সৌদি আরবে মাদক পাচারে ব্যবহৃত হয় দরিদ্র পাকিস্তানিরা

মঙ্গলবার, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২০ | ২:১৯ অপরাহ্ণ

সৌদি আরবে মাদক পাচারে ব্যবহৃত হয় দরিদ্র পাকিস্তানিরা
apps

আবদুল হক নিজের ছেলেকে শেষবারের মতো দেখেছিলেন ১০ বছর আগে। তারুণ্যে ভরপুর ওই যুবক তখন নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছিলেন। সৌদি আরবে কাজের ভিসা ও লোভনীয় কাজ- দুটোই অপেক্ষা করছিল তার জন্য। বিদেশযাত্রার জন্য নিজের জীবিকা উপার্জনের একমাত্র সম্বল রিকশাটা বিক্রি করে দিয়েছিলেন তিনি, নতুন জীবন শুরুর আশায়। পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের সারগোদা শহরের দরিদ্রতা থেকে মুক্তির খোঁজ করছিলেন হকের ছেলে।কিন্তু সে আশায় গুঁড়েবালি পড়ে যায় দ্রুতই। ভালো সময়ের যে অপেক্ষা তার পরিবারের ছিল তা চূর্ণ হতে সময় লাগেনি খুব। সৌদি আরব যাওয়ার পরপরই ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায় আবদুল হকের।দীর্ঘসময় পর সৌদির এক কারাগার থেকে ধার করা মোবাইলে ফোন দিয়েছিল ছেলে।

জানায়, তাকে মাদক পাচারের অপরাধে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পাকিস্তানে যারা তার ভিসার ব্যবস্থা করেছিল তাদের নির্দেশনা মানতে গিয়েই এই বিপদের সম্মুখীন হয়েছেন তিনি। পাঞ্জাব থেকে সরাসরি সৌদি যাওয়ার আগে তাকে করাচি যেতে বলেছিল তারা। সেখানে তার ব্যাগে একটি ছোট্ট প্যাকেট লুকিয়ে সৌদি নিয়ে যেতে বলা হয়। কিন্তু সৌদি পৌঁছবার পর ধরা পড়ে যায় সে।

জানা যায়, ওই প্যাকেটটিতে ছিল ‘হেরোইন’। এ ঘটনা ১০ বছর আগের। আবদুল হকের ছেলে এখন সৌদিতে মৃত্যুদণ্ডের আসামি। বৃদ্ধ হক বলেন, তারা আমাদের দরিদ্রতার সুযোগ নিয়েছে।সৌদি আরবে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় রফতানিগুলোর একটি হচ্ছে শ্রমিক পাঠানো। কয়েক দশক ধরে দরিদ্র পাকিস্তানিরা সেদেশে যায় ভাগ্য পরিবর্তনের আশায়। সেখানে পাকিস্তানিদের সংখ্যা প্রায় ২৭ লাখ। অন্য যেকোনো বিদেশি নাগরিকদের চেয়ে সৌদিতে তারা সংখ্যায় বেশি। সৌদি থেকে পাকিস্তানের রেমিট্যান্স চলতি বছরে ২৬০ কোটি ডলার পৌঁছানোর কথা রয়েছে। পাকিস্তানের অর্থনীতিতে সৌদি প্রবাসীদের ভূমিকা বেশ বড়। কিন্তু অধিকারকর্মীরা জানান, তা সত্ত্বেও এসব শ্রমিকদের অপব্যবহারের শিকার হওয়া থেকে বাঁচাতে সরকার তেমন কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না।সৌদির জেলগুলোয় প্রায় ৩ হাজার ২০০ পাকিস্তানি আটক রয়েছে। এদের অনেকেই মাদক সংশ্লিষ্ট অপরাধের আসামি। আবদুল হকের ছেলের মতো এরকম ঘটনাও অগণিত। জোর খাটিয়ে, ঋণের বোঝায় আটকে, প্রতারণা করে বহু পাকিস্তানিকে মাদক পাচারের জন্য ব্যবহার করা হয়। অসহায় কারাবন্দিদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন জাস্টিস প্রজেক্ট পাকিস্তান (জেপিপি)- এর সারা বিলাল বলেন, এ মানুষগুলো হচ্ছে চুনোপুঁটি। এরা কীভাবে পড়তে হয় তাও জানে না, কখনো দেশের বাইরে যায়নি, পাসপোর্ট কী তা জানে না। সরকার সক্রিয়ভাবে এদের বিদেশে কাজ করতে যেতে উৎসাহিত করে। সেদিক বিবেচনায়, তারা যেন নির্যাতনের শিকার না হয় সেদিকটাও সরকারের নিশ্চিত করা উচিত।

কাগজে-কলমে উপসাগরীয় দেশগুলোয় কর্মী পাঠানোর দায়িত্বে থাকা সংস্থাগুলো নিয়ন্ত্রণ করে সরকার। কিন্তু চর্চার ক্ষেত্রে, অনিবন্ধিত ও নির্লজ্জ দালালদের একটি নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে রয়েছে পাকিস্তানের প্রত্যেক গ্রামে। তাদের হাত থেকে রেহাই পায় না তীর্থযাত্রীরাও। এমন এক শিকার হচ্ছেন মেহবুব আলমের মা। আলম বলেন, ২০১৭ সালে তার গ্রামের এক লোক তার মাকে মক্কা সফরের প্রস্তাব দেয়। কেউ একজন তার ব্যাগে হেরোইন ঢুকিয়ে দিয়েছিল। তার মাকে ১৫ বছরের সাজা দেয় সৌদি কর্তৃপক্ষ।
নিজের সরকারের কাছ থেকে খুব একটা সহায়তা পায় না সৌদিতে বন্দি থাকা পাকিস্তানিরা। সারা বিলাল অভিযোগ করেন, কূটনীতিবিদরাও এ ব্যাপারে তেমন চেষ্টা চালান না। পাকিস্তানি নাগরিকদের আরো ভালো যত্ন নেয়ার দাবিতে সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন বিলাল। তিনি বলেন, কিন্তু ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান দৃশ্যত তোষামোদিতেই বেশি সাড়া দেন। তার পূর্বসূরিদের চেয়েও তার মধ্যে এ বৈশিষ্ট্য বেশি দেখা যায়। ইমরান খান নিজেও পাকিস্তানের সবচেয়ে বিখ্যাত প্রবাসী ছিলেন বেশ কয়েক দশক ধরে। প্রবাসী পাকিস্তানিদের সমস্যা নিয়ে একাধিকবার বিলাপ করেছেন তিনি। ধনী প্রবাসীদের প্রতি পাকিস্তানে বিনিয়োগের বা আত্মীয়-স্বজনদের অর্থ পাঠাতে আহ্বান জানিয়েছেন।২০১৯ সালের শুরুর দিকে পাকিস্তান সফর করেন সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান (এমবিএস)। সফরে ২ হাজার ১০৭ জন পাকিস্তানি বন্দিকে ক্ষমা করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। এরপর এক বছর পার হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত মাত্র ৫৭৯ জন বন্দিকে মুক্তি দিয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। জেপিপি দাবি করছে, এদের অনেকেই ক্রাউন প্রিন্সের ঘোষণার আগেই মুক্তি পেয়েছেন। বাকিরা কবে ছাড়া পাবেন তা এখনো অস্পষ্ট।
পাকিস্তানি কর্মকর্তারা বন্দিদের মুক্তি দেরি হওয়ার জন্য সৌদি আরবের আমলাতন্ত্রকে দুষছেন, প্রতারণাকে নয়। উপরন্তু, এ বিষয়ে ইমরান খানের প্রধান উপদেষ্টা সাইদ জুলফিকার বুখারি জানান, পাকিস্তান সরকার গত এক বছরে হালকা আইন লঙ্ঘনকারী ২ হাজার ৬০০ ব্যক্তিকে সৌদিতে অবস্থান করার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।আবদুল হকের ছেলের অপরাধের মাত্রা অত্যন্ত বেশি হওয়ায় তার ছাড়া পাওয়ার সুযোগ নেই। তাকে ফাঁসানো লোকদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে তার পরিবার, তবে লাভ হয়নি। তার ভাইরাও এখন বিদেশযাত্রার চেষ্টা চালাচ্ছে। আবদুল হক কেবল দেখে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, আমরা দরিদ্র, স্পষ্টতই, সবাই সেখানে যেতে চায়, অর্থ কামাতে চায়।

Development by: webnewsdesign.com