বিমানবন্দরে গুরুত্বপূর্ণ ও অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ব্যবহারের জন্য পৃথক লাউঞ্জ রয়েছে। কারা এসব লাউঞ্জ ব্যবহার করবেন তার নির্দেশনাও রয়েছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের। কিন্তু শাহজালালে এসব নিয়ম আর নির্দেশনা উপেক্ষা করে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী, বিভিন্ন সংস্থার ঊর্ধতনদের ভিআইপি সুবিধা নেয়ার ঘটনা ঘটছে অহরহ। এমন ‘ভিআইপিদের’ আনাগোনায় আসল ভিআইপিদেরও অনেক সময় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। অনৈতিকভাবে যারা ভিআইপি সুবিধা নেন তাদের দাপটে বিমানবন্দর কর্মকর্তারাও অনেক সময় অসহায় বোধ করেন। গুরুতর অপরাধকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিরা এই সুবিধা নেয়ার তথ্য প্রকাশ হওয়ায় খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তিনি এও বলেছেন, নিয়ম না মানলে ‘ভিআইপিদের’ বিমানে চড়াই বন্ধ হয়ে যাবে। গত কয়েক দিন বিমানবন্দরের সরজমিন তথ্য ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহারে নানা অনিয়মের তথ্য পাওয়া গেছে।
১৪ ডিসেম্বর রাত সাড়ে ১১ টা। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সিঙ্গাপুরগামী একটি ফ্লাইট ধরতে এক ব্যক্তি তার এক সহকর্মীকে নিয়ে বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জ চামেলীতে প্রবেশ করেন। চামেলী দিয়ে একুশে পদক পাওয়া ব্যক্তি, সংবাদপত্রের সম্পাদক ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কাজে বিদেশ যাওয়া ব্যক্তিরা প্রবেশ করেন। সেখানে কর্তব্যরত কর্মকর্তারা ওই ব্যক্তির পরিচয় জানতে চান। তিনি নিজেকে ক্ষমতাসীন দলের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের এক নেতার ভাই বলে পরিচয় দেন। তার পরিচয় পাওয়ার পর কর্তব্যরত কর্মকর্তারা তাকে জানান যে, এই লাউঞ্জ ব্যবহারের অনুমতি নেই তার। এ কথা শুনে ওই ব্যক্তি কর্মকর্তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার শুরু করেন। বিভিন্নস্থানে ফোন দেয়া শুরু করেন। বাধ্য হয়ে ওই কর্মকর্তা তাকে আর কোন কিছু না বলে সেখান থেকে চলে যান। বিমানবন্দরের কর্মকর্তাদের দাবি প্রায় প্রতিদিনই এমন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয় তাদের।
ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহারের নীতিমালা কঠোরভাবে কার্যকর করতে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় একাধিকবার নির্দেশনা প্রদান করলেও কথিত ভিআইপিদের কাছে তা গুরুত্বহীন।
শাহজালালের চামেলী লাউঞ্জ ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করতেন গ্রেপ্তার হওয়া সাবেক যুবলীগ নেতা ইসমাইল চৌধুরী সমাট্র। ক্যাসিনো কাণ্ডে গ্রেপ্তার এই নেতা কাড়ি কাড়ি ডলার নিয়ে সিঙ্গাপুরে যেতেন ক্যাসিনো খেলতে। তিনি ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহার করতেন। বছরের পর বছর তিনি এ সুযোগ নিয়ে আসলেও তা প্রকাশ পায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর। নানা অপরাধকাণ্ডে জড়িত এমন অনেকে ক্ষমতাসীন দলের পরিচয়ে ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহার করে আসছিলেন। বিষয়টি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যেও সরকারের উচ্চ পর্যায়ে অবহিত করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে বিভিন্ন মাধ্যমে এ তথ্য সংগ্রহ করেন। সম্প্রতি তিনি বিমানবন্দর সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে কড়া নির্দেশনা দিয়েছেন। সর্বশেষ বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের ভিত্তি স্থাপন অনুষ্ঠানে তিনি প্রকাশ্যে এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্টদের কড়া বার্তা দেন।
এ বিষয়ে হযরত শাহজালাল (র.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ কাপ্টেন তৌহিদুল আহসান গণমাধ্যমকে কে জানান, ‘ভিআইপি লাউঞ্জের নিরাপত্তার বিষয়ে কর্তৃপক্ষ আরও বেশি সতর্কতা অবলম্বন করেছে। প্রটোকলের বাইরে যাতে কেউ ওই লাউঞ্জ ব্যবহার করতে না পারে সেইক্ষেত্রে দেয়া হয়েছে বিশেষ নির্দেশনা।
বিমানবন্দর ও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, রাষ্ট্রের ভিআইপিরাই মূলত বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহার করতে পারেন। অন্য কারও ব্যবহার করার এখতিয়ার নেই। শাহাজালাল বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জ মূলত ৪ টি। সেগুলো হলো, রজনীগন্ধা, বকুল, দোলনচাপা ও চামেলী। রজনীগন্ধা রাষ্ট্রের সর্ব্বোচ্চ ভিআইপিরা ব্যবহার করেন। আর বকুল ব্যবহার করেন এডিশানাল সেক্রেটারি পদদারি ও সমমর্যাদার ব্যক্তিরা। এছাড়াও দোলনচাপা ব্যবহার করেন সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধতন কর্মকর্তারা।
সূত্র জানায়, চ্যামেলী ব্যবহার করেন একুশে পদক পাওয়া ব্যক্তি, সংবাদপত্রের এডিটর ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কাজে বিদেশ ভ্রমণরত বেসরকারি কর্মকর্তাগণ। কিন্তু, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিমানবন্দরের নিয়ম না মেনে নিরাপত্তা তল্লাশি ছাড়াই প্রবেশ, শরীর ও ব্যাগ তল্লাশিতে বাঁধা, অস্ত্র বহনের নিয়ম না মানা, অতিরিক্ত দর্শনার্থী নিয়ে প্রবেশসহ নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অসহযোগিতা করেন ভিআইপিরা।
এতে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে বিমানবন্দরের। পরিস্থিতি সামাল দিতে বিভিন্ন সময় নিরাপত্তাব্যবস্থা কঠোর করা হলেও মানা হয় না নির্দিষ্ট নিয়মনীতি।
বিমানবন্দরের ভিআইপি নীতিমালা অনুযায়ি বিশিষ্ট ব্যক্তি ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের গমন ও প্রত্যাবর্তনের সময় সংবর্ধনা দেয়ার জন্য দুইজন দর্শনার্থীকে ভিআইপি লাউঞ্জে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়ে থাকে। কিন্তু সরজমিনে দেখা গেছে, ভিআইপিরা তাদের সঙ্গে একাধিক ব্যক্তিকে ভেতরে নিয়ে যান। আর রাজনৈতিক দলের নেতা হলে তারা অনেক নেতাকর্মী নিয়ে ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহার করেন। বিধি-নিষেধ থাকা সত্ত্বেও প্রায়ই অতিরিক্ত লোকজন ভিআইপি লাউঞ্জে প্রবেশ করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও পরিবেশ নষ্ট করে।
নিয়ম অনুযায়ী দর্শনার্থীদের নাম, পরিচয় ও ঠিকানা আগেই বিমানবন্দরের পরিচালককে অবহিত করতে হবে। ভিআইপি লাউঞ্জের স্বাভাবিক পরিবেশ, মর্যাদা ও নিরাপত্তা ক্ষুণ্ন হতে পারে এমন কোনও ব্যক্তিকে দর্শনার্থী হিসেবে ভিআইপি লাউঞ্জে প্রবেশের সুযোগ না দেয়ার বিষয়টি বিশিষ্ট ব্যক্তি ও উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিশ্চিত করতে হবে। ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহারে অগ্রাধিকার পাওয়া ব্যক্তিরা নিজের ভ্রমণ ছাড়াও বাবা-মা, স্ত্রী, সন্তান, পুত্রবধূ ও জামাতাকে যাত্রী হিসেবে বিদায় বা অভ্যর্থনা দেয়ার সময় ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহার করতে পারবেন।
সূত্র জানায়, যারা অবৈধভাবে ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহার করে থাকেন তারা নিজেরা অধিকাংশ সময় ক্ষমতাসীন লোকজনের আত্মীয় বা একান্ত কাছের ঘনিষ্ট বলে দাবি করেন। কর্তৃপক্ষ যদি তার কাছে পরিচয় জানতে চান তাহলে তাদের লোকজনকে সরাসরি ফোন কলে ধরিয়ে দেন।
সূত্র জানায়, ভিআইপি লাউঞ্জ অপব্যবহারে দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছেন সিনেমা পাড়ার অভিনেতা ও অভিনেত্রীরা। তাদের সেখানে ঢুকতে না দিলে তারা সরাসরি উচ্চ পর্যায়ের ব্যাক্তিদের কাছে ফোনে নালিশ করেন বা অভিযোগ দেন। বাধ্য হয়ে কর্মকর্তারা তাদের সুযোগ দেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভিআইপি টার্মিনালের দায়িত্্বরত একজন কর্মকর্তা জানান, ভিআইপি না হয়েও অনেকেই ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহার করেন। এতে নানা সময় অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটে। কিন্তু, চাকুরির স্বার্থে তা সহ্য করতে হয়।
এ ব্যাপারে বিমানবন্দরের আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপারেশন ও মিডিয়া) মো. আলমগীর হোসেন বলেন, নির্দিষ্ট প্রটোকল ছাড়া কেউ যদি ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহার করে তাহলে এটি বিমানবন্দরের নীতিমালা লঙ্ঘন হবে।
Development by: webnewsdesign.com