা তাকে দেওয়া হয়েছে ২৪ লাখ ৫৪ হাজার টাকার বিশাল বরাদ্দ। পিআইসি তালিকায় নিতান্তই গরীব নিরঞ্জন রায়ের নাম দেখে তার গ্রামের অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। শুধু তাই নয়, এ রকম অনেক পিআইসি নিয়েই সমালোচনার শেষ নেই।
পিআইসি নিরঞ্জন রায়ের বিষয়টিতে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জানিয়েছেন, তাকে গ্রামের কেউ ৫শ’টাকা ধার দিতেও ভয় পায়। যার ২ হাজার টাকারও ক্ষমতা নাই, তাকে এত বড় প্রকল্পের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। যাদের পিআইসি বানানো হয়েছে, এদের প্রায় সবাই এ কাজ করার সামর্থ রাখে না। আসলে এদের ব্যবহার করে ফায়দা লুটার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে অভিযোগ অস্বীকার করে নিরঞ্জন রায় বলেন, ‘এই কাজডা আমারে দেওয়া হইছে, আমিই করতাছি। আমার সাথে কেউ সম্পৃক্ত নাই। ৬৬নং পিআইসির সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাঁধের ঘাস না সরিয়েই দেদারছে মাটি ফেলা হচ্ছে। মানা হচ্ছে না কোন নিয়মনীতি। অভিযুক্ত ৪০নং পিআইসি নিয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি প্রিয়াংকা পাল বলেন, ‘গত দুই বছর এখানে কাজ করা হয়েছে। এটা নতুন কোন প্রজেক্ট নয়। আর এই অংশটা পাউবোর আওতাভূক্ত।’ এছাড়া ৬০নং পিআইসির সভাপতিকে নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘তিনি কৃষক, হাওরে তার জমি আছে। কাজও প্রায় অর্ধেক শেষ করে ফেলেছেন তিনি। হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান ইউসুফ আল আজাদ বলেছেন, এ সম্পর্কে বলে আর কি হবে। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম একটা, রাতের আঁধারে ঘইটা গেল আরেকটা। এ রকম আরো আছে গত বছর যেটা ১০ লাখ এবার এটা ১৬ লাখ টাকা। বাঁধের মাটি কিন্ত আংশিক গেছে ।
 অপর দিকে, সুনামগঞ্জের ১৩ হাজার হেক্টর জমির শনির হাওরে ২০১৭ সালের ১৮ এপ্রিল অসময়ে নির্মিত হাওরটির লালুর গোয়ালা’র দুর্বল বাঁধ ভেঙে দেখতে দেখতে পুরো হাওর ডুবে যায়। লাখো কৃষক ওই দিন কান্নায় ভেঙে পড়েন। শনির হাওরে তাহিরপুর, জামালগঞ্জ ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার কৃষকদের জমি। লালুর গোয়ালার ক্লোজারে কাজই ধরেনি পিআইসি’র লোকজন। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা বলেছেন, বাঁশের কাজ শুরু হয়েছে, দ্রুতই বাঁধের মাটির কাজও শুরু হবে। জেলা হাওররক্ষা বাঁধ বান্তবায়ন কমিটির কর্মকর্তা ও স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক মো. এমরান হোসেন বলেছেন, লালুর গোয়ালাসহ গুরুত্বপূর্ণ বাঁধে আজ মাটির কাজ শুরু না হলে, কাল থেকে নতুন পিআইস গঠন করে কাজ শুরু হবে। শনির হাওরের এই ক্লোজারটি তাহিরপুর-জামালগঞ্জ-ধর্মপাশা ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার জন্য বিপজ্জনক। এখানে এখন পর্যন্ত কাজ শুরু না হওয়ায় উৎকণ্ঠায় আছেন কৃষকরা। জামালগঞ্জের দায়িত্বপ্রাপ্ত পাউবোর উপ-সহকারী প্রকৌশলী রেজাউল কবীর বলেন, লালুর ঘোয়ালায় বাঁশ পুতা শুরু হয়েছে। মাটির কাজ দুয়েক দিনের মধ্যে শুরু হবে। তবে উপ-সহকারী প্রকৌশলী রেজাউল কবীরের প্রতিও অন্তহীন অভিযোগ। তিনি স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের তথ্য ও তালিকা দিয়ে সহযোগীতা করছেননা মর্মেও অভিযোগ রয়েছে।
জামালগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রিয়াংকা পাল বললেন, শনির হাওরের লালুর ঘোয়ালা দুই উপজেলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্লোজার। আমরা এটি দ্রুত করার জন্য বলে দিয়েছি। পানি নামতে বিলম্ব হওয়ায় ওখানে বাঁধের কাজ শুরু করতে বিলম্ব হচ্ছিল। দুই এক দিনের মধ্যে ক্লোজারে মাটি ভরাট শুরু হবে। শনির হাওরের লালুর ঘোয়ালা কেবল নয়। জামালগঞ্জ, তাহিরপুর, ধর্মপাশা, বিশ্বম্ভরপুর মাটিয়ানী হাওরের তলানীর উপজেলাগুলোর অনেক বড় বড় ক্লোজারে এ রির্পোট লিখা পর্যন্ত কাজই শুরু হয়নি।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সাবিবুর রহমান বললেন, ১৩৫ টি ক্লোজারের মধ্যে ৬৩ টিতে কাজ শুরু হয়েছে। তাহিরপুরের শনির হাওর ও মাটিয়ান হাওরে মঙ্গলবার গিয়ে আমাদেরও খারাপ লেগেছে। আমরা জানিয়ে দিয়েছি আজ বুধবারের মধ্যে যেসব বাঁধে পিআইসি’রা কাজ শুরু করবেন না, তাদের পিআইসি বাতিল করা হবে। নতুন করে পিআইসি গঠন করে কাজ করা হবে।
জেলা হাওররক্ষা বাঁধ বাস্তবায়ন কমিটির কর্মকর্তা ও স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক মো. এমরান হোসেন বলেন, আজ-কালের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বাঁধগুলোতে কাজ শুরু না হলে সংশ্লিষ্ট পিআইসি বাতিল করা হবে বলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানিয়ে দেওয়া হবে। যারা কাজ শুরু করতে পারবে, তাদের দিয়ে নতুন পিআইসি গঠন করে কাজ করানো হবে।

Development by: webnewsdesign.com