সাইফুল ইসলাম। দাউদকান্দি গৌরীপুর ইউনিয়ন শ্রমিক দলের সদস্য। করতেন মৎস্য খামার ও বালুর ব্যবসা। বছর দেড়েক আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তাকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে তুলে নিয়ে যায়। তাও দিনদুপুরে, ব্যস্ত সড়কে শত শত লোকের সামনে থেকে। ঘটনার তিন মাস পর শোকাগ্রস্ত পরিবারটির কাছে সাইফুলের চোখ ও হাত বাঁধা ছবি পাঠায় অপহরণকারীরা। এরপর শুরু করে রফাদফা। ১৫ লাখ টাকায় মুক্তিপণের চুক্তি হয়।
চুক্তির ৫ লাখ টাকা অগ্রিম দেয়া হয় স্থানীয় মানিক নামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে। প্রমাণস্বরূপ ব্যাংকের একটি চেকও দেয় তারা। কিন্তু টাকা দিয়েও পরিবারের সদস্যরা আজও ফেরত পায়নি সাইফুলকে। সাইফুলের পরিবারের সদস্যরা সাংবাদিকদের কাছে বর্ণনা করেছেন দুঃসহ ঘটনার আদ্যোপান্ত।
সাইফুল নিখোঁজের ঘটনায় করা হয় থানায় জিডি। আদালতে দায়ের করা হয় অপহরণ মামলা। মামলার তদন্তভার দেয়া হয় পিবিআইকে। তদন্তও করেন পিবিআই কর্মকর্তা। মেলেনি কোনো আশার বাণী। বাধ্য হয়ে রাস্তায় দাঁড়ান স্বজনরা। মানববন্ধনে সাইফুলকে ফিরিয়ে দেয়ার আকুতি জানান। স্বামীকে ফিরে পেতে প্রধানমন্ত্রীর সহায়তা চেয়ে ফেসবুকে লাইভও করেন স্ত্রী ফাতেমা ইসলাম।
শ্রমিক দলের সদস্য হলেও সাইফুল সক্রিয় রাজনীতি করতেন না। ব্যবসা নিয়েই সারাদিন ব্যস্ত থাকতেন। তারপরও কেন তুলে নেয়া হলো তাকে এর কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না স্বজনরা। সাইফুলের এই নির্মমতার খবর সেভাবে আসেনি মিডিয়ায়। নাম ওঠেনি কোনো তালিকায়ও।
সাইফুল নিখোঁজের বর্ণনা তুলে ধরে বড় ভাই জহিরুল ইসলাম বলেন, আমাদের চার ভাই, চার বোনের মধ্যে সবার ছোট সাইফুল। কনফেকশনারি দোকান, রেন্ট-এ কার, মৎস্য খামার ও বালুর ব্যবসা করতো সে। ২০২০ সালের ২৪শে সেপ্টেম্বর। বেলা ২টা ৪০ মিনিট। সাইফুলের বন্ধু মফিজ আমাকে ফোন দেন। বলেন, আপনার ভাইকে আইনের লোক পরিচয় দিয়ে ধরে নিয়ে গেছে। তাদের হাতে হ্যান্ডকাফ ও সবার কোমরে পিস্তল ও ওয়াকিটকি ছিল। খবরটি শুনে দৌড়ে ঘটনাস্থল গৌরিপুর স্টেশন রোড মোড়ে যাই। কথা বলি প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে। তারা জানান, সাইফুল একটি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন। এ সময় একটি কালো রঙের হাইয়েস এসে থামে তার সামনে। গাড়ি থেকে সাদা পোশাকে ৪-৫ জন লোক নেমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দেয়। সবার কাছেই ছিল পিস্তল। কিছু বলার আগেই সাইফুলকে প্রথমে হ্যান্ডকাফ পরায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় পেয়ে উপস্থিত জনতা দূরে সরে যায়। এরপর জোরপূর্বক সাইফুলকে গাড়িতে তুলে দ্রুত দাউদকান্দির দিকে চলে যায়।
সঙ্গে সঙ্গেই সাইফুলের খোঁজে ছুটে যাই থানায়। তৎকালীন দাউদকান্দি থানার ওসিকে বিষয়টি জিজ্ঞেস করতেই তিনি রেগে যান। ওসিকে বলি, স্যার আপনার কাছে তো বিকালে আসার কথা ছিল সাইফুলের। কিন্তু তার আগেই তো ঘটনা ঘটে গেছে। একপর্যায়ে ওসি আমাকে সান্ত্বনা দেন। পরদিন সকালে ফের ওসির কাছে যাই। তখন তিনি আমাকে বলেন, কি নিউজ দিবো, আমি তো কোনো তথ্য নিতে পারিনি। পরে বাধ্য হয়ে দাউদকান্দি থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করি। কুমিল্লা ডিবি,র ্যাব কার্যালয় ও জেলখানায় সন্ধান করি। কোথাও মেলেনি সন্ধান। এভাবে কেটে যায় আরও কয়েকদিন। ঘটনার সপ্তাহখানেক পর স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যানের বাসায় যাই। তখন চেয়ারম্যান বলেন, এ বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না।
জহির বলেন, মাসখানেক পর প্রথমে থানায় মামলা করতে গেলে ওসি মামলা নিতে রাজি হননি। উপায় না পেয়ে কুমিল্লা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ছয়জনকে আসামি করে একটি অপহরণ মামলা করি। মামলার আসামিরা হলেন, স্থানীয় যুবলীগ নেতা ও মনির চেয়ারম্যান হত্যা মামলার প্রধান আসামি জায়েদ আহমেদ জুলহাস, মোরশেদ, বাবুল, সালাউদ্দিন, আফজাল ও হাসান মিয়া। মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় পিবিআইকে। তদন্ত কর্মকর্তারা সরজমিন এসে তদন্ত করেন। ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেন। ফুটেজে দেখা যায়, একটি কালো রঙের গাড়ি দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করছে। তখন ওই স্থানে মামলার আসামিরা তুলে নেয়ার আগে থেকেই সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরা করছিল। গাড়িটি চলে যাওয়ার পর একে অপরের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করছে। ভিডিও ফুটেজের আলামতের ভিত্তিতে কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদও করেন পিবিআই কর্মকর্তারা।
ওদিকে সাইফুল নিখোঁজ হওয়ার পরদিন থেকে মানিক নামে স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা পরিচয় দানকারী নিজে থেকেই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি আমাদের বলেন, আপনারা চিন্তা কইরেন না, আমার এক ভাইয়ের মাধ্যমে খোঁজ নিয়েছি। সাইফুল ভালো আছে। মাস তিনেক পর মানিক আমাদের বলেন, আমি খবর নিয়েছি, সাইফুল জীবিত আছে। কিন্তু ফেরত পেতে হলে টাকা লাগবে। কয়েকদিন পর সাইফুলের একটি ছবি আমাদেরকে দেয় মানিক। ছবিতে দেখা যায়, একটি বদ্ধ রুমে স্যাঁতসেঁতে মেঝেতে সাইফুলের পিছমোড়া করে হাত বাঁধা ও চোখ বাঁধা। পাশে রাখা একটি পানির বোতল। তুলে নেয়ার সময় গায়ে যে জামা পরা সেগুলোই রয়েছে সাইফুলের গায়ে। ছবি দেখে আমার বিশ্বাস হয় সাইফুল জীবিত আছে।
একপর্যায়ে সাইফুলকে জীবিত ফিরে পেতে মুক্তিপণ হিসেবে ২০ লাখ টাকা চায় মানিক। তার সঙ্গে টাকার অঙ্ক নিয়ে শুরু হয় দেনদরবার। শেষ পর্যন্ত ১৫ লাখ টাকায় রফা হয়। তিন কিস্তিতে টাকা দিতে হবে। প্রথম কিস্তিতে অগ্রিম দিতে হবে পাঁচ লাখ। দ্বিতীয় কিস্তিতে কোনো একটি মামলা দিয়ে থানায় সাইফুলকে আটক দেখানোর পর পাঁচ লাখ। মুক্তি পাওয়ার পর পাঁচ লাখ। চুক্তি মোতাবেক অগ্রিম ৫ লাখ টাকা ক্যাশ দেই মানিককে। ৫ লাখ টাকার বিপরীতে মানিক দুটি ব্যাংক চেক দেয়। একটি চেক ছিল ব্ল্যাঙ্ক (Dutch-Bangla Bank, MD HAZRAT ALI MOLLAH, a/c no- 136.151.85430), আরেকটিতে পাঁচ লাখ টাকার পরিমাণ উল্লেখ ছিল (prime Bank, RIDOY INTERNATIONAL, a/c no-204110030004291, IBRAHIMPUR BRANCH)। টাকার লেনদেন হয় ঢাকায় রায়েরবাগে। এ সময় মানিকের সঙ্গে তার নানা সম্বোধনকারী রিপন উপস্থিত ছিল। তিনদিনের সময় নিয়েছিল তারা। কিন্তু তিনদিন পেরিয়ে আজ দেড় বছর। আজও আমার ভাইকে ফিরিয়ে দেয়নি। আজ দিচ্ছি, কাল দিচ্ছি বলে ঘুরাচ্ছে।
সর্বশেষ গত এক মাস আগে মানিকের সঙ্গে দেখা হয়। তিনি আমাদের আশ্বাস দেন, আপনার ভাই জীবিত আছেন। বরিশালে আছেন। তখন মানিককে বলি, আপনারা আমার ভাইকেও দিচ্ছেন না, টাকাও দিচ্ছেন না। আমাদের টাকাগুলো ফেরত দিয়ে দেন। তখন মানিক বলেন, আমি টাকাটা নানা রিপনের কাছ থেকে উদ্ধার করে দেবো। এখন মানিক ফোনও ধরছেন না।
মুক্তিপণের রফাদফা করা সাইফুলের ভগ্নিপতি জয়নাল আবেদিন বলেন, সাইফুল নিখোঁজের পরদিন মানিক নামে যে যুবকটি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার আসল নাম হযরত আলী। বাড়ি দাউদকান্দির তালেরচর গ্রামে।
ঘটনার তিন মাস পর মানিক আমাদের মাদারীপুরে একটি আইশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যালয়ে নিয়ে যায়। সেখানে এক কর্মকর্তার সঙ্গে পরিচয় করান। ওই ভবনের দক্ষিণ দিকে কয়েক কিলোমিটার দূরের একটি বিল্ডিংয়ে সাইফুলকে রাখা হয়েছে বলে জানানো হয়। কিন্তু ওই কর্মকর্তাকে ওইদিনই ঢাকায় বদলি করা হয়। ওই কর্মকর্তা বলেন, দুঃখিত, ভাই আমি আর কিছু করতে পারলাম না। আমার বদলির অর্ডার হয়ে গেছে। তবে আমার নামটা কাউকে বলবেন না। আমার বউ-বাচ্চা আছে। এর কয়েকদিন পরই সাইফুলের মুক্তির জন্য আমাদের টাকার অফার দেন মানিক। গত কোরবানির ঈদের তিনদিন আগে মানিক বরিশাল নিয়ে যায় সাইফুলকে ফিরিয়ে দেয়ার কথা বলে। এক ঘণ্টা পর দিচ্ছি, দুই ঘণ্টা পর দিচ্ছি এই বলে ঘুরায়। এভাবে কেটে যায় চারদিন। পরে আমরা বরিশাল থেকে চলে আসি। এরপর পেরিয়ে গেছে ১০ মাস। আজও ফিরিয়ে দেয়নি সাইফুলকে।
সাইফুল নিখোঁজের দিনের স্মৃতিচারণ করে স্ত্রী ফাতেমা ইসলাম বলেন, ২৪শে সেপ্টেম্বর সকালে পাওনাদারকে দেয়ার জন্য আমার কাছে ৫০ হাজার টাকা চান। পরে আমার কাছে রাখা ৫০ হাজার টাকা আমি তাকে দেই। সাইফুল বাসা থেকে বের হওয়ার সময় আমার দেড় বছরের শিশুকন্যা কান্না শুরু করে। বাবার সঙ্গে যাওয়ার বায়না ধরে। তার বাবা তখন তাকে বুঝায়, আব্বু মাছের প্রজেক্ট থেকে এসে তোমাকে বাইরে নিয়ে যাবো। পরে ওই টাকা নিয়ে তিনি বাসা থেকে বের হয়ে যান। দুপুরের পরপর পাড়ার একটি ছেলে দৌড়ে এসে আমাকে জানান, মাইমুনার আব্বুকে ধরে নিয়ে গেছে আইনের লোক। সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে আমি ঘটনাস্থলে যাই। বাসা থেকে ঘটনাস্থলের দূরত্ব কয়েক মিনিটের পথ।
২০১৮ সালে সাইফুলের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। মেয়ে জন্মের পর তার বাবা তাকে অনেক আদর করতো। আমার চেয়ে বাবার কাছেই বেশি থাকতো। তার বাবা যখন নিখোঁজ হয় তখন তার বয়স দেড় বছর। বাবা নিখোঁজের পর প্রায় রাতেই ঘুমের মধ্যে বাবা বলে চিৎকার করে ওঠে মেয়ে। অবুঝ এই শিশুটিকে নিয়ে দুঃসহ দিন পার করছি। আমার স্বামীকে আমি জীবিত ফেরত চাই। ঘটনার ৯ মাস পর প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে ফেসবুকে একটি লাইভ করেছিলাম। লাইভে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলেছিলাম- ‘আমার স্বামী একজন সাধারণ মানুষ। আজকে ৯ মাস ধরে নিখোঁজ। কারও কাছে কোনো আশ্বাস পাচ্ছি না। আপনি আমার মা, আমার স্বামীকে ফিরে পেতে আপনার সাহায্য চাই। আমার স্বামীর জীবন ভিক্ষা চাই।’
২০২০ সালের ৭ই ডিসেম্বর কুমিল্লার পিবিআই’র পরিদর্শক মোবারক হোসেন খান মামলার তদন্ত রিপোর্ট আদালতে দাখিল করেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন, ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য প্রমাণে দেখা যায়, ঘটনাস্থল থেকে একটি কালো রঙের মাইক্রোবাস দিয়ে ৪ জন লোক কোমরে পিস্তল, হাতে হ্যান্ডকাফ ও ওয়াকিটকিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে সাইফুলকে তুলে নিয়ে যায়। এ বিষয়ে আরও ব্যাপক অনুসন্ধানের প্রয়োজন।
Development by: webnewsdesign.com