‘মুক্তিযোদ্ধা দিবস’ জাতীয়করণ সময়ের দাবী

রবিবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২০ | ১২:৫১ অপরাহ্ণ

‘মুক্তিযোদ্ধা দিবস’ জাতীয়করণ সময়ের দাবী
apps

ইতিহাসের শত বছরের শোষিত জাতির নাম বাঙালি ৷ যুগে যুগে নানা শাসকগোষ্ঠী দ্বারা শোষণের পর অবশেষে ১৯৭১ সালে বাংলার দামাল ছেলেরা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে পরাজিত করে ছিনিয়ে এনেছে স্বাধীন বাংলাদেশ। খুব স্বল্প সংখ্যক লোক ছাড়া ততকালীন পূর্ব বাংলার সকল জনগণ স্বতঃস্ফুর্তভাবে, পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর এ যুদ্ধই পৃথিবীর ইতিহাসে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ হিসেবে পরিচিত। পাকিস্তান রাষ্ট্রটির মৌলিক নীতি ও ধারণার বিপরীতে অসাম্প্রদায়িক, কল্যানমূখী, মানবিক ও প্রগতিশীল জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এদেশের মানুষের মৌলিক ও ন্যায়সঙ্গত অধিকার নিশ্চিত করা, জাতীয় পরিচয় প্রতিষ্ঠা, শোষণ-বঞ্চনা-অন্যায়ের অবসান ঘটানো ও সাধারণের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করা ছিল এই মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। আর এ মুক্তিযুদ্ধে যারা অংশগ্রহণ করেছেন তাদের ‘মুক্তিযোদ্ধা’ বলা হয়। তারা দেশকে স্বাধীন করতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, আমাদের বিজয়ের স্বাদ গ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছেন।

মুক্তিযোদ্ধা’ শব্দটির মধ্যেই নিহিত আছে বাঙালি জাতির গর্বের ইতিহাস, বাঙালি জাতির অহঙ্কারের বীরগাঁথা। মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন বলেই আমরা পেয়েছি বিশ্বের বুকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। আমরা পেয়েছি আমাদের ঠিকানা, আমাদের স্বদেশভূমি। মুক্তিযোদ্ধারা হচ্ছেন বাঙালি জাতির সূর্যসন্তান। মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতির বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলো জাতীয় অহংকার বীর মুক্তিযোদ্ধারা। তাদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি আমাদের লাল-সবুজের পতাকা আর বিশ্বের বুকে এক গর্বিত মানচিত্র। ‘মুক্তিযোদ্ধা’ শব্দটি আমাদের কাছে অনেক বড় মাহাত্ম্যময়। মুক্তিযোদ্ধা শব্দটি শুনলেই শ্রদ্ধায় নত হয়ে ওঠে হৃদয়। মুক্তিযুদ্ধচলাকালীন সময়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন তা ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে।

মুক্তিযোদ্ধাদের এতো কৃতিত্বের পর বিজয়ের প্রায় অর্ধশত বছর পেরিয়ে গেলেও স্বীকৃতিস্বরূপ নেই মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে জাতীয় কোনো দিবস। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একসাগরের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ ও লাল-সবুজের পতাকা প্রতিষ্ঠিত করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। বার্ধক্যের কারণে দিনে দিনে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কমছে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণীয় করে রাখতে বিজয়ের মাসের প্রথম দিনটি মুক্তিযোদ্ধা দিবস ঘোষণা এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের দাবী যৌক্তিক। মুক্তির নায়কদের সম্মান জানাতে জাতীয়ভাবে ‘মুক্তিযোদ্ধা দিবস’ এর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান এখন সময়ের দাবি। গত ১৮ অক্টোবর জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে প্রতিবছর ১ ডিসেম্বরকে মুক্তিযোদ্ধা দিবস ঘোষণা করে তা রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের প্রস্তাব মন্ত্রিসভায় তোলা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। মন্ত্রণালয় একমত পোষণ করার পরও এবার (২০২০) ১লা ডিসেম্বর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ছাড়াই মুক্তিযোদ্ধা দিবস পালিত হয়েছে। বিজয়ের অর্ধশত বছরের পূর্বেই ‘মুক্তিযোদ্ধা দিবস’ জাতীয়করণ করা উচিত।

মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ আর কষ্টে জন্ম বাংলাদেশের। অথচ সেই মুক্তির নায়কদের সম্মান ও স্মরণ করার নির্দিষ্ট একটি দিন নেই বাংলাদেশে। আওয়ামী লীগের তৎকালীন প্রভাবশালী নেতারা, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারসহ অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধারা ১লা ডিসেম্বরকে মুক্তিযোদ্ধা দিবস ঘোষণা দিয়ে বহু পূর্ব থেকে মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশ, মতবিনিময় সভা ও আলোচনা সভা করে আসলেও এখন পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা দিবসটিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হচ্ছে না যা সত্যিই বড়ো বেদনার কথা! মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি পূর্ণাঙ্গ কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য ‘মুক্তিযোদ্ধা দিবস’ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়া উচিত। যদিও ২০০৪ সালের ১২ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে সমাবেশ করে ১ ডিসেম্বরকে মুক্তিযোদ্ধা দিবস হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছিলেন জাতির বীর সন্তান মুক্তিযোদ্ধারা। সরকারের সংশ্লিষ্টরা দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করলেও দেড় দশক ধরে উপেক্ষিত রয়েছে এই দাবি। মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষণজন্মা পুরুষ। বার্ধক্যের কারণে দিনে দিনে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কমছে, চলেও গেছেন অনেকে। তারা জাতির এক ক্রান্তিলগ্নে নিজের জীবনের মায়াকে তুচ্ছ করে জাতিকে এনে দিয়েছিলেন মুক্তির স্বাদ, এনে দিয়েছিল স্বাধীন দেশ। মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগের বিনিময়ে প্রাপ্ত দেশে যদি মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান নিয়ে নিয়ে বিন্দুমাত্র ছিনিমিনি খেলা হয় তাহলে জাতি হিসেবে বিশ্বের দরবারে আমরা এক অকৃতজ্ঞ জাতিতে পরিণত হব। ভুলে গেলে চলবে না যে মুক্তিযোদ্ধাদের চোখ থেকে একফোঁটা অশ্রু নির্গত হওয়া মানে বাংলাদেশ নামক দেশের হৃদয় থেকে এক ফোঁটা রক্তক্ষরণ। তাদের সম্মান প্রদর্শনের জন্য অন্তত স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির আগেই একটি দিনকে ‘মুক্তিযোদ্ধা দিবস’ হিসেবে বাস্তবায়ন করা উচিত। বিজয়ের মাসের প্রথম দিন ‘মুক্তিযোদ্ধা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা সরকারের উচিত। দেশমাতৃকার বীর সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের এখনও যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা হচ্ছে না। ১ ডিসেম্বর জাতীয়ভাবে মুক্তিযোদ্ধা দিবস পালনের যে দাবি উঠেছে এই দাবি যৌক্তিক। যেহেতু ডিসেম্বর, অহংকার আর গৌরবের মাস; আমাদের বিজয়ের মাস। বাঙালির জাতীয়তাবোধের উন্মেষের সুদীর্ঘ ইতিহাসে অবিস্মরণীয় মাস ডিসেম্বর। এ মাসেই বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলো জাতীয় অহংকার বীর মুক্তিযোদ্ধারা। তাই ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিনটিকেই মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি স্বরূপ জাতীয়ভাবে ‘মুক্তিযোদ্ধা দিবস’ পালন করা উচিত। যদিও ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার দিন থেকে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের দীর্ঘ নয়টি মাসের প্রতিটি দিনই ছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের দিবস।

আমরা প্রতিদিন কত দিবসই পালন করি। তেমনি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যও একটি দিবস থাকলে তারা আরও বেশি সম্মানিত হবেন। মুক্তিযুদ্ধ দিবস জাতীয়ভাবে পালন করতে পারলে নতুন প্রজন্ম অন্তত এই দিনটিতে হলেও দেশের স্বাধীনতা অর্জনে মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকার কথা স্মরণ করবে। সরকারি ঘোষণা না থাকলেও বেসরকারিভাবে পহেলা ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা দিবস পালন করা হয়। একটা সময় আসবে যখন মুক্তিযোদ্ধারা থাকবেন না তখনও যাতে তাদের স্মরণ করা হয় সেজন্য মুক্তিযোদ্ধা দিবসটি সরকারিভাবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। সরকার যদি গেজেট করে একটা দিবস ঘোষণা করে তখন সেটা পালন করার বাধ্যবাধকতা থাকবে। জাতীয় বীরদের সঠিক মর্যাদা ও সম্মান দিতে না পারলে জাতির ইতিহাস ও অগ্রগতি থমকে যাবে। নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা, একটি স্বাধীন দেশের জন্য কতটা ত্যাগ-তিতিক্ষা-মূল্য দিতে হয়েছে সেই ইতিহাস তুলে ধরার জন্য ‘মুক্তিযোদ্ধা দিবস’ জাতীয়করণ করা প্রয়োজন। নতুন প্রজন্মকে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার দায়িত্ব নিতে হবে আমাদের সকলের। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে প্রতিটি বাঙালির। ৩০ লক্ষ শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হবে আমাদের সকলকে। মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিতে হবে, মুক্তিযোদ্ধা দিবসকে দিতে হবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। আগামী প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানানোর জন্য সরকার ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বর্তমান সরকার দীর্ঘ সময়েও মুক্তিযোদ্ধাদের এই দাবি মেনে না নেয়া দুঃখজনক ও হতাশা ব্যঞ্জক। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চলমান জন্মশতবার্ষিকীর মধ্যেই এখন থেকে বঙ্গবন্ধুর মানসসন্তান হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করে রাষ্ট্রীয়ভাবে ১লা ডিসেম্বরকে ‘মুক্তিযোদ্ধা দিবস’ ঘোষণা করে একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করবেন। নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা, একটি স্বাধীন দেশের জন্য কতটা ত্যাগ-তিতিক্ষা-মূল্য দিতে হয়েছে সেই ইতিহাস তুলে ধরার জন্য ‘মুক্তিযোদ্ধা দিবস’ জাতীয়করণ প্রয়োজন।

মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ
তথ্য ও গণসংযোগ সম্পাদক
বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম পরিষদ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি।
চেয়ারম্যান, বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম পরিষদ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।

Development by: webnewsdesign.com