বিএনপিতে শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়েছে। কেন্দ্র থেকে মহানগর, জেলা, উপজেলা হয়ে পৌরসভা ও ইউনিয়ন পর্যন্ত নানাভাবে চলছে এ অভিযান। দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করায় কাউকে দেওয়া হচ্ছে অব্যাহতি, শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে কেউ হচ্ছেন বহিষ্কার। আবার কমিটি গঠনের পরিণামেও বাদ পড়ছেন। এভাবেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চলছে শুদ্ধি অভিযান। আর কমিটি পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে এবার অধিক প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে অপেক্ষাকৃত তরুণ, সাহসী নতুন মুখ। বিশেষ করে যারা রাজপথের গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে পারবেন, সে ধরনের নেতাদেরই সামনে আনা হচ্ছে। অন্যদিকে নির্বাচনের পাশাপাশি দল পুনর্গঠন কেন্দ্র করে তৃণমূলে কোন্দল মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। দীর্ঘদিন মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকার পর হঠাৎই তাদের সরিয়ে দেওয়ার ফলে এ পরিস্থিতি। দলের নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলোর মাধ্যমে এসব তথ্য জানা গেছে।
দলে এ শুদ্ধি অভিযানের পক্ষে কেন্দ্রীয় নেতাদের যুক্তি হলো- যুগের পর যুগ একই ব্যক্তি একই পদে থাকবেন, একই ব্যক্তি বড় বড় পদে থাকবেন; আর সারা জীবন মন্ত্রী হবেন, এমপি হবেন তা তো হতে পারে না। তা ছাড়া ৪০ বছর বয়সী ব্যক্তি যেভাবে কাজ করতে পারবেন, ৬৫ বছর বয়সীর পক্ষে তা সম্ভব নয়। এ ছাড়া নতুন নেতৃত্ব তৈরির ক্ষেত্রেও অবশ্যই পরিবর্তন প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লা বুলু বলেন, ‘বিএনপিতে জিয়াউর রহমানের পরিবারই শুধু অপরিহার্য। বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। এর বাইরে আমরা যে যত বড় নেতাই হই না কেন কেউই অপরিহার্য নই। দলের হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নিজেকে জাহির করাটাই সাংগঠনিক অপরাধ। শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে দলের স্বার্থে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি অপরিহার্য। কে কত বড় নেতা তা দেখার বিষয় নয়।’
বিএনপির রাজশাহী বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বলেন, ‘দলের হাইকমান্ড যা কিছু করছেন সবই দলের স্বার্থে। তিনি উপলব্ধি করছেন এখন তরুণদের সামনে আনা দরকার, সেজন্য এমনটি করা হচ্ছে।’ তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, ‘৩০ বছর বয়সে আমি যেসব কাজ করেছি তা এখন আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। নাটোরে দীর্ঘদিন জেলার দায়িত্বে ছিলাম।’ তিনি বলেন, ‘বড় দল হিসেবে বিএনপিতে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা থাকবেই। তবে দলের প্রধানের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।’ দলের নীতিনির্ধারক মহলের সদস্যরা এ উদ্যোগকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে নিলেও নেতা-কর্মীদের বহিষ্কার, পদ থেকে অব্যাহতি ও স্বেচ্ছায় পদত্যাগের ঘটনা এসব নিয়ে দলের ভিতরে এক ধরনের অস্থিরতা দেখা দিচ্ছে। বিশেষ করে কমিটি পুনর্গঠন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন কেন্দ্র করে দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত নেতাদের ছাঁটাই করা হচ্ছে। পরীক্ষিত নেতা-কর্মীদের দল থেকে বাদ দেওয়ায় তৃণমূলে ক্ষোভ ও হতাশা বাড়ছে। এতে আগামী দিনে রাজপথের আন্দোলনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তৃণমূল নেতারা দলের (কেন্দ্রীয়) সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতাকেই দায়ী করছেন। আবার এ বহিষ্কার ও অব্যাহতির পেছনে ষড়যন্ত্রও দেখছেন কেউ কেউ। দলীয় হাইকমান্ডকে ভুল বুঝিয়ে দলের একটি অংশ এসব সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে কাজ করছে বলে অভিযোগ তাদের। তবে দলের নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষায় এসব পদক্ষেপ গ্রহণ ছাড়া তাদের হাতে আর কোনো বিকল্প নেই। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘দল একটা নিয়ম-কানুনের মধ্য দিয়ে পরিচালিত হয়। কেউ যদি শৃঙ্খলা না মানেন তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কেউ কাজ করলে তাকে তো দলের আদর্শিক নেতা বলা যায় না। জানা যায়, বরিশাল জেলা ও মহানগরের রাজনীতিতে দীর্ঘদিনের নেতৃত্ব- মজিবর রহমান সরোয়ারকে হঠাৎ বাদ দেওয়ায় সেখানকার নেতা-কর্মীদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। একই অবস্থা রাজশাহীতেও। মহানগরী বিএনপি থেকে হঠাৎ সরিয়ে দেওয়া হয় রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলকেও। এ নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। খুলনায় নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে বাদ দেওয়ায় নেতা-কর্মীরা প্রকাশ্যে বিক্ষোভ করেন। খুলনা জেলা ও মহানগরীর কমিটি পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়ে প্রকাশ্যে সংবাদ সম্মেলন করায় এবং দলের সিদ্ধান্ত না মানায় প্রথমে তাঁকে শোকজ ও পরে কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। কেন্দ্রের এমন সিদ্ধান্তের পর খুলনা জেলা ও মহানগরী বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের ৫ শতাধিক নেতা একযোগে দল থেকে পদত্যাগ করেন। নজরুল ইসলাম মঞ্জু এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘যে কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে দলকে আরও দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন ইস্যুতে কেন্দ্রের সিদ্ধান্তে বিভ্রান্তি ছিল। দলের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে অনেকে নির্বাচন করেছেন। কেউ কেউ চেয়ারম্যানও হয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে দল ব্যবস্থা নেয়নি। অথচ নারায়ণগঞ্জের ভোটের পর দুজনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এটা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে।’ স্থানীয় নেতাদের মতে, তৈমূরের মতো নেতা এক দিনে সৃষ্টি হন না। দীর্ঘদিন রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আজকের পর্যায়ে এসেছেন তিনি। হঠাৎ এমন একজন পরীক্ষিত নেতাকে বহিষ্কার করা উচিত হয়নি। তৈমূর আলম খন্দকারের মতো পরীক্ষিত নেতা-কর্মীদের বহিষ্কারে তৃণমূলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কি না তা সময়ই বলে দেবে। এ ছাড়া সম্প্রতি পৌরসভা নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় নোয়াখালী পৌরসভা বিএনপি সভাপতি ও জেলা বিএনপির কোষাধ্যক্ষ আবু নাছের, জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শহীদুল ইসলাম কিরণ, নাটোর পৌর বিএনপির আহ্বায়ক শেখ এমদাদুল হক মামুন (এমদাদ), নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক শরিফুল ইসলাম লেলিন (ভিপি লেলিন) ও পৌর বিএনপির আহ্বায়ক আমিরুল ইসলাম জামালকেও তাঁর পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। দলীয় নির্দেশ লঙ্ঘন করে পৌরসভা নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় নোয়াখালী ও নাটোরের এ পাঁচ নেতাকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
Development by: webnewsdesign.com