নড়াইলে বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনের জন্য কীটনাশকের ব্যবহারের পরিবর্তে দিগন্ত বিস্তৃত সবজির ক্ষেতগুলোতে দেখা মিলছে এক নতুন ধরনের ফাঁদ। এটির নাম ‘সেক্সফেরোমোন’ ফাঁদ হলেও স্থানীয়ভাবে এটিকে ‘জামাই ফাঁদ’ হিসেবেই ডাকা হয়। এই ফাঁদে ফেলে স্ত্রী পোকার প্রলোভন দেখিয়ে পুরুষ বা জামাই পোকাকে ফাঁদে ফেলে মারা হয় বলে স্থানীয় ভাষায় এটিকে ‘জামাই মারার ফাঁদ’ বলে থাকেন। কৃষকরা শাকসবজি ও ফসলাদির কীটপতঙ্গ দমনে কীটনাশক প্রয়োগের বদলে ‘জামাই ফাঁদ’ ব্যবহারে উৎসাহী হয়ে উঠছেন। কীটনাশক ব্যবহারের চেয়ে তুলনামূলক সাশ্রয়ী হওয়ায় এটির জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। ফলে ফসলের ক্ষেতে বিষ প্রয়োগ কমে আসায় স্বাস্থ্যঝুঁকির মাত্রাও কমছে। জেলার তিনটি উপজেলায় ‘জামাই ফাঁদের’ ব্যবহার ক্রমাগত বাড়লেও জেলা কৃষি বিভাগের কাছে সেটির সমন্বিত কোনো পরিসংখ্যান নেই। ফাঁদপাতার জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগ পৃষ্ঠপোষকতা দিলে এটির ব্যবহার আরও অনেকটা বৃদ্ধি পেত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কৃষকরা বলছেন, প্রথমবারের মতো এই পদ্ধতিতে সবজি চাষ করে ভালো ফলন পাচ্ছেন তারা। এই ফাঁদ ব্যবহারে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ায় গুণগত মান বজায় থাকছে সবজির। বিষমুক্ত হওয়ায় বাজারে এসব সবজির দামও ভালো পাচ্ছেন তারা। সরেজমিন দেখা যায়, ফসলের মাঠে লাউ, কুমড়া, কপি, পটল, বেগুন, ঝিঙা, করলা ও উচ্ছেসহ রকমারি সবজি ক্ষেতে বাঁশের খুঁটিতে প্লাস্টিকের নানা আকৃতির ছোট-বড় বোতল ও পাত্র চোখে পড়ছে। এই বোতলের ভেতরই রাখা হচ্ছে বিনা কীটনাশকে পোকামাকড় মারার এক ধরনের ‘জাদুর তাবিজ’। বাঁশের খুঁটিতে ঝোলানো এসব প্লাস্টিকের বোতলের ভেতর চিকন তারের সঙ্গে ঝুলতে থাকে একটি চারকোণা তাবিজাকৃতির একটি কাঠের টুকরো। কাঠের টুকরোটিকে ‘লিউর’ বলা হয়। এতে পুরুষ পোকাকে আকৃষ্ট করার জন্য স্ত্রী পোকা থেকে নিঃসৃত এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ (স্ত্রী পোকার গন্ধ) ব্যবহার করা হয়, যেটি ‘সেক্সফেরোমোন’ নামে পরিচিত। আর এই ফাঁদ পাততে প্লাস্টিকের বোতলের দু’পাশে ত্রিকোণাকৃতি ফাঁক থাকে। ফাঁদে ব্যবহৃত লিউর স্ত্রী পোকার নিঃসৃত গন্ধকে কৃত্রিমভাবে ১০০ গুণ বৃদ্ধি করে দেওয়া হয়। যাতে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ পোকা পাত্রের ভেতরে বা আশপাশে স্ত্রী পোকা আছে ভেবে খুঁজতে থাকে। পুরুষ পোকা গন্ধ পেয়ে যখন লিউরের কাছে আসে তখন এটির ভেতরে গিয়ে স্ত্রী পোকাকে না পেয়ে ছটছট করতে থাকে। একপর্যায়ে পুরুষ পোকা পাত্রের নিচে থাকা সাবান পানিতে পড়ে পড়ে মারা যায়। জেলার সদর উপজেলার গোবরা, আগদিয়া, বিছালী, দুর্গাপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় মৎস্য ঘেরের পাড়ে, বসতবাড়ির আঙিনাসহ, পতিত ও উঁচু জমিতে ‘জামাই ফাঁদ’ পেতে বিষমুক্ত সবজির আবাদ হচ্ছে। সরেজমিন নড়াইল সদরের সিঙ্গাশোলপুর ইউনিয়নের গোবরা মাঠে দেখা যায়, সেখানে সবজি চাষিরা পোকামাকড় দমনে ‘জামাই ফাঁদ’ ব্যবহার করছেন। ক্ষেতজুড়ে ঝুলিয়ে রাখা আছে প্লাস্টিকের বোতল ও ছোট ছোট প্লাস্টিকের বয়াম। কাছে গিয়ে দেখা যায়, এগুলো ক্ষতিকর পোকা দমনের ‘জামাই ফাঁদ’। গোবরা গ্রামের সবজি চাষী হোসেন মোল্যা জানান, এ বছর তিনি এক একর পাঁচ শতক জমিতে ‘সেক্সফেরোমোন’ বা ‘জাদুর ফাঁদ’ ব্যবহার করে সবজি চাষ করেছেন। এতে কম খরচে বেশি ফসল উৎপাদন করা যাচ্ছে। বাজারে বিষমুক্ত পদ্ধতিতে চাষ করা এই সবজির চাহিদা বেশি হওয়ায় দামও বেশি পাওয়া যাচ্ছে। এ পদ্ধতিতে কীটনাশক খরচ কম হওয়ায় উৎপাদন খরচও কম। তার সফলতায় অনেক কৃষক এই পদ্ধতিতে সবজি চাষ করতে আগ্রহী হচ্ছেন বলে তিনি জানান। ওই মাঠের আরেক কৃষক ইবাদুল মোল্যা জানান, ঝিঙে ক্ষেতের পাশাপাশি এ বছর তিনি লাউ ক্ষেতেও বিনা বিষ প্রয়োগে পরীক্ষামূলকভাবে ‘জামাই ফাঁদ’ বসিয়ে উপকৃত হয়েছেন। আগে সবজি ক্ষেতে কীটনাশক স্প্রে করতেন তিনি। পরবর্তীতে যখন পরিবেশ বান্ধব পদ্ধতিতে কীটপতঙ্গ দমনে ‘জামাই ফাঁদ’ সম্পর্কে জানতে পারেন, তখন থেকেই সেটির ব্যবহার শুরু করেন। স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেগুন, কুমড়া জাতীয় সবজি করলা, শসা, মিষ্টি কুমড়া, চাল কুমড়া, লাউ, ঝিঙে, পটল, চিচিংগা, কাকরোল, উচ্ছে, তরমুজ, ফুলকপি, বাধাকপি, খিরা, বাঙ্গি ও তরমুজ ইত্যাদি ফসলের জন্য ‘জামাই ফাঁদ’ পদ্ধতি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এভাবে বিষমুক্ত সবজি চাষে ‘জামাই ফাঁদ’ ব্যবহার করে নড়াইলের শত শত কৃষক সাফল্য পেয়েছেন। ফলে নড়াইলে নিরাপদ সবজি চাষের আবাদ বাড়ছে। নড়াইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর কার্যালয়ের উপ-পরিচালক দীপক কুমার রায় বলেন, জামাই ফাঁদের ভেতরে ‘সেক্সফেরোমোন’ নামক স্ত্রী পোকার গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে বা আশপাশে স্ত্রী পোকা আছে এমনটা ভেবে জামাই বা পুরুষ পোকা খুঁজতে থাকে। জামাই পোকা গন্ধ পেয়ে লিউরের কাছে এসে ছটফট করতে করতে ফাঁদের নিচে থাকে।