রোমহর্ষক নির্যাতনের নায়ক সেই নাজমুল মামলা আপোষের জন্য চাপ দিচ্ছে!

বুধবার, ১৪ অক্টোবর ২০২০ | ৬:৩৬ অপরাহ্ণ

রোমহর্ষক নির্যাতনের নায়ক সেই নাজমুল মামলা আপোষের জন্য চাপ দিচ্ছে!
apps

ঘটনার দুই বছর পেরিয়ে গেছে। আলোচিত মামলার বিচারকাজ শেষের দিকে। কুষ্টিয়ায় প্রেমের ফাদেঁ ফেলে কলেজ ছাত্রী হিন্দু নারীকে ভূয়া কাবিনে বিয়ে করা, ঘুমের ওষুধ খাইয়ে নগ্ন ছবি তোলা, অশ্লীল সেই ছবি ছড়িয়ে দেওয়া এবং মাথার চুল কেটে তাকে হত্যা করার চেষ্টা করা রোমহর্ষক নির্যাতনের নায়ক সেই নাজমুল মামলা আপোষের জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছে। নির্যাতনের শিকার ওই নারী জানান, মামরার স্বাক্ষী শেষ পর্যায়ে। করোনার কারনে বেশকিছুদিন বিচার কাজ বন্ধ ছিল। এখন আবার স্বাক্ষগ্রহন শুরু হয়েছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার স্বাক্ষী হলেই অল্পদিনের মধ্যেই রায় হবে। যেহেতু স্বাক্ষীরা সঠিক স্বাক্ষ্য দিয়েছে, রায় নিজের বিপক্ষে যাবে বলে নাজমুল আপোষের জন্য চাপ দিচ্ছে। প্রায় স্থানীয়রা কেউ কেউ বাড়ীতে আসে। বর্তমানে জামিনে থাকা আসামী নাজমুলের পক্ষে মামলা আপোষ করতে বলেন। চাপও দেন। আমি সাফ জানিয়ে দিয়েছি, আমার সাথে যা ঘটেছে তা ভোলার নয়। এ ঘটনায় কোন আপোষ করা হবে না। আদালত যে সিদ্ধান্ত শোনাবে তাই মাথা পেতে নেব। তিনি বলেন এইসব অপরাধীরা পার পেয়ে গেলে এ ধরনের অপরাধ আরো বাড়বে। আর কোন নারীর সাথে এরকমটা হোক তা কখনই কাম্য নয়।

ঘটনার প্রকাশ, ২০১৮ সালের ১ অক্টোবর। আগেরদিন ওই নারী পর্নগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১২-এর ৮ ধারায় কুষ্টিয়া মডেল থানায় একটি মামলা করেন। পরদিন ১ অক্টোবর সোমবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে কুষ্টিয়া মডেল থানা পুলিশ শহরের পাঁচ রাস্তার মোড় শাপলা চত্বর এলাকা থেকে আসামী নাজমুলকে গ্রেফতার করে। ওইসময় এই ঘটনা নিয়ে সারাদেশে তোলপাড় শুরু হয়। ওই নারী সংখ্যালঘু হওয়ায় বিশেষ করে সংখ্যালঘু হিন্দু কমিউনিটির লোকজন প্রতিবাদে ফেটে পড়ে।

প্রেমের ফাদেঁ ফেলে কলেজ ছাত্রী হিন্দু নারীকে ধর্মান্তরিত করে ভূয়া কাবিনে বিয়ে করে নাজমুল। এখানেই শেষ নয়, ওই নারীকে তার চুল কেটে দেওয়াসহ অশ্লীল ছবি ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকিতে ব্লাকমেইল করছিল স্বামী নাজমূল। পরে নাজমুল ওই নারীর মাথার চুল কাটার ও অশ্লীল ছবি ছড়িয়ে দেয়। ওই নারীর (স্ত্রীর) ফেইসবুকের ম্যাসেঞ্জারের মাধ্যমে তার নিকটজনদের কাছে নগ্ন ছবি ও ভিডিও পাঠানো হয়। এছাড়াও ওই নারীকে কৌশলে হত্যা করার চেষ্টা করে নাজমুল।

পুলিশ অভিযুক্ত নাজমুলকে গ্রেফতার করলে সে ওই নারীর উপর নির্যাতনের রোমহর্ষক বর্ননা দেন। ওই সময় তৎকালিন কুষ্টিয়া মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাসির উদ্দিন সাংবাদিকদের জানান, গ্রেফতারের পর রাতে নাজমুল পুলিশের কাছে স্ত্রীর উপর নির্যাতনের রোমহর্ষক বর্ননা দেন। জিজ্ঞাসাবাদে নাজমুল জানায়, স্ত্রীকে ব্ল্যাকমেইল করে নিজের দখলে রাখতে গোপন ক্যামেরায় তার নগ্ন ছবি ও ভিডিও ধারণ করি। এসব নগ্ন ছবি ও ভিডিওর ভয় দেখিয়ে আজীবন তাকে বাধ্য করে রাখতে চেয়েছি।

পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী গোপন ক্যামেরায় ওই নারীর নগ্ন ছবি ও গোসলের ভিডিও ধারণ করে নাজমুল। এমনকি দুইজনের শারীরিক সম্পর্কের ছবি ও ভিডিও ধারণ করে নিজের কাছে রেখে দেয়। ঘুমের ওষুধ খাইয়ে নারীর নগ্ন ছবি এবং ভিডিও ধারণ করতো নাজমুল। এসব নগ্ন ছবি ও ভিডিওর ভয় দেখিয়ে মেয়েটিকে নির্যাতন করত নাজমুল।

বাগে আনতে না পেরে শেষপর্যন্ত চরিত্রহীন হিসেবে প্রমাণ করার জন্য মেয়েটিকে মারপিট করে মাথার চুল কেটে দেয়। ভয়ভীতি এবং হুমকি-ধমকি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে ওই মেয়ের নগ্ন ছবি ও ভিডিও ফেসবুকে ছেড়ে দেয় নাজমুল। নিজেকে ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখতে মেয়েটির মোবাইল ছিনিয়ে নিয়ে তার ফেসবুকের পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করে ফেলে। ওই ফেসবুক থেকে মেয়েটির আত্মীয়-স্বজনদের ফেসবুকে নগ্ন ছবি ও ভিডিও পাঠায় নাজমুল।

গ্রেফতারের পর নাজমুলের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ছিনিয়ে নেয়া স্ত্রীর মোবাইল ও নাজমুলের ব্যক্তিগত মোবাইল জব্দ করে পুলিশ। যে মোবাইল দিয়ে স্ত্রীর ফেসবুক আইডি থেকে নগ্ন ছবি ও ভিডিও বিভিন্নজনের ফেসবুকে পাঠানো হতো সেই মোবাইলটিও উদ্ধার করতে সক্ষম হয় পুলিশ।

নাজমুল ভয়ঙ্কর প্রতারক। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে নাজমুল জানিয়েছিল, ওই মেয়ে সুন্দরী হওয়ায় নিজেকে হিন্দু এবং অবিবাহিত পরিচয় দিয়ে প্রেমের ফাঁদে ফেলে। একপর্যায়ে মেয়েটিকে ধর্মান্তরিত করে বিয়েতে বাধ্য করে। ভূয়া কাবিন করে ঘরে স্ত্রী-দুইসন্তান থাকায় অন্যত্র বাসা ভাড়া নিয়ে ওই মেয়ের সঙ্গে সংসার করে নাজমুল।

২০১৮ সালের ১ অক্টোবর ভুক্তভোগী নারী মামলায় উল্লেখ করেন, প্রায় চার বছর আগে কুষ্টিয়া সরকারি মহিলা কলেজে যাওয়া-আসার পথে পৌর এলাকার জুগিয়া হাট পাড়ার রফিকুল ইসলামের ছেলে নাজমুল হোসেন আমাকে প্রায়ই উত্ত্যক্ত করত। অনেক বকাঝকা করেছি কিন্তু সে আমার পিছু ছাড়েনি। একপর্যায়ে নাজমুলের সঙ্গে আমার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ২০১৫ সালের ২৪ নভেম্বর নাজমুল আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে কুষ্টিয়া সদর উপজেলার বটতৈল এলাকার স্থানীয় এক কাজির কাছে নিয়ে যায়। এ সময় নাজমুল আমাকে বলে, আমি মুসলমান তোমাকেও মুসলমান হতে হবে। মুসলমান পরিচয় জানতে পেরে নাজমুলকে বিয়ে করতে এবং ধর্মান্তরিত হতে অস্বীকৃতি জানাই আমি।

এ সময় নাজমুল এবং তার সঙ্গে থাকা অজ্ঞাত তিন-চারজন আমাকে ভয়ভীতি দেখিয়ে জোরপূর্বক দুটি স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করিয়ে নেয় এবং নোটারি পাবলিক দিয়ে মুসলমান হিসেবে হলফনামা আদায়ের পর বিয়ে সম্পন্ন করে। বিয়ের কাবিননামায় আমার বাবার নাম সুজন রাজবংশী পাল্টে লেখা হয় শেখ ইমতিয়াজ আলী এবং মায়ের নাম মালা রাজবংশীর পরিবর্তে লেখা হয় আফরোজা বেগম মালা।

এক পর্যায়ে তার অত্যাচারে বাধ্য হয়ে বিয়ে মেনে নিয়ে সংসার শুরু করি। শহরের ছয় রাস্তার মোড়ের পাশে এবং জেলখানা মোড়ে বাসা ভাড়া নিয়ে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বসবাস করতে থাকি আমরা। কিন্তু বিয়ের এক বছর পর আমি জানতে পারি নাজমুল বিবাহিত, তার দুটি সন্তান রয়েছে। সেই সঙ্গে ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত সে। এসব বিষয়ে নাজমুলকে জিজ্ঞাসা করলে শুরু হয় আমার ওপর নির্যাতন। শারীরিক নির্যাতনের মাত্রা চরমে পৌঁছালে বাবার বাড়ি চলে আসতে বাধ্য হই।

২০১৮ সালের ২৬ জুন বেলা ১১টার দিকে নাজমুল মোটরসাইকেল নিয়ে আমাদের বাড়ি আসে। এ সময় নিজের ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চায় সে। পরে বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার বহলবাড়ীয়া সাতবাড়ীয়া মাঠের মধ্যে নিয়ে আমাকে মারধর শুরু করে। একপর্যায়ে আমার মাথার চুল কেটে দেয়। একই সঙ্গে আমার মোবাইল ছিনিয়ে নেয়। আমার চিৎকার শুনে স্থানীয়রা এগিয়ে এলে নাজমুল পালিয়ে যায়। খবর পেয়ে পরিবারের লোকজন আমাকে উদ্ধার করে বাড়ি নিয়ে আসে।

এ ঘটনার পর থেকে আমি ও আমার পরিবারকে হুমকি দিচ্ছিল নাজমুল। কোনো ধরনের আইনের আশ্রয় নিলে খবর আছে বলেও হুমকি দেয়। ঘটনার কয়েকদিন পর আমার আত্মীয়-স্বজনসহ পরিচিতজনদের ফেসবুকে তার সঙ্গে আমার অন্তরঙ্গ ছবি ও ভিডিও পাঠায়। সেই সঙ্গে অনেক নগ্ন ছবি ও ভিডিও ফেসবুকে ছেড়ে দেয়।

এখন মামলার বিচারকাজ শেষের দিকে এসেও মামলা আপোষ করতে নাজমুল হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি তিনি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই সুমনের কাছেও জানিয়েছেন। এসআই সুমন বলেন, করোনার কারনে বিচার কাজ বন্ধ থাকায় বেশকিছুদিন হলো যোগাযোগ নেই। তবে করোনার আগের সময়ে ওই নারী নাজমুল মামলা আপোষ করতে হুমকি দিচ্ছিল বলে জানিয়েছিল। মামলার অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রায় সব স্বাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহন হয়ে গেছে। করোনার কারনে বিচারকাজ ৬মাসের বেশি সময় ধরে বন্ধ ছিল। এখন আবার শুরু হয়েছে। তিনি বলেন তার স্বাক্ষ্যগ্রহন বাকী আছে। এটি হবার পর আনুমানিক তিন মাসের মধ্যে মামলার রায় হতে পারে। স্বাক্ষীরা যে স্বাক্ষ্যপ্রদান করেছে তার সব ডকুমেন্ট আদালতে প্রদান করা হয়েছে। আদালতে সঠিক বিচার পাবেন ভূক্তভোগী নারী এমনটাই প্রত্যাশা সচেতন মহলের।

Development by: webnewsdesign.com