সুন্নাত ও বিদ’আতের পরিচয়

শনিবার, ১৩ মার্চ ২০২১ | ৬:৩৯ অপরাহ্ণ

সুন্নাত ও বিদ’আতের পরিচয়
apps

আল্লাহ তায়ালা এই ধরার মাঝে মানব জাতিকে সৃষ্টি করার পর , তাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য যুগে যুগে নবী- রাসূল আ:কে এই পৃথিবীর বুকে প্রেরন করেছেন। সেই সুমহান ধারার সর্বশেষ পয়গম্বর হলেন রাসুলে আরাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আল্লাহ তায়ালা খাতামুল আম্বিয়া সা:এর আনুগত্য করা, তার অনুসারী হওয়া, তাকে পরিপূর্ণ ভাবে সম্মান করা মুসলিম উম্মাহর উপর ফরয করেছেন। যেমন আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআন মাজীদে এরশাদ করেন:

قل ان كنتم تحبون الله فاتبعوني يحببكم الله ويغفر لكم ذنوبكم والله غفور رحيم.
অর্থ: হে নবী আপনি বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাসতে চাও , তবে আমার অনুসরণ করো, তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের অপরাধসমূহ মাফ করে দিবেন। এ আয়াতে কারীমা থেকে একথা সুস্পষ্ট ভাবে বুঝা যায় যে , আল্লাহর সন্তুষ্টি ও মহব্বত লাভের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্যকে অপরিহার্য করা হয়েছে। তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম কে যে যত বেশি মুহাব্বত করবে তার অনুসরণ- অনুকরণে অগ্রগামী হবে , সে ততো বেশি আল্লাহর নৈকট্য লাভ করবে। এক হাদীসে এসেছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম বলেন: আমার সকল উম্মতই জান্নাতে প্রবেশ করবে তবে যারা আমাকে অস্বীকার করে তারা ব্যতীত, সাহাবাগণ জিজ্ঞাসা করলেন হে আল্লাহর রাসূল ! কারা আপনাকেও স্বীকার করে , রাসূল সা: বলেন যারা আমার আনুগত্য করে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে আর যারা আমার আনুগত্য করে না তারা আমাকে অস্বীকার করে। হাদিসে যারা রাসূলের আনুগত্য করে না তাদের শেষ পরিনামের ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে। জাগতিক ক্ষেত্রে যেমন ভালোবাসার শ্রেণীবিন্যাস রয়েছে, আল্লাহ‌ ও তাঁর প্রিয় হাবীব সা: এর ভালোবাসার ক্ষেত্রেও তেমনি সংশ্লিষ্ট স্তর রয়েছে। মহান আল্লাহকে তার রুবুবিয়্যাত এবং রাসুলুল্লাহকে আল্লাহর বান্দা ও রাসূলের আসনে সমাসীন রেখেই মোহাব্বত করতে হবে। কেননা কোরআন ও হাদিসে এবং সাহাবাদের আ’সার থেকে নির্দিষ্ট সীমারেখা আছে। তাই কোরআন ও সুন্নাহর রাস্তা ব্যতিরেকে মনগড়াভাবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের মহব্বত প্রকাশের অপচেষ্টা করা নিতান্তই বোকামি ছাড়া বৈ কিছু নয়। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে , উম্মতে মুসলিমার কিছু বিদ’আতপন্থী লোক আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সীমালংঘন করে , আল্লাহর রবুবিয়্যাতের বিভিন্ন গুণাবলিকে রাসূলের জন্য সাব্যস্ত করার মত স্পর্শকাতর কাজ প্রতিনিয়তই করছে। এভাবে রাসুলে আরাবি সা: ভালোবাসার নামে এমন কিছু ভ্রান্ত আকীদা পোষণ করে যা সরাসরি শিরক বা বিদ’আত । নবীজির সাল্লাহু সাল্লাম এর জন্ম বার্ষিকী, মিলাদের নামে ভুল পদ্ধতিতে দরুদ পাঠ, নবীজী সা: কে হাজির- নাজির বিশ্বাস করে মিলাদের মজলিসে কিয়াম করা সহ অসংখ্য শরীয়ত বহির্ভূত শিরক-বিদআত কে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা:কে ভালোবাসার নিমিত্তে করে যাচ্ছে যা খুবই নিন্দনীয়! দ্বীন ইসলাম আল্লাহর সর্বশেষ পরিপূর্ণ ধর্ম ও জীবন বিধান। তাই এই তালাবদ্ধ পরিপূর্ণ জীবন বিধানে কোন প্রকার সংযোজন- সংকোচন, সংশোধন কিংবা পরিবর্তন- পরিবর্ধনের কোনো অবকাশ নেই। মহান আল্লাহ দশম হিজরি সনের ৯ জিলহজ্জে বিদায় হজ্জের দিনে সোয়া লক্ষ সাহাবা রা: এর সম্মুখে ইসলামকে পরিপূর্ণতার ঘোষণা দেন। আল্লাহ বলেন:

اليوم اكملت لكم دينكم واتممت عليكم نعمتي ورضيت لكم الاسلام دينا.
অর্থ: আজকের দিনে তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার নিয়ামতকে পরিপূর্ণ করে দিলাম আর তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে ইসলামকে মনোনীত করলাম।( সূরা মায়িদাহ আয়াত ৩) উল্লেখিত আয়াত থেকে একথা সূর্যের ন্যায় স্পষ্ট যে, দ্বীন- ইসলাম পরিপূর্ণ। আকিদা ও আমলের সমষ্টির নাম হচ্ছে দ্বীন। তাই আমল ও আকিদা উভয়ের মধ্যে পরিবর্তন- পরিবর্ধনের কোনো সুযোগ নেই।দিনের প্রয়োজনীয় সকল বিষয়াদি পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম হাদীস শরীফে তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন।সুতরাং শরীয়তের অকাট্য দলিল দ্বারা সমর্থিত নয় এমন কোন বিষয়াদি দিনের সাথে সংযোজন করলে তা হবে স্পষ্ট বিদ’আত। আর এই সংযোজনকারী ব্যক্তিকে বলা হবে বিদ’আতী। সুন্নত ও বিদ’আত দুই বিপরীতার্থক আরবি শব্দ। ইসলামী তাহযীবের যতগুলো মৌলিক পরিভাষা রয়েছে, সেসব পরিভাষার উপর ইসলামী- জীবন ব্যবস্থার সম্যক অনুধাবন নির্ভরশীল। এ দু’টো শব্দ তারই মধ্যে গণ্য। এ দুটো শব্দের সঠিক তাৎপর্য বিশ্লেষণ এবং শব্দ দুটোর দৃষ্টিতে মুসলিম উম্মাহর আক্বীদা ও আমল আখলাক যাচাই ও পরখ করা একান্তভাবে জরুরী। আসল কথা হচ্ছে সুন্নত ও বিদআত সম্পর্কে সম্যক অবগতির অভাবে দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও ভ্রান্তির বেড়াজালে আটকে যেতে হয়। অপরদিকে দ্বীনের কাজ নয় বা কোন প্রকার সাওয়াবের কাজ নয় এমন বিষয়কেও পুণ্যের কাজ বলে অভিহিত করা হয়।পাঠক আসুন জেনে নেই সুন্নত কাকে বলে এবং সুন্নতের উপর পথচলার দ্বারা দুনিয়া এবং আখেরাতে ফলাফল কী দাঁড়াবে। সুন্নাতের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে পথ, সুন্নত মানেআদর্শ নবীজি সাল্লালাহ সালামের সুমহান আদর্শই সুন্নত নামে পরিচিত। সুন্নাতের পারিভাষিক অর্থ হচ্ছে রাসুলে আরাবি সা:এর কার্যকলাপ ও আচার-আচরণ আদত ,অভ্যাস এবং তিনি যা নিজে করেছেন ও করতে বলেছেন, এবং তিনার সামনে কোন কাজ করা হয়েছে তাতে তিনি কোনরূপ আপত্তি করেননি উল্লেখিত সকল কাজই হচ্ছে সুন্নাত। সেই সাথে সাহাবা রা:, তাবেঈন ও তাবে- তাবেঈন রহ: গণের দ্বীন সম্পর্কীয় কথা, আকীদা-বিশ্বাস, আমল-আখলাকও রাসুলের বানী অনুযায়ী সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম বলেন:

عليكم بسنتي وسنه الخلفاء الراشدين المهديين.
অর্থ: আমার সুন্নাত ও আমার সত্যানুসারী খলিফাগনের সুন্নাত , তোমাদের জন্য পালন করা আবশ্যকীয়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন: রাসুল সা: যা আদেশ করেছেন তোমরা তা ধারণ করো , আর তিনি যা নিষেধ করেছেন তা হতে বিরত থাকো (সূরা হাশর)নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর ভালোবাসা মুমিনের ঈমান আর সুন্নাতের পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণের নাম হচ্ছে প্রমাণ। হাদীস শরীফে এসেছে রাসূল সা: বলেন:

من احب سنتي فقد احبني ومن احبني كان معي في الجنه .
অর্থ: যে আমার সুন্নাতকে ভালোবাসে সে অবশ্যই আমাকে ভালবাসে আর যে আমাকে ভালবাসে সে জান্নাতে আমার সঙ্গেই থাকবে ( তিরমিজি২৭২৬) অন্য হাদীসে রাসুল সা: বলেন : যে আমার সুন্নাতকে জিন্দা করবে সে আমাকে ভালোবাসে, যে আমাকে ভালবাসে সে জান্নাতে আমার সঙ্গেই থাকবে ( মুসলিম শরীফ)

ইবনে আব্বাস রা:বলেন সুন্নাতের অনুসারী এদের চেহারা শ্বেতবর্ণ ও উজ্জ্বল হবে পক্ষান্তরে বিদআত পন্থী ও মুসলিমদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টিকারী চেহারা কৃষ্ণবর্ণ বা মলিন হবে। উপরোক্ত হাদীস গুলো থেকে প্রতীয়মান হয় যে, রাসূলুল্লাহ সুন্নত পালন এর মধ্যেই একজন মুমিনের কল্যাণ নিহিত। ইসলাম ইহ জাগতিক ও পরকালীন জীবনের কল্যাণ ও মুক্তির শিক্ষা দেয়। কল্যাণময় রাষ্ট্র ও সুখী- সমৃদ্ধশিল সমাজ বিনির্মাণে প্রয়োজন মহামানবের সুমহান আদর্শের অনুশীলন। সমাজের সর্বস্তরে এই সুন্নাত বাস্তবায়নে প্রয়োজন সৃজনশীল ভাবনা,নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম এর জীবন দর্শন ও কর্মে যে যতটুকু অনুসরণ করবে সে ততটুকু সফলতা ও কল্যাণ লাভ করবে। অতএব শান্তি ও নিরাপত্তায় সুন্নত অনুসরণের বিকল্প নেই।

আসুন এবার জেনে নেই , বিদা’আত কি? এবং বিদ‌’আতিদের ব্যাপারে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কি বলেছেন এবং তাদের শেষ পরিণাম কি হবে? বিদ’আতের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে “কোনরূপ পূর্ব নমুনা না দেখে এবং অন্য কিছুর অনুকরণ -অনুসরণ না করেই কোন কাজ নতুনভাবে সৃষ্টি করা। শরীয়তের পরিভাষায় বিদআত বলা হয়:এমন কোন বিষয় নব আবিষ্কার করা যার অস্তিত্ব পূর্বে (তিন জামানায় অর্থাৎ সাহাবা ,তাবেয়ীন তাবে-তাবেয়ীন) ছিলনা , এবং যার প্রতি শরীয়তে কোনরূপ অনুমোদন নেই, এমন কাজকে শরীয়তের নিয়ম হিসাবে বা সওয়াবের কাজ হিসাবে করা হয়। বিখ্যাত হাদীস বিশারদ ইমাম নববী রহ: বলেন:শরীয়তে এমন সব কাজ করা বিদআত যার কোনো পূর্ব দৃষ্টান্ত নেই। আল্লামা মোল্লা আলী কারী রহ: বলেন: রাসূলুল্লাহর যুগে ছিল না এমন রীতি -নীতি ও পথকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে প্রবর্তন করাকেই শরীয়তের পরিভাষায় বিদ’আত বলা হয়। হাদীস শরীফে এসেছে রাসূলুল্লাহ সা: বলেন:

من احدث في امرنا هذا ماليس منه فهو رد.
অর্থ:যে ব্যক্তি আমার দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছু উদ্ভাবন করবে যা এই দ্বীনের মধ্যে নেই তা বাতিল বলে গণ্য হবে (সহি বুখারী) মুফতি কেফায়াতুল্লাহ রহ: বলেন: বিদআত ঐ বিষয় গুলোকে বলা হয় যার ভিত্তি শরীয়তে বিদ্যমান নেই অর্থাৎ কোরআন ও হাদিসে যার দলিল পাওয়া যায় না এবং সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন ও তাবে -তাবেঈনদের যুগে যার অস্তিত্ব ছিলনা, অথচ দিনের কাজ মনে করে তা পালন করা হয়। রাসূল সা:বিভিন্ন হাদিসে বিদআতীদেরকে কঠোরভাবে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। যেমন: বুখারী শরীফে এসেছে রাসূলুল্লাহ সা: বলেন: সর্বোত্তম বাণী হলো আল্লাহর কিতাব এবং সর্বোত্তম হিদায়াত হল মুহাম্মদ সা: এর পথ নির্দেশনা। আর সর্বনিকৃষ্ট বিষয় হলো নব আবিস্কৃত বিষয়সমূহ, অনন্তর প্রতিটি বিদআত গোমরাহী এবং প্রতিটি গুমরাহি জাহান্নামের মধ্যে পড়বে।( সহি বুখারী) অপর এক হাদীসে ইরশাদ হয়েছে রাসূলুল্লাহ সা:বলেন:

واياكم ومحدثات الامور فان كل محدثه بدعه وكل بدعه ضلاله.
অর্থ: সাবধান!তোমরা নব- আবিস্কৃত কাজসমূহ থেকে দূরে থাকবে কারণ প্রতিটি নব- আবিস্কৃত কাজই বিদআত আর প্রত্যেক বিদআতই হচ্ছে গুমরাহি।( সুনানে আবু দাউদ) উপরোক্ত হাদীস গুলো ছাড়াও আরো অনেক হাদীস রয়েছে যেখানে বিদাতিদের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সা: কঠিন হুঁশিয়ারি দিয়েছেন এবং রোজ হাশরে অসহনীয় শাস্তির ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। মূল কথা হচ্ছে বিদআত পন্থী নিজেকে শরীয়ত প্রবর্তকের সমকক্ষ সাদৃশ্য বানিয়ে নেয়।কেননা যেহেতু আল্লাহ তায়ালা শরীয়তকে নিজেই বানিয়েছেন এবং বান্দাদেরকে তা অনুসরণ -অনুকরণ করে চলার আদেশ করেছেন। তদ্রুপ বিদআত প্রবর্তক নিজে কোন আমল নতুনভাবে উদ্ভাবন করে তদানুযায়ী আমল করতে লোকদেরকে উৎসাহিত করে। আল্লাহ তা’আলা লেখক কে এবং উম্মতে মুসলিমার সকল ভাই ও বোনদের কে রাসুলুল্লাহর সুমহান আদর্শকে বুকে ধারণ করে , সকল প্রকার নব আবিস্কৃত বিদআত থেকে বেঁচে পরিপূর্ণ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অনুসারী হওয়ার তৌফিক দিন, আমিন।

Development by: webnewsdesign.com