সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল অনিয়মই যেখানে নিয়ম

মঙ্গলবার, ০৮ মার্চ ২০২২ | ৬:২৮ অপরাহ্ণ

সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল অনিয়মই যেখানে নিয়ম
apps

মাত্র ক’দিন আগের কথা। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগে দাঁড়িয়ে আছেন রাবেয়া বেগম। বয়স পঞ্চাশের বেশি। লিভারের চিকিৎসক দেখাতে একাই এসেছেন মিরপুর থেকে। চিকিৎসক না থাকায় তার চেহারায় বিরক্তির ছাপ। যায়যায়দিনকে তিনি বলেন, ‘আধা ঘণ্টার ওপর দাঁড়িয়ে আছি। ডাক্তার কখন আসবে জানি না। আপনি যদি হাসপাতালের কেউ হন, তাহলে একটা ফোন করে ডাক্তারকে ডাকেন। আমার শরীর ভালো লাগছে না।’ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের বহির্বিভাগের বেশিরভাগ চিকিৎসকই সময়মতো আসেন না এই অভিযোগ দীর্ঘদিনের। তার প্রমাণও পাওয়া যায় হাসপাতালটিতে ঘুরে। সরেজমিন বহির্বিভাগ ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি বিভাগেই কোনো না কোনো চিকিৎসক সময়মতো আসেন না। যদিও তাদের আসা-যাওয়া নিশ্চিত করতে ডিজিটাল হাজিরার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু এটিকেও গুরুত্ব দিচ্ছেন না চিকিৎসকরা। সিনিয়র চিকিৎসকদের বিরুদ্ধেই বেশিরভাগ অভিযোগ।

২২ ফেব্রম্নয়ারি সকালে গাইনি বিভাগের সামনে যেতেই প্রচুর রোগীর ভিড় দেখা যায়। এখানে স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি উপেক্ষিত। লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থেকে বিরক্ত রোগীরা। তবে যারা সেখানে কর্মীদের টাকা দিয়েছেন তারা আগে ডাক্তার দেখাতে পেরেছেন বলে অভিযোগ রোগীর স্বজনদের। মধ্য পাইকপাড়া থেকে আগত আল আমিন বলেন, গত দুই দিন ধরে এই হাসপাতালে ঘুরপাক খাচ্ছি। রোগীকে ডাক্তার দেখাতে আলাদা করে টাকা দিতে চাই না তাই দাঁড়িয়ে আছি। তবে আল্ট্রাসোনোগ্রাম করতে দুশ’ টাকা দিতে হয়েছে। এজন্য আমরা একটু দ্রম্নত ও ঝামেলা ছাড়া করাতে চেয়েছি। টাকা কে নিয়েছে এমন প্রশ্নে নাম না বললেও তিনি বলেন, ১৬০, ১৬১, ১৬২ এসব রুমের সামনে গেলেই দেখবেন টাকা নিচ্ছে। হাসপাতালের লোকজনই নেয়। তাদের হাতে ধরিয়ে দিলেই দ্রম্নত টেস্ট করানো যায়। ইসিজি, ইকো, আল্ট্রাসোনোগ্রাম, এক্সরে ইত্যাদি রিপোর্ট করাতে ১০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। তাহলেই দ্রম্নত সেবা মিলে যাবে। আরেক রোগীর স্বজন মোহম্মদ রিপন বলেন, ‘রোগী হাঁটতে পারছিলেন না। হাসপাতালের সামনেই কিছু মহিলা দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের সহযোগিতা নিয়ে রোগীকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে আসি। এজন্য আমাকে আলাদা করে টাকা গুনতে হয়েছে। যদিও আমি দিতে চাইনি কিন্তু ওই মহিলা এক প্রকার জোর করেই টাকা নিলেন। এখানে চিকিৎসা ভালো তবে ভোগান্তি অনেক। আর এসব মহিলার দৌরাত্ম্য বেশি’।

হাসপাতালের ১১০ নম্বর রুমে নেওয়া হয় বস্ন্যাডের স্যাম্পল। এখানে লোকের দীর্ঘলাইন। নারী-পুরুষ পাশাপাশি লাইন হলেও চাপাচাপি করে দাঁড়িয়ে স্যাম্পল দিচ্ছেন। অথচ পাশেই আরেকটি খালি রুম পড়ে আছে, যেখানে বস্ন্যাড নেওয়ার সব ব্যবস্থাই করা ছিল। স্বাস্থ্যবিধি হাসপাতালের কর্মচারীরাই মানছেন না বলে অভিযোগ করেন সোহান হাওলাদার। তিনি বলেন, ‘এখানে যার যার ইচ্ছামতো কাজ করে। মানুষের কোনো দামই নাই নার্সদের সামনে। তারা যা-তা ব্যবহার করে রোগীদের সঙ্গে। কিন্তু এসব দেখার কেউ নাই। দুইটা আলাদা জায়গা থাকতেও একই স্থানে সবার বস্ন্যাড কালেক্ট করছেন তারা। আলাদা জায়গায় করলে তাদের একটু কষ্ট হবে ও কাজের চাপ বাড়বে তাই একই স্থানে সবাইকে ঠাসাঠাসি করে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।’ হাসপাতালটিতে এক্সরে, ইসিজি, আল্ট্রাসোনোগ্রাম ইত্যাদি করা হয় ১৬০, ১৬১, ১৬২ নম্বর রুমে। এই রুমগুলোর সামনে একে অন্যের সঙ্গে গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কেউ চিৎকার করে অভিযোগ করছিলেন। কয়েকদিন হলেও তারা তাদের ইসিজি রিপোর্ট বুঝে পাননি। এটি আজকে না পেলে আবার আগামী সপ্তাহে ডাক্তার দেখাতে আসতে হবে। এসময় ৬৫ বছর বয়সি ইমাম উদ্দিনের সঙ্গে আসা স্বজনরা বলেন, ‘আমরা যে ডাক্তার দেখাই তিনি মঙ্গল, বুধ ও শনিবার বসেন। আজকে (২৩ ফেব্রম্নয়ারি) প্রায় একটা বেজে গেছে। এখনো রিপোর্ট পাইনি। তাহলে আবার আগামী সপ্তাহে আসতে হবে।

মিরপুর এক নম্বর থেকে এই রোগী নিয়ে এতদূর আসা খুবই কঠিন কাজ। কিন্তু এরা তা বোঝেন না। মনে করেন রোগী এসে দাঁড়িয়ে আছে তো কি হয়েছে। কারও প্রতি তাদের সহানুভূতি নেই।’ হাসপাতলের ভেতরে প্রচুর রোগী। ওয়ার্ডের বাইরেও রোগীদের রাখা হয়েছে। বেড দেওয়া হয়েছে কিন্তু ওয়ার্ডের বাইরে। এই শীতের মধ্যে তাদের যেন দেখার কেউ নেই। এ বিষয়ে হান্নান মিয়া বলেন, আমরা চারদিন ধরে এখানেই পড়ে আছি। ওয়ার্ডের ভেতরে ঢুকতে পারছি না। কিন্তু কিছু লোক এক হাজার বা পনেরশ টাকা দিয়ে ওয়ার্ডের ভেতরে সিট পেয়ে যাচ্ছে। এসব টাকা ওয়ার্ড বয় ও বুয়ারা নিয়ে নেয়। এরপর তারাই ফাইল নিয়ে গিয়ে সিট ব্যবস্থা করে দেয়। হাসপাতালের দ্বিতীয়তলায় হাশেম আলী বলেন, ‘হাসপাতাল নিয়ে অনেক অভিযোগ আছে। টয়লেট ভালো না। নার্স-আয়াদের ব্যবহার ভালো না। কিন্তু এতকিছুর মধ্যেও চিকিৎসা ভালো। আর এজন্যই সরকারি হাসপাতালে আমরা আসি। বেসরকারি হাসপাতালে এত ভালো চিকিৎসা হয় না। সেখানে সবকিছু পরিষ্কার পাওয়া যায়। তারপরও বেসরকারি হাসপাতালের চাইতে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা অনেক ভালো। টাকাও কম লাগে এখানে। কিছু সিস্টেম করে চলতে পারলে খুব ভালো চিকিৎসা পাওয়া সম্ভব এখানে।’

সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালটিতে বর্তমানে রোগী ভর্তির সংখ্যা সাড়ে আটশ। এই রোগীদের বিভিন্ন ফ্লোরে ওঠানো আর নামানোর জন্য আছে মাত্র একটা লিফট। তাও আবার চারদিন ধরে নষ্ট। এই লিফটে আটকা পড়েছিলেন হাসপাতালের রোগী ও স্বজনরা। তারা ত্রিপল নাইনে ফোন করেন। এরপর ফায়ার সার্ভিস এসে দরজা কেটে বের করে তাদের। হাসপাতালটির কর্তৃপক্ষ থাকলেও লিফট রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব রয়েছে পিডবিস্নউডি।

এসব বিষয়ে কথা বলেন হাসপাতালের পরিচালক ডা. মোহম্মদ খলিলুর রহমান। তিনি বলেন, ‘এই হাসপাতালটির অনেক সমস্যা আছে। কিন্তু সমস্যা থাকলেও চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। চিকিৎসায় কোনো সমস্যা নেই বলে আমি মনে করি। রোগীদের অতিরিক্ত চাপ থাকলেও আমরা কিন্তু চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছি। কেউ বলতে পারবে না আমাদের থেকে চিকিৎসা না পেয়ে হাসপাতাল ছাড়তে হয়েছে।’ হাসপাতালে রোগীদের কাছ থেকে আয়া-বুয়াদের টাকা নেওয়ার বিষয়টা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আমরা এদের ঠিক করতে কাজ করছি। রোগীদের আমরা সব সময় বলি যাতে এদের টাকা না দেয়। কিন্তু তারপরও টাকা লেনদেন হয়। এই কর্মীরা কেন টাকা নেয় সেটিও বোঝা যাচ্ছে না। আমাদের কাছে কেউ অভিযোগও করেন না। যদি লিখিত অভিযোগ পাই তবে অবশ্যই এদের চাকরি থাকবে না। তাদের হাসপাতল থেকে বিতাড়িত করা হবে। দালালদের দৌরাত্ম্যের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘হাসপাতালের ভেতরেও দালালরা ঢুকে পড়ে। এদের ধরতে আমরা পুলিশর্ যাবের সহযোগিতা নেই। ধরার পর তাদের জেলে পাঠানো হয়। আবার তারা ছাড়া পেয়ে চলে আসে হাসপাতালের ভেতরে। সাদা পোশাকে পুলিশ কাজ করে। আমাদের আনসার আছে। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি কিন্তু দালালদের আটকাতে পারছি না।’ চিকিৎসকরা সময় মতো হাসপাতালে আসেন না বিষয়টি তিনি নিজেও জানেন। বলেন, ‘আমি ডিজিটাল হাজিরা সিস্টেম চালু করেছি। এরপরও অনেক ডাক্তারই সময় মতো আসেন না। আমি তো সবাইকে জোর করে ধরে আনতে পারব না। তাদের পারি শুধু বলতে। আর আমি যে ভিজিটে যাব সেটারও সুযোগ নাই। অফিসে ঢোকার পর থেকে বিভিন্ন লোকের সমস্যা সমাধান করতে করতে আমার দিন শেষ। তবে আমি খুব শিগগির কিছু কাজ অন্য কর্মকর্তাদের দিয়ে কিছুটা ফ্রি হওয়ার চেষ্টা করব। তখন আমি নিজেই ভিজিটে যাব। যাদের সময়মতো হাসপাতালে পাব না তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’ তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যে তিনজন টিকিট কাউন্টার কর্মীকে শোকজ করেছি দেরি করে হাসপাতালে আসার কারণে। রোগীর আসবে ভোরবেলা আর কাউন্টার কর্মীরা আসবে দেরি করে তা হবে। ডাক্তারদের ক্ষেত্রেও একই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে খুব অল্প সময়ের মধ্যে।’ হাসপাতালে লিফট বন্ধ হয়ে পড়ে আছে রোগীদের খুব দুর্ভোগ হচ্ছে। কিন্তু আমার হাতে কিছুই করার নেই বলে জানান এই পরিচালক। তিনি বলেন, ‘আমাদের রক্ষণাবেক্ষণে এই লিফট না। এটি দেখাশোনার দায়িত্ব পিডবিস্নউডির। তারা আমাদের জানিয়েছে দু-একদিনের মধ্যে এটি ঠিক করে দেওয়া হবে। এই হাসপাতালে ছয়টি লিফট বসবে। তখন আর কারও সমস্যা হবে না। একটা লিফটে বেশি চাপ পড়ায় দ্রম্নত নষ্ট হয়েছে।’

Development by: webnewsdesign.com