সুমাইয়া আক্তার (ছদ্মনাম)। ২২ বছর বয়সী এই তরুণী ঢাকার একটি নামকরা কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। এসএসসি পাস করে কলেজে ভর্তি হওয়ার পর অভিভাবকরা তার হাতে তুলে দেন স্মার্টফোন। প্রথম বর্ষে থাকাকালীন সময়ে সুমাইয়া স্মার্টফোনে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খোলেন। কয়েকমাস পরই ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচয় হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে। তারপর থেকে তাদের মধ্যে নিয়মিত চ্যাটিং হতো। অল্প কিছুদিনের মধ্যে তাদের সম্পর্ক আরও গভীর হয়। কিছুদিন পর তারা অডিও ও ভিডিও কলে নিয়মিত কথা বলেন। অনেক সময় খোলামেলাভাবে ভিডিও কলে কথা হতো তাদের মধ্যে।
ব্যক্তিগত ছবিও শেয়ার করেন সুমাইয়া। এভাবে আরও কিছুদিন যাওয়ার পর সুমাইয়া তার প্রেমিকের মধ্যে অস্বাভাবিক আচরণ দেখতে পান। রিয়াদ নামের ওই প্রেমিক সুমাইয়ার কিছু ব্যক্তিগত ছবি তাকে দিয়ে টাকা দাবি করে। টাকা না দিলে ছবিগুলো ভাইরাল করার হুমকি দেন। মান সম্মানের ভয়ে সুমাইয়া বিভিন্ন সময় রিয়াদকে ৮০ হাজার টাকা দেন। এ ছাড়া খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন রিয়াদ আসলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী না। সে প্রেমের ফাঁদে ফেলার জন্য মিথ্যা পরিচয় দিতো। মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে মেয়েদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে ব্যক্তিগত ছবি ও ভিডিও সংগ্রহ করতো। পরে এসব দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে টাকা আদায় করে নিতো।
রিয়াদের ব্ল্যাকমেইলের শিকার বিভিন্ন নারীদের অভিযোগের ভিত্তিতে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে এই সাইবার প্রতারককে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ। এ সময় তার কাছ থেকে ব্ল্যাকমেইলে ব্যবহৃত ২টি মোবাইল ও ভুয়া ফেসবুক আইডি জব্দ করা হয়েছে। ডিবি বলছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুয়া পরিচয় দিয়ে তরুণীদের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলাই ছিল তার পেশা। সম্পর্ক গড়ার পর মোবাইলে কথোপকথনের অডিও/ভিডিও রেকর্ড করে সেগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে ব্ল্যাকমেইলের ফাঁদ পাততো। এভাবে গত ২ বছরে কমপক্ষে ৬০ তরুণীর সর্বনাশ করে তাদের কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
ডিবি বলছে, প্রতারক রিয়াদ নিজেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি)-এর কম্পিউটার বিজ্ঞান প্রকৌশল বিভাগের ছাত্র পরিচয় দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মেয়েদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতো। তারপর কৌশলে কথার জালে ফাঁসিয়ে তাদের কাছ থেকে আপত্তিকর অশ্লীল ছবি ও ভিডিও মেসেঞ্জারের মাধ্যমে নিতো। তাছাড়া কথা বলার সময় অডিও রেকর্ড করে রাখতো। ভিডিও কলে কথা বলে সেগুলো স্ক্রিন রেকর্ডার দিয়ে রেকর্ড করতো। তারপর বিভিন্ন অজুহাতে তাদের কাছ থেকে টাকা ও মূল্যবান সামগ্রী দাবি করতো। ভিকটিম প্রতারকের ফাঁদ বুঝতে পেরে যখন সম্পর্ক রাখতে চাইতো না তখন ধারণকৃত ওই অডিও/ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল করার ভয় দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা দাবি করতো।
রিয়াদের প্রেমের ফাঁদে পা দিয়ে ব্ল্যাকমেইলের শিকার হন ছালমা (ছদ্মনাম) নামে এক তরুণী। তার কাছে ৫ লাখ টাকা দাবি করেছিল রিয়াদ। গত বুধবার ছালমা ধানমণ্ডি থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলার এজাহারে তিনি উল্লেখ করেন, রিয়াদের সঙ্গে আমার ৬-৭ মাস আগে মোবাইলফোনের মাধ্যমে পরিচয় হয়। পরিচয়ের সময় রিয়াদ নিজেকে ঢাবির সিএসই বিভাগের ছাত্র বলে পরিচয় দেয়। পরিচয়ের একপর্যায়ে রিয়াদের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ সময় মোবাইলফোনে তার সঙ্গে কথা হতো।
এ ছাড়া অডিও ও ভিডিও কলে কথা বলতাম। কথা বলার সময় আমার অজান্তেই রিয়াদ সব অডিও ও ভিডিও কথোপকথন রেকর্ড করে রাখে। পরবর্তীতে আমি জানতে পারি, রিয়াদ প্রকৃতপক্ষে ঢাবির ছাত্র নয়, মোবাইল ফোনে ভুয়া পরিচয় দিয়েছে। এই কারণে তার সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেই। এ সময় রিয়াদ আমার ওয়াটসঅ্যাপে বিভিন্ন হুমকিমূলক মেসেজ পাঠাতো এবং আমার ক্ষতি করার জন্য রেকর্ড করে রাখা সব অডিও/ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিতে থাকে। আমার ক্ষতি না করার জন্য রিয়াদকে অনুরোধ করলে, সে আবার হুমকি দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে। ওই টাকা দিতে রাজি না হওয়ায়, সে হুমকি অব্যাহত রাখে।
এ বিষয়ে ডিবির সাইবার অ্যান্ড সিরিয়াস ক্রাইম বিভাগের অর্গানাইজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের টিম লিডার অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) মো. নাজমুল হক বলেন, ধানমণ্ডি থানায় দায়ের হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের একটি মামলার তদন্তে নেমে রিয়াদকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রিয়াদ ভুয়া পরিচয় ব্যবহার করে অর্ধশতাধিক মেয়েদের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলে ব্ল্যাকমেইলের ফাঁদে ফেলতেন বলে স্বীকার করেছেন। তার মোবাইল ফোনেও এ ধরনের প্রতারণা করার উদ্দেশ্যে অনেক মেয়েকে ব্ল্যাকমেইলে ফেলার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এডিসি নাজমুল বলেন, এ ধরনের প্রতারণা থেকে বাঁচতে ‘ভার্চ্যুয়াল জগতে কাউকে না জেনে শুনে সম্পর্ক তৈরি করা যাবে না। আপত্তিকর অবস্থায় ভিডিও কল ও অডিও কলে আপত্তিকর কথাবার্তা বলা থেকে বিরত থাকতে হবে। ব্যক্তিগত কোনো ছবি বা ভিডিও কোনোভাবেই কারও সঙ্গে শেয়ার করা যাবে না। এমনকি নিজের বা পরিবারের আপত্তিকর কোনো ছবি বা ভিডিও ধারণ না করার পরামর্শ দিয়েছেন এ ডিবি কর্মকর্তা।
Development by: webnewsdesign.com