আর কত সড়কে ঝরবে মানুষের প্রাণ

মঙ্গলবার, ২১ মার্চ ২০২৩ | ১:০৫ অপরাহ্ণ

আর কত সড়কে ঝরবে মানুষের প্রাণ
মোঃ আলী হোসেন সরকার, প্রধান সম্পাদক, দৈনিক বাংলাদেশ মিডিয়া
apps

সারাদেশে প্রতিদিন কোথাও না কোথাও সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। তা কোনোভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না। দুর্ঘটনা না হওয়াটাই যেন এক অলৌকিক বিষয়। একের পর এক ঘটছে দূর্ঘটনা মানুষ গন্তব্যে স্থানে যাওয়ার আগে মৃত্যু হচ্ছে। আর কত ঝরবে সড়কে প্রাণ, কত মায়ের বুক খালি হবে । কিছুক্ষণ পরপর যানবাহন থামে, কেউ কেউ ওঠে, কেউ কেউ নামে। কিন্তু আমাদের কপাল এতই মন্দ, আমরা আজকাল ভিন্ন ভিন্ন গন্তব্যে খুব কমই পৌঁছাতে পারি। অধিকাংশ সময়েই আমাদের পৌঁছাতে হয় একই গন্তব্যে।

আমাদের নিয়ে নিতান্তই স্বজন-পরিজন ছাড়া কারও কোনো শোক নেই, কষ্ট নেই, কান্না নেই। বড়জোর মুখস্থ এই বাণীটুকু আছে ‘গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করছি। শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা।’ কখনো কখনো এই বাণীর সঙ্গে যুক্ত হয় এই ঘোষণাটাও প্রত্যেক নিহতের পরিবারকে অত টাকা করে দেওয়া হবে। মানুষ মারা গেলে শুধু কথাই বলতে পারে না, তা নয়। হাততালিও দিতে পারে না। যদি হাততালি দিতে পারত, তা হলে নিশ্চয়ই ‘নিহতের পরিবারকে অত টাকা করে দেওয়া হবে’ টাইপের কথা শুনে হাততালি দিতে দিতে কব্জিব্যথা বাঁধিয়ে ফেলত। নিশ্চয়ই ভাবছেন, নিহতের স্বজনদের যে দানটা করা হয়, আমরা বুঝি এর বিপক্ষে  একদমই নয় অবশ্যই পক্ষে। কারণ কাফনের কাপড় কিনতে টাকা লাগে। আতর-গোলাব কিনতে টাকা লাগে। ‘আমার অমুক মারা গেছে’ এটা শুনে দোকানদার ওই মৃত ব্যক্তির স্বজনদের ব্যথার ব্যথী তথা সমব্যথী হয়ে চোখ মুছতে মুছতে মাগনা সব জিনিস দিয়ে দেয়, ব্যাপারটা এমন নয়। তার মানে টাকাটা দরকার।

অবশ্যই দরকার। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে লাশপিছু টাকা দেওয়ার রেওয়াজ, এটা কি চলতেই থাকবে? লাশ পড়া বন্ধ হবে না? মানুষ তো মরবেই। মরণশীল প্রাণী মরবে না? কিন্তু এভাবে কেন? কেন যানবাহন আমাদের স্বজন-পরিজনদের কাছে পৌঁছে না দিয়ে মৃত্যুর কাছে পৌঁছে দেবে? কেন আমাদের মাথা থাকবে না, হাত থাকবে না, পা থাকবে না? মাদারীপুরের শিবচরে রবিবার যে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে গেল, এই দুর্ঘটনা আমাদের ঘুম কেড়ে নেওয়ার কথা ছিল, স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অস্বাভাবিক করে তোলার কথা ছিল। কিন্তু আদৌ কি এমন কিছু হয়েছে? আমরা দিব্যি ঘুমাচ্ছি না? খাচ্ছি না? দাচ্ছি না? একমাত্র নিহত মানুষগুলোর পরিবার-পরিজন ছাড়া আমাদের কারও চোখে পানি আছে? ভাসা ভাসা দুঃখবোধ ছাড়া গভীর কোনো শোক আছে? নেই, থাকা সম্ভবও নয়। কারণ এসব দুর্ঘটনায় আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। এসব মৃত্যুর সঙ্গে আমরা পরিচিত।

আমরা যেন ধরেই নিয়েছি, ঘনবসতির এই বাংলাদেশে কিছু মানুষ হুটহাট মারা যেতেই পারে। কেন ধরে নিয়েছি? কারণ আমাদের কিছু করার নেই। আর যার কিছু করার থাকে না, তার একটাই করণীয় থাকেÑ পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া। আমরা ইতোমধ্যে নিজেদের শুধু পরিস্থিতির সঙ্গেই মানিয়ে নিইনি, মানিয়ে নিয়েছি মৃত্যুর সঙ্গেও। তাই লাশের সারি পাশে রেখে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে আমাদের কোনো সমস্যাই হচ্ছে না। তবে হ্যাঁ, যখন এই লাশ আর মৃত্যু নিয়ে কথা হচ্ছে, তখন আমরা ঠিকই সুর মেলাচ্ছি। আর আমাদের সুর মেলানো কথার সারমর্ম হচ্ছেÑ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে ড্রাইভারদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে। সত্য। তবে এটা মোটা দাগে সত্য। যদি আরও সূক্ষ্মভাবে ভাবা হয়, তা হলে বেরিয়ে আসে এমন কিছু, যা আমাদের অপরাধী বানিয়ে ফেলে।

একটা গাড়িতে যাত্রী থাকে পঞ্চাশ থেকে ষাট জন। ড্রাইভার যখন বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো শুরু করে, তখন এই পঞ্চাশ-ষাট জনেরই অস্বস্তিতে ভোগার কথা, আতঙ্কিত হয়ে পড়ার কথা। কিন্তু আদৌ কি সেটা হচ্ছে? বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি  হাতেগোনা দু-একজন যাত্রী প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেন। বলার চেষ্টা করেন এমন গতিতে গাড়ি চালানো ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের চেষ্টা কেবল ‘চেষ্টা’ পর্যায়ে থেকে যায়। ড্রাইভারের কান পর্যন্তও পৌঁছায় না তাদের বলা, তাদের গলা। অথচ যাত্রীরা সমস্বরে প্রতিবাদ জানালে ওই বেপরোয়া ড্রাইভার বাধ্য হবে স্বাভাবিক গতিতে গাড়ি চালাতে। বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে আরও বলছি অধিকাংশ যাত্রীই মনে মনে চান ঝড়ের গতিতে গাড়ি চলুক। কারণ গন্তব্যে পৌঁছানোর ভীষণ তাড়া তাদের। যতটা সময় বাঁচানো যায়। তাই পাশের যাত্রীটি ড্রাইভারের বেপরোয়া গতির বিরুদ্ধে কথা বলতে চাইলেও তিনি বা তারা নীরব থাকেন। অনেক সময় বিরক্ত হয়ে বলেন আরে ভাই, থাক না! ড্রাইভারকে তার মতো কাজ করতে দেন। আপনি আরাম করে ঘুমান।

আমরা প্রায়ই দেখি গাড়ির বেশিরভাগ যাত্রী ঘুমাচ্ছেন। আর এই সুযোগেরই শতভাগ সদ্ব্যবহার করছে ড্রাইভাররা। কেন? গাড়িতে উঠেই ঘুমাতে হবে কেন? কেন কড়া নজরদারিতে রাখা হবে না ড্রাইভার এবং তার সহযোগীদের গতিবিধি? আপনি আপনার বাসার কাজের মানুষের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখেন, সে ঠিকঠাক কাজ করছে কিনা দেখেন, অথচ ড্রাইভার যখন আপনার জীবন নিয়ে খেলে, তখন আপনি দিব্যি ঘুমান। কেউ প্রতিবাদ করার চেষ্টা করলে ধরে নেন আপনার ঘুমের ‘ডিস্টার্ব’ হচ্ছে। অবশেষে যা হওয়ার, তাই হয়। আর ড্রাইভারদের ব্যাপারে কী বলব? বলতে বলতে আমরা ক্লান্ত। আমাদের জিহ্বা কিংবা ঠোঁট আর সেভাবে সায় দেয় না। কারণ আমরা বুঝে গেছি, তারা কখনই শোধরাবে না। জেল দেবেন? ফাঁসি দেবেন? তাতেও যেন পরোয়া নেই তাদের।

আবার তাদের ছাড়া চলছেও না। তার মানে আমরা উভয় সংকটে অবস্থান করছি। এই সংকট সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসার একটাই রাস্তা ব্যক্তিগত সচেতনতা। একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর অমুকের জেল, তমুকের ফাঁসি, তমুকের পরিবারকে অত টাকা দান এসবে মূলত তেমন কোনো কল্যাণ নিহিত থাকে না। মৃত্যু কিংবা লাশের বিপরীতে আবার কিসের কল্যাণ? তাই আমাদের প্রতি সেকেন্ডের নজরদারি ছাড়া কোনো উপায় নেই। কারণ জীবনটা আমাদের। আজ আমরা না থাকলে যারা কাঁদবে, সেই স্বজনগুলোও আমাদের।

ড্রাইভারেরও নয়, কথায় কথায় শোকবাণী দেওয়া মানুষগুলোরও নয়। তাই আমাদের জীবনের স্বার্থে, স্বজনদের মুখে হাসি অব্যাহত রাখার স্বার্থে চলুন সচেতন হই, সতর্ক থাকি। প্রয়োজনবোধে যানবাহন ছাড়ার আগে সবাই মিলে বিশেষজ্ঞ বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মাধ্যমে জেনে নিই, বুঝে নিই যান্ত্রিক কোনো ত্রুটি আছে কিনা। মোট কথা যতভাবে সতর্ক থাকা যায়, নিজেদের নিরাপদে রাখা যায়। সতর্ক বা সচেতন হতে পারলে ড্রাইভার এবং তার সহযোগীরা সতর্ক এবং সচেতন হতে বাধ্য।

Development by: webnewsdesign.com