যতজন কর্মকর্তার গাড়ি পাওয়ার কথা, আছে তার তিন গুণ। অনেকে একাধিক গাড়ি ব্যবহার করছেন। যাঁদের পাওয়ার কথা নয়, গাড়ি ব্যবহার করছেন তাঁরাও। মন্ত্রণালয়টি শুধু গাড়ির পেছনেই প্রতিবছর ব্যয় করে সাড়ে ২২ কোটি টাকা। এর বড় একটি অংশ অবৈধ উপায়ে ঢুকছে উচ্চ পদের কর্মকর্তাদের পকেটে। মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব শাহ্্ কামালের নামেই বরাদ্দ ৯টি গাড়ি। এসব গাড়ির ভুয়া বিল-ভাউচারে দেদার ওঠানো হচ্ছে সরকারি টাকা। মন্ত্রণালয়ের মুখ্য হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা হিসেবে অন্যদের অপচয়-দুর্নীতি রোধের দায়িত্ব সচিবের। কিন্তু খোদ তাঁর নামেই এমন অভিযোগে অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করছেন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর মিলিয়ে মোট সরকারি গাড়ি আছে ১৪৩টি। এর মধ্যে ৫৯টি গাড়ি মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের প্রাধিকারপ্রাপ্ত (উপসচিব তদূর্ধ্ব) কর্মকর্তারা সরকারি টাকায় কিনেছেন। এর পরও বাকি থাকে ৮৪টি গাড়ি। এই গাড়িগুলো কারা কোথায় ব্যবহার করছেন তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য না পাওয়ায় প্রধান হিসাবরক্ষণ কার্যালয় থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। এসব গাড়ির বিপরীতে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকার বিল তুলে নেওয়া হচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে এই ৮৪টি গাড়ি ব্যবহার করছেন কারা?
সিনিয়র সচিব শাহ্ কামালের নামের বিপরীতে নিয়মিত আটটি সরকারি গাড়ির জ্বালানি খরচ তোলা হয়। চলতি বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরÍএই তিন মাসে তাঁর আটটি গাড়ির বিপরীতে আট লাখ ২২ হাজার টাকার বিল দাখিল করা হয়েছে। প্রাধিকারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে তিনি সরকারের টাকায় ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়েছেন। এখানেও দুর্নীতির আশ্রয়ে প্রতি মাসে দ্বিগুণ খরচ নিচ্ছেন জনগণের কোষাগার থেকে। এই হিসাবে সিনিয়র সচিবের ৯টি গাড়ির পেছনে মাসে খরচ যায় তিন লাখ ২৪ হাজার টাকা।
নিয়ম অনুযায়ী যেসব কর্মকর্তা সরকারি টাকায় ব্যক্তিগত গাড়ি কিনেছেন তাঁরা গাড়ির সামগ্রিক খরচ বাবদ প্রতি মাসে সরকার থেকে ৫০ হাজার টাকা পাবেন। যদি তাঁরা সরকারি দপ্তর থেকে গাড়ি পান তাহলে ব্যক্তিগত গাড়ির সামগ্রিক খরচ পাবেন মাসপ্রতি ২৫ হাজার টাকা। সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, ত্রাণ মন্ত্রণালয় ও দুর্যোগ অধিদপ্তরের ৫৯ কর্মকর্তার মধ্যে ৪৫ জনই প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা করে উত্তোলন করছেন। তার মানে এই ৪৫ জন শুধু নিজেদের গাড়িই ব্যবহার করছেন। বাকি ১৪ জন কর্মকর্তা তুলছেন ২৫ হাজার টাকা করে। তাঁরা মন্ত্রণালয়ের গাড়ি ব্যবহার করছেন। তার পরও বাকি থাকে ৭০টি গাড়ি।
কিন্তু কাছে আসা তথ্য অনুযায়ী দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের ৪০ জনের বেশি কর্মকর্তা সরকারি গাড়ি ব্যবহারের পাশাপাশি ব্যক্তিগত গাড়ির জন্যও ৫০ হাজার টাকা নিচ্ছেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এটা খুব নিম্নমানের পরিকল্পিত দুর্নীতি। গত ৩ নভেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে যাঁরা অফিসের গাড়ি পাওয়ার পরও সরকারের কোষাগার থেকে ৫০ হাজার টাকা তুলছেন তাঁদের সতর্ক করে অফিস আদেশ জারি করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সরকারিভাবে গাড়ি ব্যবহার করেও ব্যক্তিগত গাড়ির জন্য ২৫ হাজারের বদলে ৫০ হাজার টাকা তোলা অসদাচরণ ও দুর্নীতির আওতাভুক্ত। গাড়ি সেবা শাখা থেকে জারি করা ওই আদেশে সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে যথাযথ নিয়ম প্রতিপালনের কথা বলা হয়েছে।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১৮ ডিসেম্বর মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসাররক্ষণ কর্মকর্তার (সিএও) দপ্তর থেকে শাহ্্ কামালের নামেও আটটি গাড়ির জ্বালানি খরচ নিয়ে প্রশ্ন তুলে ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে বাড়তি বিল তোলার প্রমাণসহ উত্থাপিত বিল ফেরত দিয়ে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে বলা হয়। এই সিনিয়র সচিবের নামে সব গাড়ির বিল একটিমাত্র ফিলিং স্টেশনÍরাজারবাগ সার্ভিস স্টেশনের নামে করা হয়েছে। এটাও দুর্নীতির একটি বড় প্রমাণ বলে জানিয়েছেন মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা।
চিঠি সূত্রে জানা গেছে, সচিবের নামের বিপরীতে চলা আটটি গাড়িতে গত জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে লক্ষাধিক টাকার জ্বালানির ভুয়া বিল দাখিল করা হয়েছে। একই তারিখে একই গাড়িতে একাধিকবার জ্বালানি গ্রহণের ঘটনা ঘটেছে। তারা বলছে, ডিজেলচালিত ইঞ্জিনে অকটেন ও সিএনজি একসঙ্গে ব্যবহারের সুযোগ নেই। কিন্তু উত্থাপিত বিলে তা দাবি করা হয়েছে। কোনো কোনো গাড়ির ক্ষেত্রে ডিজেল, অকটেন ও সিএনজিÍতিনটি জ্বালানিই সমান তালে ব্যবহারের দাবি করে বিল জমা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া গাড়িতে লুব্রিকেটিং অয়েল পরিবর্তনের সময় বিপুল পরিমাণ ফসিং অয়েল ব্যবহারের বিল দাখিলকেও অযৌক্তিক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সচিবের নামে চলতি বছরের ১৬ জুলাই ২০-০৬১ নম্বর জিপ গাড়ির বিপরীতে ৪২৬৫৮ নম্বর ভাউচারে ১৮০ লিটার ডিজেল নেওয়া হয়। একই তারিখে একই গাড়ির বিপরীতে ৪২৬৫৯ নম্বর ভাউচারে আরো ১৮০ লিটার ডিজেল নেওয়ার বিল দাখিল করা হয়েছে। অন্যদিকে ১৭ আগস্ট ৪৬৯২ নম্বর জিপ গাড়ির বিপরীতে ৪২৭৪০ নম্বর ভাউচারের ২০ ঘনমিটার গ্যাসের বিল দেওয়া হয়। একই তারিখে একই গাড়ির বিপরীতে ৪২৭৪১ নম্বর ভাউচারের বিপরীতে আরো ২০ ঘন মিটার গ্যাসের বিল দাবি করা হয়েছে। এভাবে জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসজুড়ে বিভিন্ন তারিখে ডিজেল, সিএনজি ও অকটেনের বিপরীতে ৯৫টি ভুয়া বিল উত্থাপন করা হয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের এক যুগ্ম সচিব বলেন, ক্যাডার কর্মকর্তা হিসেবে এমন দুর্নীতি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। যাঁরা মন্ত্রণালয়ে বসে মাসে ২৫ হাজার টাকার দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন তাঁরা যে অন্যান্য দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত তার আর ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় না।
সূত্র জানায়, এই মন্ত্রণালয়ের সরকারি গাড়ি ব্যবহারের পরও যেসব কর্মকর্তা ৫০ হাজার টাকা করে নিচ্ছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন, সিনিয়র সচিব শাহ্ কামাল, অতিরিক্ত সচিব মো. মহসিন, ড. নজরুল আনোয়ার ও আলী রেজা মজিদ। যুগ্ম সচিব এ কে এম টিপু সুলতান, আবুল বায়েছ মিয়া, ড. আতিকুর রহমান, জি এম আব্দুল কাদের, এম খালিদ মাহমুদ, শাহ রেজওয়ান হায়াৎ। উপসচিব শাব্বির আহম্মেদ (সিনিয়র সচিবের একান্ত সচিব), আব্দুল্লাহ আল আরিফ, আবুল খায়ের মো. মারুফ হাসান, আব্দুল কাদের, আবু সৈয়দ মো. কামাল, ধরিত্রী কুমার সরকার, হাবিবুর রহমান, মুনিরা সুলতানা, কোরবান আলী, মনিরুল ইসলাম, রঞ্জিত কুমার সেন, শিখা আক্তার, নুরল বশির, কাজী মোজাম্মেল হক ও কাজী তাসনিম আরা আজমেরী।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের গাড়ি ব্যবহারের পরও অধিদপ্তরের যে কর্মকর্তারা ৫০ হাজার করে টাকা নিচ্ছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেনÍঅতিরিক্ত সচিব হারুনুর রশিদ মোল্লা, উপসচিব ড. হাবিবুল্লাহ বাহার, জাহিদুল ইসলাম, লুত্ফুন নাহার ও নূরুল হক চৌধুরী।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এই মন্ত্রণালয়ের ছয়টি প্রকল্পের মধ্যে পাঁচটির পরিচালকই নিয়ম মেনে ব্যক্তিগত গাড়ির জন্য ২৫ হাজার টাকা উত্তোলন করেন। ব্যতিক্রম হচ্ছেন হেরিং বোন বন্ড (এইচবিবি) প্রকল্প পরিচালক (যুগ্ম সচিব) দীপক রঞ্জন অধিকারী। তিনি তাঁর প্রকল্পের গাড়ি ব্যবহার করলেও ব্যক্তিগত গাড়ির জন্য ৫০ হাজার টাকা করে তুলছেন।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বিভিন্ন প্রকল্পের অনেক গাড়ি জমা হলেও সেগুলো পরিবহন পুলে জমা দেওয়া হয়নি। একদিকে গাড়িগুলো অপব্যবহার হচ্ছে, অন্যদিকে প্রতিবছর জ্বালানি খরচ বাবদ সরকারের অনেক টাকা চলে যাচ্ছে। এসব বিষয়ে মূলত মন্ত্রণালয়ের সচিবকে উদ্যোগী হতে হয়। কিন্তু ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব নিজেই অনিয়ম করেন, অন্যদেরও সুবিধা পাইয়ে দেন। এ কারণে সবাই চুপ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সরকার আমাদের এত সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পরও অনেক কর্মকর্তা তাঁদের পুরনো অভ্যাস ত্যাগ করতে পারেননি, এটা দুঃখজনক। শুনেছি সিনিয়র সচিবের গাড়ি নিয়ে এমন অভিযোগ এসেছে। এর চেয়ে লজ্জার আর কিছু নেই। অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, তিনি কথায় কথায় প্রধানমন্ত্রীর দোহাই দেন। অফিস করেন বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত। অনেকে বিব্রতকর অবস্থায় পড়লেও কেউ কথা বলতে সাহস পান না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গাড়ির জ্বালানি বিলের আপত্তিসংক্রান্ত চিঠির জবাবে গত ১২ ডিসেম্বর মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কয়েকটি যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে সিএও অফিসের কাছে। কিন্তু এসব যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয় উল্লেখ করে ১৭ ডিসেম্বর আবারও মন্ত্রণালয়ে আপত্তি এসেছে। সিএও অফিস থেকে দ্বিতীয় দফা আপত্তির পর ২২ ডিসেম্বর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের পরিচালক প্রশাসন (অতিরিক্ত সচিব) হারুন অর রশিদ মোল্লা সিএও বরাবর চিঠি লেখেন। এতে তিনি জ্বালানি বিলের বিষয়ে তোলা আপত্তির সুনির্দিষ্ট উত্তর না দিয়ে সংশ্লিষ্ট গাড়ির জ্বালানি বিলের সঙ্গে ক্ষমতাধর কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি মনে করিয়ে দেন।
এসব বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব শাহ্ কামাল বলেন, তাঁর নামে একাধিক গাড়ির বিল প্রস্তাবের বিষয়টি তিনি জানেন না। তিনি বলেন, ‘এসব বিষয়ে টেলিফোনে বিস্তারিত কথা বলার দরকার নেই। আপনি মন্ত্রণালয়ে এলে সংশ্লিষ্ট অফিসারদের নিয়ে বিস্তারিত কথা বলব।’ অন্যদিকে জ্বালানি তেলের বিলসংক্রান্ত বিষয়ে যে সিএও অফিসের সঙ্গে দফায় দফায় চিঠি চালাচালি হচ্ছে সে বিষয়েও তিনি কিছু জানেন না বলে দাবি করেন।
Development by: webnewsdesign.com