এভারেস্টের উচ্চতা ৮ হাজার ৮৪৯ মিটার হলেও এর চূড়ায় ঠিকই পর্বতারোহীদের পা পড়েছে। জানলে অবাক হবেন, এভারেস্টের চেয়েও কম উচ্চতাসম্পন্ন একটি পর্বতে আজও কেউ উঠতে পারেনি। রহস্যজনকভাবে কাজটি অসম্পন্নই রয়ে গেছে।
প্রকৃতির এক বিস্ময় লুকিয়ে আছে কৈলাস পর্বতে। এ পর্বতের নাম শোনেনি এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান হলো কৈলাস পর্বত। হিন্দু ধর্মীয় পুরাণে কৈলাসকে শিবের লীলাধাম বলা হয়েছে।
এ পর্বতের উচ্চতা ৬ হাজার ৬৩৮ মিটার। অর্থাৎ এভারেস্টের চেয়েও ২২০০ মিটার কম। তবে কেন পর্বতারোহীরা এর চূড়ায় আজও উঠতে পারেননি? কেন পারেননি, এ রহস্যেরও সমাধান মেলেনি।
তবে আজব কাণ্ড ঘটে, যখন এ পর্বতে কোনো পর্বতারোহী ওঠার চেষ্টা করেন। কিছুদূর ওঠার পরই প্রকৃতি তার ভয়াবহ রূপ দেখায়। শুরু হয় ঝড়, তেড়ে আসে পাথরের টুকরো। অনেক সময় পর্বতারোহীরা পা পিছলে পড়েও যান।
জানা যায়, এ পর্যন্ত যারা কৈলাস পর্বতে ওঠার চেষ্টা করেছেন; তাদের সঙ্গেই ঘটেছে অতিপ্রাকৃত ঘটনা। কিছুক্ষণ পরই শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কাজ করা বন্ধ করে দেয়। অকালবার্ধক্য চলে আসে পর্বতারোহীর শরীরে।
এমনকি মাথার চুল ও হাতের নখ বাড়তে থাকে দ্রুতগতিতে! সাধারণভাবে মানুষের নখ-চুল যে হারে বাড়ে, কৈলাস পাহাড়ে অন্তত ১২ ঘণ্টা কাটালে না-কি এ বৃদ্ধির হার দ্বিগুণ হয়ে যায়। এ রকম হাজারো বিস্ময়ের ধারক ও বাহক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কৈলাস পর্বত। যদিও এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা এখনো মেলেনি।
কৈলাস পর্বতের উৎপত্তি: প্রথমদিকের মহাদেশগুলোর সংঘর্ষে তৈরি হয়েছিল এ পর্বত বলে জানা যায়। একটি মহাসাগরের মৃত্যু আর পর্বতমালার শিলার জন্মের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এ কৈলাস পর্বত। এর ভূ-তাত্ত্বিক গুরুত্ব কোনো অংশেই এর আধ্যাত্মিক গুরুত্বের চেয়ে কম নয়। ভূ-তত্ত্ব আর অতীন্দ্রিয়বাদ এসে মিশে গেছে কৈলাসে।
এ পর্বতের একদম চূড়ায় কোনো বরফ জমে না। কারণ পর্বতটি এতটাই খাড়া যে, বরফ নিচে পড়ে যায়। আর ওই বরফ গলে গিয়ে উৎপত্তি হয় নদীগুলোর। মরুভূমির মতো স্থানে শ্বেত-শুভ্র পর্বত হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে কৈলাস। হিমালয়ের প্রথম ও প্রধান রেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে পর্বতটি।
যদিও কেউ এখনো এর চূড়ায় ওঠেনি; তবে লাখ লাখ তীর্থযাত্রী হাজারো বছর ধরে এর আশেপাশে ঘুরছে সুখী হওয়ার আশায়। অনেকেই বারবার অবনত হয়ে পর্বতের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানাতে চারপাশে যে ৫০ কিলোমিটার ট্র্যাক আছে, সেই পথে হেঁটেছেন। বিখ্যাত পর্বতারোহী রেইনহোল্ড মাইসনার এর চূড়ায় আরোহন করার অনুমতি চাইলে চীনা সরকার তার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন।
কৈলাস পর্বতের ইতিহাস: সংস্কৃতে কেলাস থেকে কৈলাসের উৎপত্তি। কারণ বরফে ঢাকা কৈলাসকে দেখতে স্ফটিকের মতো মনে হয়। তিব্বতি ভাষায় এর নাম গাঙ্গো রিনপোচে। তিব্বতে বৌদ্ধ গুরু পদ্মসম্ভবাকে বলা হয় রিনপোচে। তার থেকেই নামকরণ হয়েছে কৈলাস পর্বতের। এর অর্থ হলো- বরফের তৈরি মূল্যবান রত্ন।
বিজ্ঞাপন
তিব্বতে প্রচলিত প্রাচীন কিংবদন্তি হলো, গুরু মিলারেপাই শুধু পা রাখতে পেরেছিলেন কৈলাসর চূড়ায়। ফিরে এসে তিনি নিষেধ করেছিলেন এ পর্বত জয়ে যেতে। কারণ একমাত্র সে-ই মানুষ পারবে এর চূড়ায় যেতে, যার গায়ে কোনো চামড়া নেই। আধুনিক পর্বতারোহীরাও বলছেন, মাউন্ট কৈলাস জয় করা অসম্ভব বিষয়। তবে এর কারণ আজও জানেন না কেউ।
কৈলাসের পায়ের কাছে আছে মানস সরোবর এবং রাক্ষসতাল। এ দুই হ্রদ এশিয়ার বেশ কিছু দীর্ঘতম নদীর উৎস। পর্বতের ১৪ হাজার ৯৫০ ফুট উচ্চতায় মানস সরোবর বিশ্বের উচ্চতম মিষ্টি জলের হ্রদ। প্রকৃতির আজব সৃষ্টি! মানস-রাক্ষস দুই হ্রদ পাশাপাশি আছে। অথচ মানসের পানি মিষ্টি ও শান্ত। আর রাক্ষসের পানি নোনা ও অশান্ত।
চারটি নদী দ্বারা বেষ্টিত কৈলাস পর্বতকে দেখলে পিরামিড মনে হয় । অনেকে তো আবার বিশ্বের সর্ববৃহৎ পিরামিডও বলে থাকেন। পিরামিডের মতোই খাড়া, তাই হয়তো কেউ উঠতে পারেনি। আরও অদ্ভুত বিষয় হলো, বিজ্ঞানীরা বলছেন কৈলাসে নাকি কোনো চুম্বকীয় ক্ষেত্র নেই। যে কারণে কোনো কোনো কম্পাস কাজ করে না।
পিরামিডের আকারের এ পর্বতের গায়ে অনেক প্রাচীন গুহা রয়েছে। যেখানে দেখা মিলতে পারে বৌদ্ধ ও হিন্দু সন্ন্যাসীদের। এ সন্ন্যাসীরা লোকচক্ষুর আড়ালে বহু বছর ধরে তপস্যা করে চলেছেন গুহায়। প্রতিবছর বহু মানুষ মানস সরোবর যাত্রা করেন। তবে দুর্গম প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে অল্প কয়েকজনই যাত্রা সম্পূর্ণ করতে পারেন।
বিজ্ঞানীদের গবেষণা: ১৯৯৯ সালে রাশিয়ার এক চক্ষু বিশেষজ্ঞ এর্নেস্ট মুলদাশিফ ঠিক করেন কৈলাস পর্বতের রহস্য উন্মোচন করবেন। তার পর্বতারোহী দলে ভূ-বিজ্ঞান, ভৌতিক বিশেষজ্ঞ আর ইতিহাসবিদরা ছিলেন। তারা অনেক তিব্বতি লামাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
কৈলাসের আশেপাশে অনেক মাস ধরে তারা সময় কাটান। এরপর তিনি একটি বই লেখেন ‘হোয়ার ডু উই কাম ফ্রম’ বা ‘আমরা যেখান থেকে এসেছি’। বইয়ে তিনি কৈলাস পর্বতে সময় কাটানোর অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন।
তদন্ত করার পর এর্নেস্ট মুলদাশিফ বলেন, বাস্তবে কৈলাস পর্বতে একটি মানব নির্মিত পিরামিড আছে। আর এ পিরামিডটি নির্মাণ করা হয় প্রাচীনকালে। তিনি দাবি করেন, একটি বড় পিরামিডকে অনেক ছোট ছোট পিরামিড ঘিরে আছে আর সেখানে ঘটে অলৌকিক ঘটনা।
কৈলাস থেকে ফেরার পর এর্নেস্ট মুলদাশিফ লেখেন, রাতের নিস্তব্ধতায় পাহাড়ের ভেতর থেকে ফিসফিস করে কথা বলার শব্দ আসে। এক রাতে আমি আর আমার দুই সহযোগী পাথর পড়ার আওয়াজ পেয়েছি। আর এ আওয়াজ কৈলাস পর্বতের পেটের ভেতর থেকে আসছিল। আমরা ভেবেছিলাম, পিরামিডের মধ্যে হয়তো কোনো শক্তি আছে, যারা ঠিক মানুষের মতোই কথা বলছে।
তিনি আরও লিখেছিলেন, তিব্বতি গ্রন্থে লেখা আছে যে শাম্বালা একটি আধ্যাত্মিক দেশ। এটা কৈলাস পর্বতের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ দিয়ে এ বিষয়ে চর্চা করা আমার পক্ষে কঠিন। তবে আমি পরিষ্কারভাবে বলতে পারি, কৈলাস পর্বতের এলাকা পৃথিবীর বাইরের জগতের সঙ্গে জড়িত।
কৈলাস পর্বত আর আশেপাশের পরিবেশের ওপর গবেষণা করা বৈজ্ঞানিক নিকোলাই রোমনভ আর তার দল তিব্বতের মন্দিরের ধর্মগুরুদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি বলেছেন, কৈলাস পর্বতের চারদিকে একটি অলৌকিক শক্তি বয়ে চলেছে।
সূত্র : জাগোনিউজ
Development by: webnewsdesign.com