বিএনপির এক সময়ের প্রতাপশালী নেতা ও প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরীর মৃত্যুর তথ্য নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। হারিছ চৌধুরীর চাচাতো ভাই আশিক চৌধুরীর দাবি অনুযায়ী চার মাস আগে লন্ডনে মারা গেছেন হারিছ চৌধুরী। অন্যদিকে হারিছ চৌধুরীর মেয়ে দাবি করেছে তার করোনা আক্রান্ত হয়ে বাবা ঢাকায় মারা গেছেন।
হারিছ চৌধুরী মারা গেছেন নাকি মারা যাননি; এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যেও তৈরি হয়েছে নানা কৌতূহল। এবার এই আলোচনায় অনুসন্ধানী তথ্য এনে হাজির করেছে জাতীয় একটি দৈনিক। সংবাদমাধ্যমটির দাবি, আত্মগোপনে থেকে হারিছ চৌধুরী ঢাকায় মারা গেছেন। তবে ভিন্ন পরিচয় ও নামে।
গত ১৫ জানুয়ারি বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে জানা যায়, হারিছ চৌধুরী করোনায় আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় মারা গেছেন। হারিছের বিলেত প্রবাসী মেয়ে ব্যারিস্টার সামিরা চৌধুরী এটা নিশ্চিত করেন। বলেন, তার বাবা হারিছ চৌধুরী গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর করোনায় আক্রান্ত হয়ে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে মারা গেছেন।
ওয়ান ইলেভেনের পালাবদলে দেশ ছাড়েন হারিছ চৌধুরী। তিনি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি। সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যা ও বিস্ফোরক মামলারও আসামি ছিলেন তিনি। কিন্তু ১৪ বছর কোন হদিস ছিল না তার। গোয়েন্দা সংস্থাও হন্যে হয়ে খুঁজেছেন তাকে। ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহকর্মী বা আত্মীয়-স্বজন কেউ তাঁর ব্যাপারে কিছু বলতে পারেননি।
জানা যায়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী দীর্ঘ ১৪ বছর গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে আত্মগোপনে ছিলেন। দেশেই মাহমুদুর রহমান নামে তিনি আত্মগোপনে ছিলেন। সেই মাহমুদুর রহমানেই মারা গেছেন। হারিছ চৌধুরী ওয়ান ইলেভেনের পরপরই কিছুদিন সিলেটে অবস্থান করেন। এরপর ঢাকায় আসেন। ঢাকায় তিনি নাম বদল করেন। পরিচয় দিতেন একজন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক হিসেবে। ঢাকার পান্থপথে প্রায় ১১ বছর কাটিয়ে দেন এই পরিচয়ে। তিনি মাহমুদুর রহমান নামে একটি পাসপোর্টও নেন। পাসপোর্ট নম্বর BW0952982। এতে ঠিকানা দেন শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার। বাবার নাম আবদুল হাফিজ। ২০১৮ সনের ৬ই সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে এই পাসপোর্ট ইস্যু হয়। পাসপোর্টে দেয়া ছবিতে দেখা যায় এ সময় তার চেহারায় এসেছে অনেক পরিবর্তন। সাদা লম্বা দাড়ি। চুলের রঙ একদম সাদা। বয়সের ছাপ পরেছে। শুধু পাসপোর্ট নয় জাতীয় পরিচয় পত্রও পেয়ে যান মাহমুদুর রহমান নামে। তার এনআইডি নম্বর হচ্ছে ১৯৫৮৩৩৯৫০৭।
ঢাকায় যেভাবে ছিলেন হারিছ চৌধুরী
ঢাকার পান্থপথে একটি ভাড়া করা এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে থাকতেন। বাসা থেকে খুব একটা বের হতেন না। একজন কাজের বুয়া ও একটি ছেলে থাকতো তার সঙ্গে। বই পড়ে সময় কাটাতেন। নামাজ আদায় করতেন নিয়মিত। নানা রোগে আক্রান্ত ছিলেন। এই এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের ম্যানেজার সাইফুল ইসলাম বলেছেন, আমি তিন বছর ধরে এখানে কাজ করি। তার সম্পর্কে ব্যক্তিগত তথ্য খুব একটা জানতাম না। শুনেছি তার স্ত্রী ও সন্তানরা থাকেন লন্ডনে। তাকে সবাই প্রফেসর সাহেব বলেই জানতো।
সাইফুল জানান, একদিন ভোর রাতে কেউ একজন তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। শুনেছি হাসপাতালে থাকার পর তার মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর পর তার মেয়েকে দেখি। প্রথমে আমাদেরকে জানাতেও চাননি স্যার মারা গেছেন। মারা যাবার পর দুই মাস এই বাড়িতেই ছিলেন জামাইসহ। গত জানুয়ারিতে তারা বাসা ছেড়ে দেন। হারিছ চৌধুরী খুব একটা বের হতেন না। কথাও বলতেন না। এই বাসার সামনের একটি ফার্মেসী থেকে ওষুধ কিনতেন।
সেই ফার্মেসী সূত্রে জানা যায়, তিনি উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিক ও হৃদরোগের ওষুধ কিনতেন। ফার্মেসীর মালিক সুমন খন্দকার বলেন, স্যার খুব ভাল মানুষ ছিলেন। কখনো বাকিতে ওষুধ নিতেন না। পাশেই একটি মুদি দোকান। এই দোকান থেকেই জিনিষপত্র কিনতেন।
মারা যাওয়া ও দাফন
করোনা আক্রান্ত হলে হারিছ চৌধুরী মাহমুদুর রহমান নামেই হাসপাতালে ভর্তি হন। দাফনও হয় এই নামে। গত বছর ২৬ আগস্ট করোনায় আক্রান্ত হয়ে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন। মারা যান ৩ সেপ্টেম্বর। ডেথ সার্টিফিকেটে বলা হয়েছে তিনি Covid with Septic Shock এ মারা গেছেন। তিনি প্রফেসর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মাহবুব নূরের অধীনে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ৪ সেপ্টেম্বর মৃত্যু সনদ ইস্যু করেন সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. আ ক ম নূর।
তার মৃতদেহ গ্রহণ করেন মেয়ে সামিরা চৌধুরী। এরপর একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে গোসলের জন্য মোহাম্মদপুর নিয়ে যান। কাফনের কাপড় কেনেন মোহাম্মদপুরের মাইকআউস স্টোর থেকে। দাফনের বিষয়ে সামিরা চৌধুরী বলেন, আত্মীয়স্বজনের পরামর্শে বাবাকে সাভারে দাফনের সিদ্ধান্ত হয়। লাশ নিয়ে যাওয়া হয় সাভারের লালাবাদ কমলাপুরে। তাকে জামিয়া মাদ্রাসা প্রাঙ্গণেই দাফন করা হয়।
বাবা গোপনীয়তা সম্পর্কে সামিরা চৌধুরী বলেন, ১৪ বছর যে মানুষটি আত্মগোপনে ছিলেন তার খবর প্রকাশ করা সহজ ছিল না। নানা ভয় আর আতঙ্ক কাজ করেছে। তবে এটা নিশ্চিত করে বলতে পারি অধ্যাপক মাহমুদুর রহমানই আমার বাবা হারিছ চৌধুরী। ডিএনএ টেস্ট করলেই এটা খোলাসা হয়ে যাবে। জীবিত থাকা অবস্থায় আমি লন্ডন থেকে টেলিফোনে উনার সঙ্গে একাধিকবার কথা বলেছি। সুইজারল্যান্ডে অবস্থানরত আমার ভাই নায়েম শাফি চৌধুরীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল।
Development by: webnewsdesign.com