হারিয়ে যাচ্ছে বরগুনার খেজুরের রস

রবিবার, ০২ জানুয়ারি ২০২২ | ৯:১১ অপরাহ্ণ

হারিয়ে যাচ্ছে বরগুনার খেজুরের রস
apps

বাংলাদেশ বৈচত্রময় এক আবহাওয়ার দেশ। আমাদের রয়েছে ছয়টি বৈচিত্রময় ষড়ঋতু। আর এই প্রত্যেক ঋতুর রয়েছে আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য। এমনই একটি অন্যতম ঋতু হচ্ছে শীতকাল৷ আর শীত আসলেই সবার আগে সামনে আসে খেজুর গাছ আর গাছ থেকে রস সংগ্রহকারী গাছিরা। তবে কালের বিবর্তনে গাছ কাটার ফলে হারাতে বসেছে ইতিহ্যবাহী খেজুরের রস।

শীত আসলেই একসময় ব্যস্ত সময় পার করতো বরগুনার খেজুরের রস সংগ্রহকারী গাছিরা। তীব্র শীত উপেক্ষা করে অতি ভোরে ঘুম থেকে উঠে দা-খোল (গাছিদের সরঞ্জাম) নিয়ে বেরিয়ে পড়ত গাছিরা। বেলা বাড়লে মিষ্টি রোদে রাস্তার পাশে বসে রস বিক্রি করত বরগুনার গাছিরা। তবে সময়ের পরিক্রমায় আধুনিক নগরায়নের ফলে হারিয়ে যাচ্ছে খেজুর গাছ এবং গাছের রস। এখন আর দেখা পাওয়া যায়না গাছিদের দল বেধে রস বিক্রির হাক-ডাক।

শীত মৌসুমের শুরুতেই বরগুনার বিভিন্ন এলাকায় খেজুর গাছের রস সংগ্রহের কাজে ব্যাস্ত সময় পার করেন গাছিরা। এক সময় এই পেশার ওপর অনেক মানুষ নির্ভরশীল ছিল। তবে আগের তুলনায় বর্তমানে খেজুর গাছের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে যাওয়ায় এই খেজুরের রসের ঐতহ্যি দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে।

খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের নিয়ম হলো প্রথমে খেজুর গাছের মাথার কিছু অংশ ভালো করে পরিস্কার করে গাছের ভেতরের রস বের করার জন্য গাছের সাদা অংশ ধারালো দা দিয়ে কেটে বের করতে হবে। এরপর পরিস্কার করা সেই সাদা অংশে ছাঁচ কেটে বাশের তৈরী নল বসাতে হয়। এরপর ছোট-বড় মাটির হাড়ি, ঘটি, কলসি বোতল ইত্যাদি দিয়ে রস সংগ্রহ করা হয়। ছোট বড় বিভিন্ন রকমের খেজুর গাছে অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে গাছিদের কোমরে মোটা রশি বেঁধে গাছে ঝুলে খেজুর গাছের রস সংগ্রহের কাজ করতে হয়। গাছিরা প্রতিদিন বিকেলে খেজুর গাছের সাদা অংশ পরিস্কার করে ছোট-বড় হাড়ি বাঁধে রসের জন্য। সারারাত ধরে রস জমে হাড়িতে।

আবার অতি ভোরে গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে নিয়ে যায় বিভিন্ন এলাকায়। কেউ কেউ এই রস এলাকার বিভিন্ন স্থানে ও হাট-বাজারে খাওয়ার জন্য বিক্রয় করে। আবার কেউ সকালেই এই রস দিয়ে বিভিন্ন রকমের পাটালি গুড় তৈরী করার কাজ শুরু করেন। গ্রামের অনেক মানুষ শীতের সকালে সুস্বাদু এই খেজুরের রস ও খেজুর রসের তৈরি গুড় নেয়ার জন্য অপক্ষোয় থাকে।

সাধারণত একটি খেজুর গাছ রসের পরিপক্ক হতে প্রায় ৫-৭ বছর সময় লেগে যায়। আর একটি গাছ থেকে রস পাওয়া যায় ৩০-৩৫ বছর পর্যন্ত। তবে প্রতিটি গাছ থেকে কি পরিমাণ রস পাওয়া যাবে তা নির্ভর করে গাছির দক্ষতা, মাটি এবং গাছের উপর।

সদরের বুড়িরচর গ্রামের গাছি হুমায়ুন কবিরবলেন, আগে অনেক গাছ থেকে রস সংগ্রহ করতাম, কিন্তু এখন গাছও নাই তেমন রসও সংগ্রহ করতে পারিনা। ৪ টা গাছ কেটেছি শুধু নিজের পরিবারের খাওয়ার জন্য। গাছ তো নাই তাই আগের মত রস সংগ্রহ সম্ভব হচ্ছেনা, এজন্য বাইরে বিক্রি করা যাচ্ছেনা।

খালগোড়া গ্রামের বারেক আলী নামে আরেক গাছি বলেন, প্রায় ৩০-৩৫ বছর ধরে রস সংগ্রহ করে আসছি। পূর্বের তুলনায় দিন দিন খেজুর গাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। অনেক জমির মালিকরাই গাছ কেটে ফেলছে। এতে আমরা আর্থিক ভাবে অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছি। বাজারে রসের ব্যাপক চাহিদা থাকলেও রস দিতে পারছিনা।

শিংড়াবুনিয়া গ্রামের আরেক গাছি শহীদ হাওলাদার বলেন, আগে শীতের শুরুতেই গাছ কাটার কর্মজজ্ঞ শুরু হত। প্রচুর গাছ ছিলো। সকালে কলসভর্তি রস নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করতাম। কিন্তু এখন আর গাছও নেই আর রসও নাই। তাই পেশা পরিবর্তন করে ব্যবসা শুরু করেছি।

বরগুনার কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবদুর রশীদ বলেন, সাধারণত যারা শারীরিক দুর্বলতায় ভোগেন, খেজুরের রস তাদের জন্য দারুণ উপকারী। খেজুরের রস প্রচুর খনিজ ও পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ। তবে বর্তমানে অবাধে খেজুর গাছ নিধন করা হচ্ছে। এসব গাছ জ্বালানি হিসেবে যাচ্ছে ইটভাটায়। আমরা খেজুর গাছ রোপনে কৃষকদের উৎসাহিত করছি।

খেজুরের রস একটি উপকারী পানীয়। এতে রয়েছে প্রচুর এনার্জি বা শক্তি। এই রসকে প্রাকৃতিক এনার্জি ড্রিং ও বলা যেতে পারে। এই রসে গ্লুকোজের পরিমাণ বেশি থাকে। খেজুরের রস কাঁচা খাওয়া যায়, আবার জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করেও খাওয়া যায়। গুড়ে প্রচুর পরিমান আয়রন থাকে যা হিমোগ্লোবিন তৈরিতে সহায়তা করে।

 

Development by: webnewsdesign.com