মধ্যযুগে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে কত যে ভয়াবহভাবে হত্যা করা হতো। হত্যাকাণ্ডের পদ্ধতিগুলো এতই পৈশাচিক ছিলো যে নির্মমতার মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। আর তখনকার সেই সব হত্যাকাণ্ডের কথাগুলো বা ঘটনা গুলো শুনলে যে কোন মানুষের শরীর শিউরে ওঠবে।মধ্যযুগ হলো ইউরোপীয় ইতিহাসের একটি সময়।যে সময় ইউরোপ ছিল অন্ধকারে, বর্বরতায়। আর তা হলো ৪৭৬ সাল থেকে ১৪৯৩ সাল পর্যন্ত মধ্য যুগ।
মধ্যযুগে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের যে পৈশাচিক পদ্ধতিতে হত্যা করা হতোঃ
ক্রুশে বিদ্ধ করে হত্যা মৃত্যুদণ্ড (Crucifixion): ক্রুশে বিদ্ধ করে হত্যা মৃত্যুদণ্ডের এই পদ্ধতি যিশু খ্রিস্টকে হত্যার পদ্ধতি অনুসরণ করে প্রচলিত হয়। একটি ক্রুশে বন্দির হাত পায়ে পেরেক দিয়ে বিদ্ধ করা হতো। তারপর বন্দিকে খোলা যায়গায় ছেড়ে দেওয়া হতো। রক্তক্ষরণ হয়ে মারা যেত সে বন্দি। রক্তক্ষরণে কারো মৃত্যু না হলেও ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় মারা যেত। অনেকে আবার তীব্র ঠাণ্ডায় জমে মারা যেত।
চামড়া ছাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড (Flaying) : চামড়া ছাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড এই পদ্ধতিতে বন্দি মারা যাওয়ার আগেও ভয়াবহ যন্ত্রণা ভোগ করত। জীবন্ত অবস্থায় ধীরে ধীরে বন্দির সমস্ত শরীর থেকে চামড়া ছাড়িয়ে নেওয়া হতো। কষ্ট বাড়ানোর জন্য মাঝে মাঝে উন্মুক্ত স্থানে লবণ মাখানো হতো। এটি ছিলো আরেকটি প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার সার্বজনীন পদ্ধতি। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গবিচ্ছিন্ন করে হত্যা চুরি এবং ব্যভিচারের শাস্তি হিসেবে এই শাস্তির প্রচলন ছিলো। ইংল্যান্ডে এই শাস্তির রেওয়াজ চালু হয়েছিল। দোষীর দেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ধারালো ছুরি দিয়ে একে একে বিচ্ছিন্ন করে নির্মমভাবে হত্যা করা হতো।
ক্যাথরিনের চাকা (Breaking Wheel): ক্যাথরিনের চাকা এই পদ্ধতিতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে একটি চাকার সঙ্গে শক্ত করে বাঁধা হতো। তারপর চাকাটি খুব জোরে ঘোরানো হতো। তখন জল্লাদ ঘূর্ণায়মান ব্যক্তির শরীরে চাবুক বা লাঠি দিয়ে সজোরে আঘাত করতে থাকতো। তারপর জল্লাদ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির হাতে ও পায়ে পেরেক ঠুকে দিতো। পুনরায় চাবুক ও লাঠি দিয়ে আঘাত করতো জল্লাদ। তারপর পেরেক ঠোকা অবস্থায় ওই ব্যক্তিকে শহরের মাঝে জনসমক্ষে ঝুলিয়ে রাখত যাতে করে সবাই এ নির্মমতা দেখতে পায়।
শূলে চড়িয়ে মৃত্যুদন্ত (Impalement): শূলে চড়িয়ে মৃত্যুদন্তের এই পদ্ধতিতে বন্দির হাত পা বেঁধে সূচালো একটি দণ্ডের ওপর বসিয়ে দেওয়া হতো। বন্দি তার নিজের শরীরের ভারে আস্তে আস্তে নিচের দিকে নেমে যেত। অনেক সময় খুঁটিটির মাথা সূচালো না করে ভোঁতা রাখা হত যাতে হৃৎপিণ্ড বা অন্যান্য প্রধান অঙ্গ বিদ্ধ হয়ে তাড়াতাড়ি মারা না যায়। এতে অপরাধী বেশি কষ্ট পেত। এ পদ্ধতিতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির মৃত্যু হতে অনেক সময় এক থেকে দুদিন সময় লাগতো।প্রথম শূলে চড়ানোর ইতিহাস পাওয়া যায় প্রাচীন নিকট প্রাচ্যে। তখন রাজদ্রোহীদের শূলে চড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতো। তৎকালীন পারস্যের রাজা প্রথম দারিউস ব্যাবিলন জয় করার পর প্রায় ৩ হাজার ব্যাবিলনবাসীকে শূলে চড়িয়েছিল। শূলে চড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার জন্য বেশি কুখ্যাত ছিল প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের ওয়ালেশিয়া রাজ্যের যুবরাজ তৃতীয় ভ্লাদ, যাকে বলা হয় ড্রাকুলা।
হাতির পায়ে পিষ্ট করে মৃত্যু (Crushing) : হাতির পায়ে পিষ্ট করে মৃত্যু মৃত্যদণ্ড কার্যকর করার এই পদ্ধতি কিন্তু সুদূর কোনো দেশের প্রচলিত পদ্ধতি নয়। এই পদ্ধতিতে বিশাল আকৃতির হাতি তার পা দিয়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির মাথা থেঁতলে দিত। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আবার হাতিকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো যাতে সে ধীরে ধীরে পায়ের চাপ বাড়ায়। যাতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি সর্বোচ্চ কষ্ট ভোগ করে মৃত্যুর সময়।
পুড়িয়ে হত্যা (Death by Burning): এই পদ্ধতিতে প্রথমে বন্দি ব্যক্তির পায়ে, তারপর উরু, নিম্ন উদর, বুক, ঘাড় এবং সবশেষে মাথায় আগুন দেওয়া হতো। বন্দি ব্যক্তি মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত সীমাহীন যন্ত্রণা ভোগ করত। জোয়ান অব আর্ককে এই পদ্ধতিতে হত্যা করা হয়েছিল।
করাতে কেটে মৃত্যুদণ্ড (Sawing): করাতে কেটে মৃত্যুদণ্ড এই পদ্ধতি আগে চালু ছিলো ইউরোপের বিভিন্ন দেশসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে।সেক্ষেত্রে মৃত্যদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে সম্পূর্ণ নগ্ন করে উল্টো করে দুই পা দুই দিকে ফাঁক করে বেঁধে রাখা হতো। তারপর মৃত্যদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির যৌনাঙ্গ বরাবর করাত রেখে দেহকে মাঝ বরাবর কেটে ফেলা হতো। আর উল্টো করে ঝোলানোর কারণে ব্যক্তিটির মস্তিষ্ক যথেষ্ট পরিমাণ রক্ত পেতো যাতে তিনি শরীরের মাঝ বরাবর কেটে ফেলার ব্যথা সম্পূর্ণটাই অনুভব করতে পারেন। গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ কাটার আগ পর্যন্ত বেঁচে থাকতো বন্দি।
লিং চি মৃত্যুদণ্ড (Ling Chi) : লিং চি মৃত্যুদণ্ডের এই পদ্ধতিটি চিনে চালু ছিলো। এই পদ্ধতিতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে লোকালয়ে এনে বেধে ফেলা হতো। তারপর একজন জল্লাদ বিশেষ ছুরি দিয়ে সেই ব্যক্তির দেহ থেকে বিভিন্ন অঙ্গ ধীরে ধীরে আলাদা করে ফেলতো। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিটি যাতে দীর্ঘক্ষণ ধরে অধিক যন্ত্রণা ভোগ করে।
নির্লজ্জ ষাঁড় (Brazen Bull): নির্লজ্জ ষাঁড় পদ্ধতিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা আরেকটি ভয়াবহ পদ্ধতি ছিল। সিসিলির স্বৈরশাসক সেই পদ্ধতি প্রথম চালু করেছিল। পরামর্শদাতা ছিলেন তৎকালীন ধাতু কারুকার্যকর প্রিলিয়স । ধাতু দ্বারা নির্মিত এই ষাঁড়কে অনেক বড় করে বানানো হতো। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে ওই ষাঁড়ের পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে পেটের নিচে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হতো। তার ফলে ষাড়ের ভিতরে থাকা ব্যক্তি সরাসরি আগুনে না ঝলসে আগুনের গনগনে তাপে ঝলসে যেত। ষাড়টিকে এমনভাবে নির্মাণ করা হতো যাতে ভেতরে পুড়তে থাকা ব্যক্তির চিৎকার শুনে মনে হত ষাড়টি যেন চিৎকার করছে। পুড়তে থাকা ব্যক্তির পোড়া ধোয়া ষাড়ের নাক দিয়ে বেরিয়ে আসতো।
সিদ্ধ করে হত্যা (Death by Boiling) : সিদ্ধ করে হত্যা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দিকে প্রথমে একটি পানি ভর্তি পাত্রে রাখা হতো।তারপর পাত্রের নিচে আগুন দিয়ে পানি গরম করে ধীরে ধীরে সিদ্ধ করা হতো।আর বন্দির মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত পানি ফোটানো হতো। ভয়বহ মর্মান্তিক এই মৃত্যুদণ্ডের পদ্ধতি যুক্তরাজ্যে চালু ছিলো ১৫০০ শতক পর্যন্ত।
দ্য জুডাস ক্রেড্ল: ত্রিকোণ কাঠের প্রতিটি ধার থাকত তরবারির থেকেও ধারালো। তার উপরে নগ্ন করে বসিয়ে দেওয়া হত পুরুষ বা মহিলাকে। বর্শার মতো ক্রেড্ল হলে তা প্রবেশ করানো হত মহিলার যৌনাঙ্গ দিয়ে। পাটাতনের মতো ক্রেড্ল হলেতা প্রবেশ করানো হত পশ্চাদ্দেশ দিয়ে। মৃ্ত্যু অনিবার্য।
পিয়ার অফ অ্যাঙ্গুইশ: মহিলাদের যৌনাঙ্গ, পুরুষ বা সমকামীদের পায়ুদ্বার অথবা মুখ দিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হত যন্ত্রটি। তার পরে প্যাঁচ দিতেই যন্ত্রটি শরীরের ভিতরে গিয়ে ফুলের পাপড়ির মতো খুলে যেত। পরিণাম সহজেই অনুমেয়।
আয়রন চেয়ার: লোহার কাঁটা দেওয়া চেয়ারে বসিয়ে দেওয়া হত। তার পরে ক্রমশ চারপাশ থেকে চাপ দেওয়া হত। লোহার কাঁটা মাংস ভেদ করে প্রবেশ করত শরীরের ভিতরে।
হেড ক্রাশার: লোহার হেলমেট পরিয়ে দেওয়া হত মাথায়। তার পরে উপর থেকে হাতল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে, অনেকটা স্ক্রু-র মতো করে লোহা ভেদ করানো হত মাথা দিয়ে।
র্যাট টর্চার: হাত-পা বেঁধে টেবিলে শুইয়ে দেওয়া হত। তার পরে গায়ে ছেড়ে দেওয়া হত ক্ষুধার্ত ইঁদুর। অনেক ক্ষেত্রে একটি খাঁচায় ক্ষুধার্ত ইঁদুর রেখে সেটিতে স্থাপন করা হত শুইয়ে দেওয়া ব্যক্তির পেটের উপরে। ইঁদুরটি খুবলে খেত গোশত। মৃত্যু পর্যন্ত এভাবেই ইঁদুর দিয়ে খাওয়ানো হত।
কফিন টর্চার : জ্যান্ত ডুবিয়ে মারার কল। লোহার খাঁচায় ঠিক এইভাবে বেঁধে ফেলা হত দোষীকে। তার পরে জলে ডুবিয়ে মারা হত। তার আগে অবশ্য রাস্তায় সকলের সামনে ঝুলিয়ে রাখা হত বেশ কিছুক্ষণ যাতে সাধারণ লোকে ঢিল ছুড়তে পারে।
ব্রেস্ট রিপার: কোনও মহিলার বিরুদ্ধে ব্যাভিচারের অভিযোগ উঠলে, তাঁর স্তনযুগল এই যন্ত্র দিয়ে উপড়ে নেওয়া হত। লোহার এই যন্ত্রটি গরম করে নেওয়া হত। তার পরে চিমটের মতো ধরা হত স্তনে। ধীরে ধীরে ছিঁড়ে নেওয়া হত স্তন।
নি-স্প্লিটার : যে যন্ত্রটি দেখছেন, সেটি হাঁটুতে বসানো হত। হাঁটুকে দাঁতের মতো দু’দিক থেকে কামড়ে ধরত লোহার এই পেরেকগুলি। দু’দি্ক থেকে প্রবল চাপে হাঁটু গুঁড়িয়ে যেত।
Development by: webnewsdesign.com