ওসি প্রদীপের কথিত ‘ক্রসফায়ার’র মর্মস্পর্শী ঘটনা

৮ মাস টর্চারসেলে রেখে ক্রসফায়ার দেওয়া হয় সিএনজিচালক আজিজকে

বৃহস্পতিবার, ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ৪:৩৮ অপরাহ্ণ

৮ মাস টর্চারসেলে রেখে ক্রসফায়ার দেওয়া হয় সিএনজিচালক আজিজকে
apps

মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত প্রদীপ কান্তি দাশ কক্সবাজারের টেকনাফ থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হিসেবে কর্মরত ছিলেন ২২ মাস। এ সময়ে ইয়াবা পাচার রোধের নামে পুলিশের সঙ্গে ১৪৪টি কথিত ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় নিহত হন ২০৪ ব্যক্তি। সবগুলো ঘটনা নিয়ে সীমান্ত এলাকাটিতে ব্যাপক আলোচনা হয় না।

কিছু কিছু ঘটনা স্থানীয়দের মনকে নাড়া যেমনি দিয়েছে, তেমনি আবার ‘ইয়াবা কারবার’ নিয়ে বিতর্কেরও সৃষ্টি করেছে। নিহতদের মধ্যে বাস্তবে কারা ইয়াবা কারবারি, কাদের কথিত ‘ক্রসফায়ারে’র শিকার হওয়ার কথা আর কারাই বা শিকার হলেন এসব নিয়ে মাতামাতির শেষ নেই।

টেকনাফ সীমান্তে সংঘটিত কথিত ক্রসফায়ারের কয়েকটি ঘটনা মানুষের মন থেকে কিছুতেই মুছে ফেলা যাচ্ছে না। কেউ ভুলছেন না এমন ঘটনাগুলো। তন্মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা হচ্ছে টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের সিএনজি ট্যাক্সিচালক আবদুল আজিজ হত্যা। দীর্ঘ আট মাস ধরে থানা ভবনের টর্চার সেলে আটক রাখার পর হত্যা করা হয় আজিজকে। এরপর মানুষের মুখে মুখে ঘুরছে চট্টগ্রাম সিটি কলেজের ছাত্র জিয়াউল বশির শাহীনকে মসজিদে জুমার নামাজ থেকে ধরে নিয়ে ‘ক্রসফায়ারে’ হত্যার মর্মস্পর্শী ঘটনাটি।

খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, টেকনাফের আবাল-বৃদ্ধ জনতার মুখে মুখেই শোনা যায় সিএনজিচালক আবদুল আজিজ ও কলেজছাত্র জিয়াউল বশির শাহীনের ‘ক্রসফায়ার’ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ একজন মানুষ হয়ে টাকার জন্য কি রকম উন্মাদ হয়ে পড়েছিলেন এ রকম কয়েকটি ঘটনাই তার প্রমাণ দেয়। সীমান্ত এলাকাটিতে কিভাবে টাকার জন্য ইয়াবা কারবারির তকমা লাগিয়ে পাখি শিকারের মতো ‘সিরিয়াল কিলিং’-এর ঘটনা তিনি ঘটিয়েছেন তাই সর্বত্র আলোচনা হচ্ছে গত সোমবারের মেজর সিনহা হত্যা মামলার রায় ঘোষণার পর থেকে।

টেকনাফ উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক ইউনুস বাঙ্গালী বলেন- ‘ওসি প্রদীপের একের পর পর এক সিরিয়াল ক্রসফায়ারের ঘটনায় আমরা স্থানীয় রাজনীতিবিদরা শুধু বিব্রত নয়, রীতিমতো ভয়েও ছিলাম। এমনকি ক্রসফায়ারের মুখে পড়ার মতো অপরাধী রক্ষা পেয়েছে আবার লঘু দণ্ডযোগ্য ব্যক্তিরাও পড়েছে ক্রসফায়ারে। ’

তিনি বলেন, ওসি প্রদীপের হুমকি-ধমকির মুখে সীমান্ত এলাকায় এক ভিন্ন রকমের পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল। সবাইকে বেকুব বানিয়েই তিনি এসব অমানবিক কাণ্ডগুলো ঘটিয়েছেন।

টেকনাফের বাসিন্দা আওয়ামী লীগ নেতা ইউনুস বাঙ্গালী এমন একটি ‘ক্রসফায়ারে’র ঘটনার বিবরণ দিয়ে জানান, ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর শুক্রবার জুমার নামাজ আদায় করার জন্য হ্নীলা দারুস-সুন্নাহ মাদরাসা মসজিদে গিয়েছিলেন। নামাজ শেষ হওয়ার আগেই মসজিদের পেছনের দিকের কাতারে হৈ-হুল্লোড় শুনতে পান। দ্রুত নামাজ শেষে বেরিয়ে তিনি দেখতে পান যে পুলিশের কয়েকজন সদস্য এক তরুণকে মসজিদ থেকে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন। তাদের মধ্যে কনস্টেবল সাগর দেব ও উপ-পরিদর্শক মশিউরকে চিনতে পারেন বলেও জানান ইউনুস বাঙ্গালী। পরে তিনি আরো জানতে পারেন, হ্নীলা সিকদারপাড়া গ্রামের বাসিন্দা সৈয়দ আহমদকে না পেয়ে তার কলেজ পড়ুয়া ছেলে জিয়াউল বশির শাহীনকে ধরে নিয়ে ওই রাতেই ‘ক্রসফায়ারে’ হত্যা করেন। তিনি পরে সেই নিহত কলেজছাত্রের জানাজার নামাজও পড়েছেন।

সেই মসজিদে ওই দিনের জুমার নামাজে ইমামতি করেছিলেন স্থানীয় শীর্ষস্থানীয় আলেম মাওলানা মোকতার আহমদ। গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় মাওলানা মোকতার আহমদের কাছে মোবাইলে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওই দিন মসজিদে জুমার নামাজ আদায়কালীন অবস্থায় টেকনাফের ওসি প্রদীপের লোকজন আমাদের এলাকার সৈয়দ আহমদের ছেলেকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন। পরে ওই রাতেই ক্রসফায়ারে হত্যার শিকার হয় ছেলেটি। ’

এ বিষয়ে হ্নীলা সিকদারপাড়ার বাসিন্দা এবং নিহত কলেজছাত্র শাহীনের হতভাগা পিতা সৈয়দ আহমদ জানান, ‘টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ বাবু আমাকে ইয়াবা কারবারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে খোঁজাখুঁজি করেন। আমি এ জন্য গা ঢাকা দিই। ’ তিনি বলেন, তার দুই ছেলের মধ্যে জিয়াউল বশির শাহীন চট্টগ্রাম সিটি কলেজে লেখাপড়া করছিল। ছোট ছেলে আজিজুল বশির মোহাম্মদ বর্তমানে চট্টগ্রাম এমইএস কলেজে লেখাপড়া করে। শাহীন ওই সময় গ্রামের বাড়ি এসেছিল। জুমার নামাজ শেষেই চট্টগ্রাম ফিরে যাওয়ার কথা। কিন্তু তার আগেই বাবা সৈয়দকে না পেয়ে ছেলেকে পুলিশ ধরে ফেলে।

হতভাগা বাবা সৈয়দ জানান, জুমার নামাজ থেকে ছেলেকে ধরার পর এক কোটি টাকা দাবি করেছিল। কিন্তু টাকা দিতে না পারায় ওসি প্রদীপ ক্ষুব্ধ হয়ে রাতেই তার কলেজ পড়ুয়া নিরীহ ছেলেকে ক্রসফায়ারে হত্যা করে। মসজিদের জুমার নামাজ থেকে একজন কলেজছাত্রকে ধরে নিয়ে টাকার দাবিতে হত্যার ঘটনাটি স্থানীয় মানুষ ভুলতে পারছে না।

আরো মর্মান্তিক ঘটনাটি হচ্ছে টেকনাফের একজন সিএনজি ট্যাক্সিচালককে ইয়াবা কারবারে জড়িত থাকার অভিযোগে কক্সবাজার শহর থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় টেকনাফ থানায়। টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মহেশখালীয়া পাড়ার বাসিন্দা সিএনজি ট্যাক্সিচালক আবদুল আজিজকে (৩৯) কক্সবাজার শহরের হাসপাতাল সড়ক থেকে জেলা ডিবি পুলিশের সদস্যরা ২০১৯ সালের ৩ ডিসেম্বর আটক করেন। পরে তাকে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপের হাতে তুলে দেওয়া হয়।

ওসি প্রদীপ আজিজের মুক্তির জন্য তার স্ত্রী ছেনুয়ারার কাছে ১০ লাখ টাকা দাবি করেন। স্ত্রী ছেনুয়ারা ধারদেনা করে পুলিশের হাতে নগদ ৫ লাখ টাকা তুলে দেন। কিন্তু তারপরেও আজিজকে ছেড়ে দেওয়া হয়নি। প্রয়াত এমপি মোহাম্মদ আলীও আটক সিএনজিচালককে ছেড়ে দেওয়ার জন্য পুলিশকে অনুরোধ করেছিলেন বলে জানান নিহত আজিজের স্ত্রী ছেনুয়ারা বেগম। পরে ২০২০ সালের ৭ জানুয়ারি কক্সবাজারের পুলিশ সুপারের কাছে স্বামীকে ফেরত চেয়ে একটি লিখিত আবেদন করেন স্ত্রী ছেনুয়ারা।

এরপরেও টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ আজিজকে না ছেড়ে থানার টর্চার সেলে আটকিয়ে রেখে দেন। দাবি করা ৫ লাখ টাকা না দেওয়ায় দীর্ঘ প্রায় ৮ মাস থানার টর্চার সেলে আটকিয়ে রাখার পর ২০২০ সালের ৭ জুলাই হোয়াইক্যং ইউনিয়নের কম্বনিয়া বড়ছড়া নামক এলাকায় কথিত ক্রসফায়ারে তাকে হত্যা করা হয়। সিএনজিচালক আবদুল আজিজের মর্মস্পশী এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটে মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডের মাত্র ৩ সপ্তাহ আগে। পরে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের মর্গে তার স্ত্রী ছেনুয়ারা বেগমসহ স্বজনরা আসেন। কিন্তু লাশ শনাক্তে তাদের যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। কেননা দীর্ঘ ৮ মাস ধরে টর্চার সেলে আটক থাকা ক্লিন সেভের আবদুল আজিজের মুখ তত দিনে চুল-দাড়ি আর গোঁফের কারণে কোনোভাবেই চেনা যাচ্ছিল না।

নিহত হতভাগা আবদুল আজিজের স্ত্রী ছেনুয়ারা জানান, আল মুবিন (৭) ও ফরহাদ (৪) নামের তার দুটি সন্তান রয়েছে। তিনি সেলাই কাজ করে বর্তমানে ছেলে দুটিকে নিয়ে ভাঙা ঘরেই টানাপড়েনের মধ্যে জীবন যাপন করছেন। আজিজ কোনো জায়গাজমি রেখে যাননি। মাত্র ২৫ কড়ার একটি ঘরভিটা রয়েছে। সেই ভিটায় রয়েছে একটি ভাঙা ঘর। তা-ও ভিটাটি বন্ধক দেওয়া রয়েছে ওসি প্রদীপকে টাকা দেওয়ার জন্য। সিএনজি ট্যাক্সিটিও দুই লাখ টাকায় বিক্রি করা হয় ওসি প্রদীপের টাকার লালসা মেটাতে। কিন্তু সর্বশেষ ওসির হাতে ছেনুয়ারা পাঁচ লাখ টাকা দিয়েও স্বামীকে জীবিত ফেরত পাননি।

ছেনুয়ারা জানান, টেকনাফ থানার উপপরিদর্শক মশিউর জানিয়েছিলেন, ওসি প্রদীপের একজন সোর্স নাকি সিএনজিচালক আজিজ অনেক টাকা এবং টাইলস লাগানো পাকা ভবনের মালিক বলে লাগিয়ে দিয়েছিলেন। সেই থেকে ওসি প্রদীপ আজিজকে ধরে ইয়াবা কারবারের তকমা লাগিয়ে টাকা হাতিয়ে নিতে ওত পেতে ছিলেন। পরে আজিজের ভাঙাচুরা ঘর দেখে নাকি মশিউর আফসোস করেছিলেন। টেকনাফ থানার উপপরিদর্শক মশিউরের এমন তথ্যে প্রমাণিত হয়, ওসি প্রদীপ ইয়াবা কারবারি নয় শুধু, টাকাওয়ালা লোকদের ধরে ইয়াবা কারবারি সাজিয়ে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিয়ে ক্রসফায়ারে দিয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে হোয়াইক্যং ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য (মেম্বার) মোহাম্মদ হাসান জানান, ‘আমি ওই দিন মর্গে গিয়ে আজিজকে চিনতে পারিনি। ক্লিন সেভের এমন স্মার্ট আবদুল আজিজের মাথার ইয়া লম্বা চুল আর দাড়ি-গোঁফের কারণে কোনোভাবেই চেনা যাচিছল না। ’ ইউনিয়ন পরিষদ মেম্বার হাসান জানান, নিহত সিএনজিচালক আজিজ ভাগ্যের চাকা ঘোরানোর জন্য সৌদি আরব যেতে চেষ্টা করছিলেন। তার রেখে যাওয়া ঘরটিও ভাঙাচোরা। তিনি যদি ইয়াবা কারবারি হতেন, তাহলে তার অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হতো।

Development by: webnewsdesign.com