নাব্যতা সঙ্কটে বালুনদী-নৌযান চলাচল ব্যাহত-ড্রেজিং হয়না বহু বছর

বুধবার, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ২:৩৩ অপরাহ্ণ

নাব্যতা সঙ্কটে বালুনদী-নৌযান চলাচল ব্যাহত-ড্রেজিং হয়না বহু বছর
apps

বর্ষা মৌসুম ছাড়া বছরের প্রায় পুরো সময়টাই নদীর বুক থাকে পানিশূন্য। নদীর বুকজুড়ে ধু-ধু বালুচর, কোথাও চাষাবাদ, কোথাও গরু চরানো কিংবা দুরন্ত কিশোরদের খেলাধুলার দৃশ্য চোখে পড়ে। আর আজ বালুনদের বুকে পানির অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। বৃহৎ নদীটির দুরবস্থার কারণে শুধু নৌযান চলাচলই বন্ধ হয়নি, মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করা হাজার হাজার জেলে পরিবারেও চলছে দুর্দিন। অনেকেই মাছ ধরার পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন। যারা পেশা বদল করতে পারেননি, তাদের জীবন কাটছে মানবেতর ভাবে।
নদী মরে যাওয়ায় কৃষিনির্ভর এ এলাকার সেচ কাজও দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। সরজমিনে উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, বালু, শীতলক্ষ্যা নদীতে বিশাল বিশাল চর পড়েছে। চরে আবাদ হচ্ছে ফসলের। অনেক জায়গায় চলছে নদী দখলের মহাযজ্ঞ। গিয়াস উদ্দিন বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছে তার বর্তমান বয়স প্রায় ৭৫ বছর। রূপগঞ্জ সদর ইউনিয়নের জাঙ্গীর এলাকার শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে তার বাড়ি। তিনি বলেন, ‘২০ বছর আগেও এত খারাপ অবস্থা ছিল না। এই নদী একসময় বাড়ির পাশে ছিল। মাছ ধরতাম, গোসল করতাম। ঘরের কাজ, কৃষি কাজ সব নদীর পানি দিয়েই করতাম। এখন আর নদীতে পানি নেই। বেশির ভাগ জায়গা ভরাট হয়ে গেছে, দখল হয়ে গেছে।’
আরেক কৃষক ইসমাইল বলেন, ‘বালুনদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় সেচকাজে পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। কৃষিকাজ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’ বালু নদী পাড়ের রূহুল আমিন মিয়া বলেন, ‘আমরা বাপ-দাদার আমল থেকে এই নদীতে মাছ ধরে বিক্রি করে সংসার চালাতাম।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ সম্প্রসারণ কর্মকর্তা রিগেন মোল্লা বলেন, মাছ, জলজ পতঙ্গ, পাখিসহ অনেক প্রাণী নদীর ওপর নির্ভরশীল। নদী শুকিয়ে গেলে বিলুপ্ত হয়ে যাবে তারাও, কমবে মাছের প্রজনন।
বালুরপাড় সরকারী বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কৃষ্ণ গোপাল সরকার বলেন, নদীর পাড়ে অবৈধভাবে নদী দখল করে ভরাট করেছেন ব্যবসায়ীরা। দুই পাড়েই গড়ে উঠেছে অসংখ্য ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান।
বালু নদী বাংলাদেশের উত্তর-কেন্দ্রীয় অঞ্চলের গাজীপুর, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ জেলার একটি নদী। নদীটির দৈর্ঘ্য ৪৪ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ৭৯ মিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের উত্তর-পূর্ব এলাকা দিয়ে প্রবাহিত একটি নদী। এটি বেলাই বিল ও ঢাকার উত্তর-পূর্ব বিস্তীর্ণ জলাভূমির উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ডেমরার কাছে শীতলক্ষ্যা নদীতে গিয়ে পড়েছে। শীতলক্ষ্যার সাথে কাপাসিয়ার কাছে সুতি নদীর মাধ্যমেও এর একটা ক্ষীণ যোগাযোগ ছাড়াও টঙ্গী খালের মাধ্যমে তুরাগ নদীর এসে মিলিত হয়েছে। বর্ষা মৌসুমে বালু নদী শীতলক্ষ্যা ও তুরাগের পানি বহন করে। এই নদীর গুরুত্ব হচ্ছে, এটি স্থানীয় পানি নিষ্ক্রমণ আর নৌ-পরিবহন অব্যাহত রাখে।
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপরে সময়োচিত নদী ড্রেজিং প্রকল্প বাস্তবায়নের অভাবে বালু নদীটি বর্তমানে মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। প্রচন্ড- খরস্রোতা এই নদীটিতে প্রতি বছরের ৭/৮ মাসই পানিশূন্যতা বিরাজ করছে।নাব্যতা সংকটে নৌযান চলাচল ব্যাহত, স্থায়ী সমাধানে উদ্যোগ নিন।
নদী হচ্ছে দেশের প্রাণ। নদী সারাদেশকে জালের মতো আকড়ে ধরে আছে। এই নদী আমাদের কম খরচে পরিবহন ও যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম। দখল, দুষণ আর সঠিকভাবে খনন কাজ না হওয়ায় সেই নদী আজ মরতে বসেছে। বর্ষা-শীত সব মৌসুমে নদীগুলোতে নাব্যতা সংকট তীব্র আকার ধারণ করছে। নদীগুলোর নাব্যতা ফেরাতে না পারলে সারা দেশের সঙ্গে রাজধানী ঢাকা এবং বন্দর নগর চট্টগ্রামের সঙ্গে নৌযোগাযোগ হুমকীর মুখে পড়বে। এখনই নাব্যতা সংকট দূর করতে উদ্যোগ নিন। নাব্যতা সংকট সমাধানে টেকসই খনন কাজ করতে হবে। নিতে হবে স্থায়ী সমাধানের উদ্যোগ বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দারা।
ভোক্তভুগীরা বলেন, আমরা জানতে চাই, প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ হলেও বছর ঘুরতেই কেন নাব্যতা সংকট তীব্র হবে? তাহলে নাব্যতা ফেরাতে যে অর্থ ব্যয় হচ্ছে সেটা কোথায় যাচ্ছে? খনন নিয়ে মানুষের মনে যে প্রশ্ন উঠছে সেই প্রশ্নের উত্তর তো দিতেই হবে। নদীর নাব্যতা ফেরাতে স্থায়ী সমাধান চায় দেশের মানুষ। কারো দোষ নয়, কার্যকর উদ্যোগ নিয়ে নদীর নাব্যতা ফেরাতেই হবে।
প্রতি বছর নদীর নাব্যতা ফেরাতে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ হয় খননে। তারপরও নদীর নাব্যতা ঠিক রাখা যাচ্ছে না। নৌযান মালিক এবং চালকদের অভিযোগ সঠিকভাবে খনন হয় না বলেই নৌপথে নাব্যতা সংকট কমছে না। আর বিআইডব্লিউটিএ-এর খনন বিভাগের দাবি প্রতি বছর বন্যার পানির ঢলে প্রচুর পলি থাকে। সেই পলি আমাদের নদীগুলোতে জমে নাব্যতা সংকট সৃষ্টি করে। তাছাড়া রাজধানীর ময়লা আবর্জনা এখন নদীতে ফেলাতে নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে।
স্থানীয় জনগন বলেন, আমরা চাই, নদী খননের নামে যেসব অভিযোগ আছে সেই অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখা হোক। একই সঙ্গে নদীপথ সচল রাখতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হোক। খনন নিয়ে কোন দুর্নীতি হয়ে থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। যে কোন কিছুর মূল্যে আমাদের নদী সম্পদ রক্ষায় স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।
দূর্যোগের মধ্যেও এক শ্রেণির লোভি মানুষ পানি শূন্য নদীতে চলাচ্ছে দখলের উৎসব। একই সাথে বিভিন্ন নদী তীরবর্তী এলাকার কল-কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য এবং দূষিত আবর্জনা ফেলার কাজ চলাচ্ছে এখনো। নদীতে দূষিত আর্বজনার কারণে দূষণের মাত্রা এতোই বেড়েছে যে, নড়াই নদী, বালুনদী, শীতলক্ষা নদীসহ তুরাগ নদীর বিভিন্ন এলাকায় নদীর জলে আগুন জ্বলে! আর এই নদীগুলোর দুই পাড়ের সকল বাসিন্দাদের রোগ ব্যধির ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে।
নদী নির্ভর সেচ কাজ ব্যাহত হয়ে পড়েছে। মাছ শুণ্য হয়ে গেছে বেশীর ভাগ নদ-নদী। এই অবস্থা চলতে থাকলে দেশে এক ভয়াবহ সংকটের মধ্যে পড়বেই। নদীর বয়ে আসা পলিমাটিতেই বাংলাদেশের কৃষিজমি অত্যন্ত উর্বর। কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে নদীই ভরসা। পরিবহণের তিন-চতুর্থাংশ নদীপথে। সেচ আর বিদ্যুতের জন্যও নদীর দরকার। নদীর মাছ শুধু দেশের অর্থনীতির স্তম্ভ নয়, বৈদেশিক মুদ্রাও এনে দেয়।
বর্তমানে দেশের নদ-নদীগুলো যৌবন হারিয়ে বৃদ্ধ অবস্থায় মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। যৌবনহারা এসব নদী বাঁচিয়ে রাখতে কার্যকর কোনো ব্যবস্থাও চোখে পড়ে না। এখনই নদীগুলোকে বাঁচানো না গেলে দেশকে একসময় বাঁচানো সম্ভব হবে না। কারণ নদীগুলো ঘিরেই গড়ে উঠেছিল দেশের প্রতিটি শহর, বন্দর ও হাটবাজার। এগুলো এখন শুধুমাত্র স্মৃতি।
এক সময় মালামাল পরিবহন ও যোগাযোগের সহজ উপায় ছিল নৌকা। এখন এই নৌকার দেখা মেলা ভার। সময়ের বিবর্তনে যেটুকু নদী পারাপারের বাহন রয়েছে তা দখল করেছে ইঞ্জিনচালিত নৌকা। জলবায়ু পরিবর্তন, দখল, দূষণসহ নানা কারণে নদনদীর অস্তিত্ব বিলুপ্তির পথে।
নদী নিয়ে সুনিদৃষ্টি কর্মপরিকল্পনা না থাকায় বছরের পর বছর ধরে আবহাওয়া ও জলবাযু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে নদী স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারছে না। বৃষ্টিপাত কম হওয়া ও খরা মৌসুমে অপরিকল্পিতভাবে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করায় পরিস্থিতি দিন দিন জটিল হয়ে উঠছে। এখনো শতাধিক নদী যৌবন হারিয়ে ক্ষীণ ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। দিনের পর দিন পলি পড়ে ভরাট হয়ে নাব্যতা ও গভীরতা হারাচ্ছে দেশের নদীগুলো। খননের অভাবে বালু, শীতলক্ষাসহ অন্যান্য নদীগুলো এখন ধু-ধু বালুচর। এছাড়া অব্যাহত রয়েছে নদী দখল ও দূষণ। ফলে কৃষি, জনস্বাস্থ্য, প্রাণি,উদ্ভিদ হুমকির মুখে পড়েছে।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিআইডব্লিউটিএ’র এক কর্মকর্তা বলেন, রাজধানীর ময়লা আবর্জনা নদীতে ফেলা বন্ধ না করলে শুধু ড্রেজিংয়ে কাজ হবে না। প্রতিনিয়তই নদীতে চলছে দখল আর দূষণ। অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ ও ড্রেজিং আমাদের ধারাবাহিক কার্যক্রম। এ কার্যক্রম অব্যাহতভাবে চলছে।

Development by: webnewsdesign.com