ওরা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সোর্স! সাধারণ মানুষের কাছে এক আতঙ্কের নাম। ওদের চাহিদামত দাবি পূরণ না হলে, যে কাউকে ফাঁসাতে পারে। শুধু তাই নয়, হত্যা-খুন-চাঁদাবাজিতেও পারদর্শী। আর নানা অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশের হাতে ধরা পড়েই ওরা হচ্ছে সোর্স। ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সোর্সদের পাশাপাশি কতিপয় মাঠপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্য জড়িত রয়েছেন। পুলিশের সোর্সসহ মাদক ব্যবসা যারা করেন, তাদের তথ্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জানেন। কিন্তু অদৃশ্য শক্তির কারনে সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন না। সারা দেশের মাদক ব্যবসায়ী ও তাদের পৃষ্ঠপোষক গডফাদারদের বিরুদ্ধে অভিযান চলমান। তবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা হাতেনাতে মাদক উদ্ধার করা ছাড়া কাউকে গ্রেফতার করতে না পারার সীমাবদ্ধতায় মাদক ব্যবসায়ী বা ইয়াবা বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িতরা গ্রেফতার এড়িয়ে যেতে সক্ষম হচ্ছে। সূত্র জানায়, মাদক ব্যবসায়ীরা এখন নতুন নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করে মাদকপাচার করছে। তাদের গডফাদাররা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকে। এক কৌশল ধরা পড়লে আরেক কৌশল ব্যবহার করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে নতুন নতুন কৌশল ব্যবহার করছে।
রাজধানীর বনানী থানার অধিনস্থ মহাখালী মধ্যপাড়ায় নূরানী মসজিদের পাশের গলির নিজ বাড়ীতে আবদুল আলীর ছেলে শরীফ ওরফে পাগলা শরীফের মাদক স্পট। এই মাদক স্পটে মাদকসেবীদের আনাগোনার কারনে এলাকাবাসী অতিষ্ঠ। এলাকায় ক্রমেই বাড়ছে মাদক সেবকের সংখ্যা। বাড়ছে অপরাধ ও চুরির ঘটনা। জানা গেছে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অভিযানে শরীফ এ পর্যন্ত চারবার ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার হয়। চারবারই বনানী থানার অধীনে তাকে মামলা দিয়ে জেলে পাঠানো হয়। প্রতিবারই জামিনে বেরহয়ে তিনি ইয়াবা ব্যবসা চালিয়ে যান। মহল্লায় কথিত আছে যে শরীফ বনানী থানার এসআই আবু তাহের ভূঁইয়ার সোর্স। এবং তিনি বনানী থানায় সাপ্তাহিক চাঁদা দিয়ে মাদক ব্যবসা করেন, তাই বনানী থানা পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে না। সর্বশেষ গত বছরের কুরবানী ঈদের আগে শরীফকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠালে ঈদের পরে জামিনে বের হয়ে সে মাদক ব্যবসার কৌশল পাল্টেছে। আগের চেয়ে অনেক সতর্ক হয়েছে। এখন তার খুব ঘনিষ্ট মাদক সেবকরাই ফোনে যোগাযোগ করে বাড়ীতে ঢুকতে পারে। বাড়ীতে ঘনঘন প্রসাশনের অভিযান থেকে নিজেকে বাঁচাতে সেলারসহ বাড়ীর আশেপাশে পাহারা দিতে লোক নিয়োগ দিয়েছেন।
মহাখালী মধ্যপাড়ার বাসিন্দা জসিম বলেন, শরীফের কাছ থেকে ইয়াবা কিনতে আসা মাদকসেবকদের আনাগোনায় মহল্লাবাসী অতিষ্ঠ। লোভে পড়ে মহল্লার উঠতি বয়সের ছেলেরা শরীফের ইয়াবা বিক্রি করে তাদের জীবন ধ্বংস করছে।
অন্যদিকে কড়াইল বস্তিতে মাদক ব্যবসার মহাজন খ্যাত বনানী থানা পুলিশের সোর্স শহীদ। তাকে নিয়ে থানার পুলিশও বিব্রত অবস্থায় রয়েছে বলে একাধিক পুলিশ নিশ্চিত করেছে। সূএ বলছে, বনানী থানার কিছু অসাধু পুলিশ তাদের স্বার্থে শহীদকে ব্যবহার করছে। তাই তার মাদক ব্যবসার বিষয়ে থানার সব পুলিশ অবগত থাকলেও তাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। এছাড়া পুলিশরাই তাকে দিয়ে মাদক ব্যবসা করাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা।
এছাড়া অভিযোগ আছে, বনানী, গোডাউন বস্তি, কড়াইল বস্তি, মহাখালী ও চেয়ারম্যানবাড়ী এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টে ইয়াবা ব্যবসা, চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, পতিতালয়, জুয়ার আসর, চোরাই তেলকারবারী, ফুটপাত, ভাসমান হকার, হিজড়াদের চাঁদাবাজি, অন্যায়ভাবে মামলা দেয়া, আসামি ধরা, আসামি ছাড়াসহ অনেক অবৈধ কর্মকান্ডই সোর্স শহীদের ইশারায় করা হয়। অদৃশ্য শক্তির কারণে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না বলে জানা যায়।
সোর্স শহীদের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করায় প্রতিবেদককে মোবাইল ফোনে হুমকি প্রদান করা হয়। কল রেকর্ড প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত আছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০৫ সালে বনানী আমতলী ২নং রোডের হিন্দুপাড়া বস্তি থেকে অবৈধ পিস্তল, গুলি ও বিস্ফোরক দ্রব্যসহ শহীদকে গ্রেফতার করেছিল র্যাব-১। এই মামলায় সাজা খেটে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর থেকেই পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। বনানী-গুলশান থানা পুলিশের ব্যক্তিগত গাড়ির ড্রাইভার হিসেবেও কাজ করেছে শহীদ। পুলিশের নাম ভাঙ্গিয়ে বনানী গোডাউন বস্তিতে বেশকিছু ঘরও দখল করে নিয়েছেন। তিনি পুলিশের সহযোগিতায় সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে মাদক ব্যবসা করেন। সোর্স শহীদের ঘরে প্রতিদিন মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত পুলিশের আনাগোনা লক্ষ্য করা যায়। তারা এখানে মাদক সেবন ও অবৈধ টাকা ভাগ বাটোয়ারা করেন বলে স্থানীয় সূএে জানা যায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বনানী থানার একজন এসআই বলেন, স্বার্থের জন্য শহীদকে কিছু পুলিশ কর্মকর্তা সোর্স হিসেবে ব্যবহার করছে। সে নিজেও মাদক ব্যবসা ও অপরাধের সাথে জড়িত, এ বিষয়ে মোটামুটি থানার সবাই অবগত আছেন। এছাড়া শহীদের নামে অভিযোগ থাকলেও মূলত স্বার্থের জন্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়না।
২০১৮ সালে মে মাসের শেষে ৬০পিছ ইয়াবাসহ বাড্ডা থানায় গ্রেফতার হয়েছিলেন বনানী থানা পুলিশের সোর্স ও মহাখালী এলাকার মাদক ব্যবসায়ী মানিক। তিনি সোর্স শহীদের সহযোগী। অনুসন্ধানে জানা গেছে, গ্রেফতার হওয়ার আগে মানিক মহাখালী পুরাতন বাজারে ‘মা ইলেকট্রনিক্স’ নামক দোকানে কৌশলে ইয়াবা ব্যবসা করতেন। জেল থেকে জামিনে বের হওয়ার পর দোকানটি ছেড়ে দিয়ে এখন তিনি পাঠাও চালকের ছদ্দবেশে ভ্রাম্মমান ইয়াবা ব্যবসায়ী। জানা গেছে, মানিক মহাখালী ছাড়াও দক্ষিনখান ও তেঁজগাওতে ইয়াবা ব্যবসা করেন।
অপরদিকে আরেক মাদক ব্যবসায়ী ড্রাইভার কাশেম। মহাখালী ওয়্যারলেছ গেইটে ২০নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয় সংলগ্ন বুলুর বাড়ীর গাড়ি চালক তিনি। বনানী থানা পুলিশের সোর্সের কাজও করেন। মোবাইলে যোগাযোগের মাধ্যমে কৌশলে করেন ইয়াবা ব্যবসা। স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, প্রতিদিনই বাড়ীটির সামনে এবং আশেপাশে মাদকসেবীদের সাথে কাশেমকে সাক্ষাত করতে দেখা যায়। কখনো মাদকসেবীদের বাড়ীটির গেইটের সামনে দাড়িয়ে থাকতে দেখা যায় আবার কখনো ডেকে নিয়ে যান বাড়ীর ভেতরে। কথার ফাঁকেই সেরে ফেলেন আর্থিক লেনদেন এবং হাতে তুলে দেন চাহিদা মতো ইয়াবা নামক মাদক।
অনুসন্ধানে মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত বনানী থানা পুলিশের যেসব সোর্সদের নাম উঠে এসেছে- মহাখালী বেদে বস্তির বাইট্টা সুমন, টিবি গেট এলাকায় রকি, মহাখালী প্রানী সম্পদ গবেষনা প্রতিষ্ঠান এলাকায় নাটা ইউসুফ, গোডাউন বস্তির হারুন, মফিজ ও ভাগিনা রিদয়।
Development by: webnewsdesign.com