সিলেট অফিস থেকে নাসিম হোসাইন
সিলেট বিভাগের সব জায়গায়ই এখন মাঠ জুড়ে সোনালী হাসি। ঘরে ঘরে ব্যস্ত কৃষাণীর মুখেও আনন্দের বান। মাঠ ভরা ফসলের বাম্পার ফলনে তাদের আত্মতৃপ্তির গল্প। সোনালী ফসলে ভরে উঠছে কৃষকের গোলা। ঘরে ঘরে ব্যস্ত কৃষাণীরা ধান সংগ্রহে। দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ থেকে মাঠ জুড়ে জারি-বাউল আর ভক্তিমুলক গানের সুর। গানের সুরে সুরে চলছে ধান কাটা আর মাড়াইয়ের কাজ।
মাঠের পর মাঠ পেরিয়েও শুধু সোনালী ফসলে হলদে হাসি। রোপা আমনের বাম্পার ফলনে উৎসবের আমেজ গোটা উত্তর সিলেট জুড়ে। সিলেটের সবকটি হাওর ও ফসলী জমিগুলোতে এবার রোপা আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। মৌসুম শুরুর আগে একাধিকবার পাহাড়ি ঢল,বন্যা, ঘূর্ণিঝড় আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ কাটিয়েও এবারের রোপা আমনের ফলন কৃষকদের সকল কষ্টকে ভুলিয়ে দিয়েছে।
আমাদের গোয়াইনঘাট প্রতিনিধি জানিয়েছেন, উপজেলায় রোপা আমনের ল্যমাত্রা ছিলো ১৫ হাজার ৭শত হেক্টর জমি। আর এসব জমি থেকে প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ হাজার মেট্রিক টন ধান উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। অপরদিকে জৈন্তাপুর উপজেলায় হেক্টর জমিতে ল্যমাত্রা ছিলো ১০ হাজার ৮শত ৪৫ হেক্টর জমি। কিন্তু চাষাবাদ ছাড়িয়ে যায় ১১ হাজার ৪শত ১০ হেক্টর জমি। আর এসব জমি থেকে ৪২ হাজার ৮শত ৮৭ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হবে বলে জানায় উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।
সরজমিনে পরিদর্শনকালে গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুরের ফসলের মাঠজুড়ে রোপা আমনের বাম্পার ফলনের চিত্রটি দেখা যায়। গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুরের উপজেলা দুই নির্বাহী অফিসারদের সরাসরি তদারকি এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা উভয় উপজেলার কৃষকদের মাঝে একাধিক কৃষক সমাবেশ করেন। প্রশিণের পাশাপাশি তাদেরকে ভালো বীজ,সার ব্যবহারে পরামর্শ দেয়া হয়।
প্রশাসন তরফে স্থানীয় জাতের রোপা আমনের পরিবর্তে বন্যাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ সহনীয় ও বেশি ফলনশীল উপসি জাতের রোপা আমন চাষে উৎসাহিত করা হয়। এবার আবহাওয়া প্রায় অনুকূলে থাকার কারণে রোপা আমনের অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে বাম্পার ফলন হয়েছে এবং এ মৌসুমে উৎপাদিত ধানের শতভাগ ঘরে তুলা সম্ভব বলে ধারনা কৃষি বিভাগের।
সরজমিনে পরিদর্শনকালে চোখে পড়ে গোয়াইনঘাটের লেঙ্গুড়া, ডৌবাড়ি, রুস্তমপুর,আলীরগাঁও,পূর্ব জাফলং,পশ্চিম জাফলং, তোয়াকুল, নন্দিরগাঁও ইউনিয়ন ও জৈন্তাপুরের দরবস্ত, জৈন্তাপুর, চারিকাটা, ফতেহপুরের বিস্তৃত ফসলের মাঠ জুড়ে ধান আর ধান। সোনালী রংয়ের ফসলের মাঠ জুড়ে কৃষকের মুখে তৃপ্তির হাসি। আনন্দ, উল্লাসে চলছে ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ। বেশিরভাগ এলাকায় চাষিদের পাশাপাশি শ্রমিক লাগিয়েও চলছে ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কার্যক্রম। কোথাও কোথাও সরকারের ভর্তুকির সুবিধায় পাওয়া কম্বাইন্ড হারভেষ্টার মেশিনেও চলছে ধান কাটা, মাড়াই ও ধান বস্তাবন্দি করার চিত্রও চোখে পড়ে। মাঠজুড়ে চোখে পড়ে ধান উৎসবের আনন্দঘন পরিবেশ। বাড়ি থেকে পাঠানো বিন্ন ভাত আর ঝাল মাংসের ঝুল দিয়ে েেতর আলে বসেই কেউ কেউ দুপুরের আহার সারছেন। ধান কাটার সময় পালা করে বাউল, জারি, ভক্তিমুলক বিভিন্ন ধরণের গান গাইতেও দেখা যায় কৃষকদের।
সরজমিন পরিদর্শনকালে কোথাও কোথাও ধানকাটা শ্রমিক সংকটের বিষয়টি চোখে পড়ে। ২ ডিসেম্বর গোয়াইনঘাটের ডৌবাড়ি ও ৩ ডিসেম্বর পূর্ব জাফলং ভিত্রিখেল হাওর পরিদর্শনকালে দেখা যায় উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিশ্বজিত কুমার পাল উপস্থিত থেকে সরকারের ভর্তুকির সুযোগে ক্রয়কৃত কম্বাইন্ড হারভেষ্টার মেশিন দিয়ে কৃষকদের ডিজিটাল (যান্ত্রিক) পদ্ধতিতে ধান কাটা, মাড়াই ও ধান বস্তাবন্দির কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। এসময় তিনি স্থানীয় কৃষকদের বিভিন্ন সমস্যার বিষয়ে অবহিত হওয়ার পাশাপাশি কৃষি ব্যবস্থাপনা সরকারের আন্তরিকতা ও উদ্যোগের পরিসংখ্যান তুলে ধরেন। তিনি আধুনিক ও ডিজিটাল করণের বিষয়টি তুলে ধরে এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে কৃষক পরিবারের সবাইকে উদ্বুদ্ধ করেন।
ডৌবাড়ির ঘোড়াইল বাজার সংলগ্ন ধান েেত কথা হয় কৃষক আজির উদ্দিনের সাথে। উপসি জাতের রোপা আমন ধান বুনেছিলেন এ কৃষক। তিনি জানান, এবার তিনি ৬ বিঘা জমিতে উপসি রোপা আমনের চাষ করেছেন। ফলনও বাম্পার হয়েছে। এ জমি হতে তার ৫০ থেকে ৭০ মণ ধান পাওয়া যেতে পারেন বলে তিনি জানান।
পশ্চিম জাফলং ইউনিয়নের ইসলামাবাদ গ্রামের বাসিন্দা জমির উদ্দিন জানান, তিনিও কৃষি বিভাগের তত্ত্বাবধানে ১০ বিঘার মতো জমিতে এবার উপসি রোপা আমন বুনেছেন। ফলনও বাম্পার হয়েছে। এবার তার জমি থেকে ৮০ থেকে ১০০ মণ ধান পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে তিনি জানান।
জৈন্তাপুর উপজেলার দরবস্ত চাল্লাইন গ্রামের কৃষক সিরাজুল ইসলাম এবং সারীঘাট রনিফৌদের কৃষক জামাল উদ্দিনও জানান রোপা আমনের ভালো ফলন এবং ধান রোপণের সফলতার কথা। তারা জানান, সরকারের বিনা মূল্যের সার, বীজ, প্রণোদনা এবং ভর্তুকির সুযোগে ডিজিটাল যান্ত্রিক পদ্ধতি দেশের কৃষি ব্যবস্থায় নতুন মাত্রা যুগ করেছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে এখানকার কৃষি ব্যবস্থাপনা আরও প্রসারিত হবে, কৃষকরা উপকৃত হবে। পতিত জমিগুলো চাষাবাদের আওতায় আসলে কৃষিতে বিপ্লব ঘটবে।
গোয়াইনঘাটের উপজেলা আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক কামরুল হাসান জানান, গোয়াইনঘাট জৈন্তাপুর ও কোম্পানিগঞ্জের কৃষি বিপ্লবের নায়ক মন্ত্রী ইমরান আহমদ। তার প্রচেষ্টায় বিনা মূল্যে সার, বীজ,উপকরণসহ কৃষকদের কল্যাণে সরকারি নানা প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। আজকের রোপা আমনের যে মাঠভরা সফলতা তার প্রশংসার দাবিদার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদ এমপি। দেশের কৃষি ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে কৃষিবান্ধব বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকারের সময়োপযোগী ইতিবাচক ভূমিকা জনসাধারণের কাছে প্রশংসিত হচ্ছে।
এব্যাপারে কথা হলে জৈন্তাপুর উপজেলায় কর্মরত ও গোয়াইনঘাটের (ভারপ্রাপ্ত) উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ফারুক হোসাইন জানান, গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুরে সর্বকালের রেকর্ড পরিমাণ রোপা আমন চাষ হয়েছে। এবার অত্রাঞ্চলে ২৬ হাজার হেক্টর জমিতে স্থানীয় উপসি জাতের রোপা আমন চাষ হয়েছে। বন্যা ও পরিবেশ সহনীয় জাতের উপসি রোপা আমন চাষে উৎসাহিত হওয়ায় বাম্পার ফলনও হয়েছে। অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে এবারই হয়তো সবচেয়ে বেশি ধান উৎপাদনের নজির গড়ছে এ দুই উপজেলায়। এবার ৭৭ থেকে ৮০ হাজার মেট্রিক টন এ দুই উপজেলা থেকে উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে।
গোয়াইনঘাটের উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিশ্বজিত কুমার পাল জানান, এটা সর্বকালের রেকর্ড অতিক্রম করেছে গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুরের কৃষি ব্যবস্থাপনায়। কৃষিবান্ধব এই সরকার কৃষকের পাশে আছে,এবং তাদের কল্যাণে আন্তরিকতার সহিত কাজ করছে। সরকারের প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ এমপির নিজের প্রচেষ্টায় অত্রাঞ্চলের কৃষকদের সরকারি তরফে বিনামূল্যে সার, বীজ প্রদান, প্রণোদনাসহ কৃষি উপকরণ ও ভর্তুকির আওতায় সহজ শর্তে ডিজিটাল যান্ত্রিক পদ্ধতি কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। পতিত জমিগুলোকে চাষাবাদের আওতায় এনে সেখানে ফসল আবাদের উপযোগী করতে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বন্যা ও পরিবেশ সহনীয় বেশি ফলনযোগ্য ধান উৎপাদনে কৃষকদের উৎসাহিত করায় এমন বাম্পার ফলন সম্ভব হয়েছে। উপজেলা জুড়ে কৃষকদের রোপায়িত ফসল ঘরে তুলতে যে কোন ধরণের সহযোগিতায় প্রশাসনের কর্মকর্তারা মাঠে রয়েছেন। কৃষি বান্ধব সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তানুসারে এবার গোয়াইনঘাট থেকে কৃষকের উৎপাদিত ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করণে এবার গোয়াইনঘাট থেকে সরকার ২৬ টাকা দরে সরকার ১৫শত ৪৩ মেট্রিকটন ধান সংগ্রহ করবে।
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ এমপি বলেন, বাংলাদেশের কৃষক আর কৃষি ব্যবস্থাপনার পরমবন্ধু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার নিজস্ব চিন্তা চেতনা থেকে কৃষকদের বাচাতে নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে সার, বীজ ও ভর্তুকির আওতায় সহজ শর্তে কৃষি উপকরণ কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ায়ই দেশের কৃষকরা আজ সফলতা পাচ্ছেন। আমাদের এলাকার কৃষকের জন্য আমি যা করেছি তা তারা অবগত আছে। আমি তাদের পাশে ছিলাম, তাদের কল্যাণে ভবিষ্যতেও আমি নিরলসভাবে কাজ করে যাবো।
Development by: webnewsdesign.com