বেসরকারি খাতে ঋণ পরিস্থিতির ভয়ানক অবনতি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, গত নভেম্বরে এর আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। এই হার গত ১৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। এ পরিস্থিতিকে অর্থনীতির জন্য উদ্বেগজনক বলছেন অর্থনীতিবিদরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, নভেম্বর শেষে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। অক্টোবর শেষে যা ছিল ১০ দশমিক ০৪ শতাংশ। অর্থাৎ আগের মাসের তুলনায় প্রবৃদ্ধি কমেছে দশমিক ১৭ শতাংশ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে তা ৪ শতাংশ কম। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত লক্ষ্য ঠিক করা ছিল ১৩ দশমিক ২ শতাংশ।
সরকারের অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্য বলছে, এর আগে ২০০৩ ও ২০০৪ সালে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশে নেমেছিল। ২০০৫ সালে এটি বেড়ে ১২ শতাংশে উন্নীত হয়। এরপর থেকে একক মাস হিসেবে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কখনও সিঙ্গেল ডিজিট বা এক অঙ্কে নামেনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর শেষে বার্ষিক ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ২৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর শেষে বার্ষিক ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ২৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ। ২০১১ সালে মার্চে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ২৯ দশমিক ১৩ শতাংশে ওঠে। সর্বশেষ গত নভেম্বরে সিঙ্গেল ডিজিটে নেমে ঋণ প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। রাজনৈতিক অস্থিরতা তথা বিএনপি-জামায়াতের জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনের সময়ও (২০১৩-১৪ সাল) বেসরকারি খাতে এত কম ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল না। এ দুই সালে যা ছিল যথাক্রমে ১০ দশমিক ৮০ শতাংশ এবং ১২ দশমিক ০৩ শতাংশ।
বেসরকারি খাতে ঋণের এমন পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেছেন সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতি এক দিনে তৈরি হয়নি। অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে এখন সংকট দেখা দিয়েছে। বেসরকারি খাতে দীর্ঘদিন ধরে বিনিয়োগ হচ্ছে না। তিনি বলেন, যাদের ঋণ দরকার, তারা ঋণ পাচ্ছেন না। সুদের হার বেশি হওয়ায় অনেকে ঋণ নিচ্ছেনও না। বেসরকারি খাতে নেতিবাচক ঋণ পরিস্থিতি তারই প্রমাণ। বলা হচ্ছে, কয়েক দশকের মধ্যে এখন সবচেয়ে কম প্রবৃদ্ধি।
সেলিম রায়হানের মতে, একদিকে উদ্যোক্তারা ঋণ পাচ্ছেন না, অন্যদিকে ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ ভয়াবহভাবে বেড়ে গেছে। উদ্বেগজনক এই পরিস্থিতিতে ব্যাংকিং খাতে একধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে বলেও মনে করেন তিনি।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের শুরুতে ঋণপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণে আনতে ঋণ-আমানত অনুপাত (এডিআর) কিছুটা কমিয়ে আনে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর থেকে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমতে থাকে। কয়েক দফা এডিআর সমন্বয়ের সীমা বাড়ানো হলেও ঋণ প্রবৃদ্ধি বাড়ছে না। নিম্নমুখী ধারা অব্যাহত আছে।
আমদানি ও রফতানি কমে যাওয়া, নতুন বিনিয়োগে আশানুরূপ গতি না আসাসহ বিভিন্ন কারণে বেসরকারি খাতে ঋণ চাহিদা কমে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। খেলাপি ঋণ বাড়তে থাকায় ব্যাংকের ঋণ দেওয়ার সক্ষমতাও কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে কলকারখানা স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনি যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি) আমদানি কমেছে ১০ শতাংশ। শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে ২০ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, টানা ২ বছর ধরে অব্যাহতভাবে বেসরকারি খাতে ঋণ পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে এই অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ২৬ শতাংশ এবং জানুয়ারিতে ছিল ১৩ দশমিক ২০ শতাংশ।
এদিকে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমলেও সরকারের ঋণ গ্রহণের হার বাড়ছে। এই অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার কথা ছিল ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা। কিন্তু ছয় মাস না যেতেই সরকার নিয়েছে ৪৪ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা।
সাধারণত অর্থবছরের শেষ দিকে সরকারের টাকার টান পড়ে বেশি। কিন্তু এবার অর্থবছরের শুরুতেই টাকার টান পড়েছে।
Development by: webnewsdesign.com