দুর্নীতির আগুনে জ্বলছে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

শনিবার, ০৪ জানুয়ারি ২০২০ | ২:৫১ অপরাহ্ণ

দুর্নীতির আগুনে জ্বলছে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
apps

পদে পদে দুর্নীতি আর লুটপাটের অভরায়ণ্যে পরিণত হয়েছে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। সিলেট বিভাগের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল ও সিলেটবাসীর শেষ ভরসাস্থল এটি। রোগীদের খাবার আত্মসাৎ, চিকিৎসকদের অবহেলা, নার্সিং পরীা পদে বিবাহিতদের স্থান দেওয়া, নিয়োগ বাণিজ্য ও গেইট-দারোয়ানদের রমরমা চাঁদা আদায়, রোগীদের সরকারি ঔষুধ না দিয়ে বাইরে থেকে ক্রয় করানো, যথাসময়ে চিকিৎসক না পাওয়াসহ বিস্তর অভিযোগ রয়েছে সরকারি এই হাসপাতালের বিরুদ্ধে।

ডাক্তার থেকে শুরু করে হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট অনেকে দুর্নীতির জালে হাবুডুবু খাচ্ছেন বলে অভিযোগের শেষ নেই। সরকার মানুষের স্বাস্থ্য সেবার উন্নতির জন্য কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছে। কিন্তু কতিপয় অসাধু ডাক্তারের কারণে সরকারের মহতী উদ্যোগ ভেস্তে যাচ্ছে। গত বুধবার ওসমানী হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগ সরেজমিন ঘুরে দেখা যায় অনিয়মের নানা দৃশ্য।
বিভিন্ন ওয়ার্ডে সিট খালি থাকার পরও রোগীদের নিচে রাখা হয়েছে। ওয়ার্ড কর্তৃপ রোগীর স্বজনদের বলছেন, সিট খালি নেই। আবার ওয়ার্ডবয় ও দালালরা বলছেন, টাকাপয়সা খরচ করতে পারলে সিট ম্যানেজ করে দিতে পারবে। অথচ দেখা গেছে, খালি সিটে রোগীদের বদলে বিড়াল ঘুমাচ্ছে। রোগীদের পাশাপাশি স্বজনরা ওয়ার্ডের বারান্দায় রাত কাটাচ্ছেন।

নির্যাতন-নিপীড়ন কিংবা সংঘর্ষের জেরে আহত হওয়ার পর মামলা করার একটা নিয়ম রয়েছে। তা হচ্ছে, মামলার জন্য যে মেডিকেল সার্টিফিকেট প্রয়োজন পড়ে, চিকিৎসা কর্তৃপ তাৎণিকভাবে তা দেয় না। এজন্য সরকারি হাসপাতালের ‘পুলিশ কেস’ সিল মারা প্রেসক্রিপশন দেখাতে হয় থানায়।
মামলা করার পর পুলিশ হাসপাতাল থেকে আহত ব্যক্তির মেডিকেল সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে। আইনের এই সুযোগটিই নিচ্ছে একটি অসাধু চক্র। অভিযোগ রয়েছে, কেউ হামলা-নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়ে এখানে চিকিৎসা করাতে এলে ‘পুলিশ কেস’ সিলের জন্য তাকে টাকা দিতে বাধ্য করা হয়। এই টাকার পরিমাণ ২০০ থেকে ৫০০ টাকা। টাকা নেন ‘পুলিশ কেস’ সিল রাখা কাউন্টারের কর্তব্যরত ব্যক্তিরা।
অথচ এ ধরনের টাকা আদায়ের কোনো আইন বা নিয়ম নেই। এসব কাজ বেশিরভাগ ওয়ার্ড বয়দের মাধ্যমে হয়ে থাকে। এমন মন্তব্য করেন, দণি সুরমা উপজেলার মোগলাবাজার থানার সোনাহর আলী। খোঁজ নিয়ে এর সত্যতাও পাওয়া যায়। এছাড়া মামলার সার্টিফিকেটবাণিজ্য করার জন্য অসাধু চক্র সামান্য আহত রোগীদের দিনের পর দিন হাসপাতালে ভর্তি রেখে মোটা অঙ্কের সুযোগ সুবিধা নিচ্ছে। আর অনেক জটিল রোগীকে কিছু সুস্থ হলেই সিট কেটে দেওয়া হচ্ছে।

জরুরি বিভাগে আসা রোগীদেরও চিকিৎসা নিতে প্রায় ঘন্টাখানেক অপো করতে হয়। বুলবুল আহমদ নামে নগরীর ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই এলাকার বাসিন্দা বলেন, আমার ভাগনাকে রক্তাক্ত অস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার প্রায় ঘন্টাখানেক পর তার চিকিৎসা শুরু হয়। হবিগঞ্জ জেলার আজমিরীগঞ্জের মিজানুর রহমান বলেন, তার গর্ভবতী স্ত্রীকে নিয়ে ২ দিন থেকে হাসপাতালে ভর্তি আছেন। প্রতি রাতে বারান্দায় ঘুমিয়ে রাত কাটাতে হয়। আত্মীয়স্বজনরা রোগী দেখতে আসলে গেইটের পাহারাদারকে টাকা দিতে হয়। তাছাড়া হাসপাতালে পর্যাপ্ত ঔষধ থাকা সত্ত্বেও সকল ঔষধ বাইরে থেকে কিনে আনতে হচ্ছে।
সরকারি ঔষধের কথা বললে রেগে যান নার্সরা। টেস্টগুলোও তাদের নির্দিষ্ট জায়গায় করাতে হচ্ছে। অনেক সিট থাকা সত্তেও আমার স্ত্রীকে দেওয়া হয়নি। ওয়ার্ডবয়দের মাধ্যমে টাকার বিনিময়ে সিট দেওয়া হয়। ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগী নিয়ে আসা জকিগঞ্জ উপজেলার সিরাজুল ইসলাম বলেন, সিলেটে দুর্নীতির তালিকায় শীর্ষ তালিকায় হবে ওই হাসপাতাল। একজন ইমার্জেন্সি রোগীকে প্রায় ঘন্টাখানেক দাঁড় করে রাখার পর চিকিৎসা দেওয়া হয়।

দালালদের মাধ্যমে গেলে সহজে রোগী দেখানো যায়। সকল ঔষধপত্র বাইরে থেকে কিনে নিয়ে আসতে হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছু রোগী দেখতে আসা একজন শিক বলেন, হাসপাতালটি দুর্নীতির আগুনে জ্বলছে। কেউ প্রতিবাদ করতে গেলেই পুলিশ দিয়ে ভয় ভীতি দেখানো হয়। গত ২৪ নভেম্বর সিলেট-১ (সদর) আসনের এমপি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনের স্ত্রী সেলিনা মোমেন পরিচয় গোপন রেখে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। দুপুর ১টার দিকে ওসমানী হাসপাতালে গিয়ে জরুরি বিভাগে সেবা নিতে চান তিনি। জানানো হয়, জরুরি বিভাগে এই সেবা বন্ধ। এরপর ১০ টাকার টিকিট কেটে রোগীদের লাইনে দাঁড়ান। বাইরে রোগীর দীর্ঘ লাইন থাকলেও চিকিৎসকরা কে গল্প-আড্ডা দিচ্ছিলেন। পরে সেলিনা মোমেন হাসপাতালের গাইনিসহ বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে দেখেন এবং রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেন। বিভিন্ন পরীা ও এক্স-রের জন্য রোগীদের বাইরে পাঠানোর চিত্রও দেখেন। তিনি জানতে চাইলে বলা হয়, দুপুর ১টার পরে হাসপাতালের ভেতরে কোনো পরীা করা হয় না। এ সময় সেলিনা মোমেন বলেন, একটি সরকারি হাসপাতাল এত নোংরা-অপরিচ্ছন্ন হতে পারে, তা কল্পনাও করা যায় না। তাহলে সরকার কেন এত টাকা খরচ করছে সরকারি হাসপাতালে? সংশ্লিষ্টদের অবহেলার কারণেই এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

এদিকে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপ ওই হাসপাতালের দুর্নীতির বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা না নিলেও দুর্নীতি দমন কমিশনের হাতে ধরা পড়ছেন তিনজন। ১৬টি ভুয়া বিল দেখিয়ে ৬২ লাখ ৭২ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছেন ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাবেক উপপরিচালকসহ তিনজন। ইতোপূর্বে এ ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সিলেটের সমন্বিত কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মনজুর আলম চৌধুরী বাদি হয়ে মামলা করেছেন। হাসপাতালের সাবেক উপপরিচালক ডা. মো. আব্দুস সালাম, সাবেক হিসাবরক আব্দুল কুদ্দুুস আটিয়া ও মালামাল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স এমএস এন্টাপ্রাইজের মালিক মির্জা এসএম হোসেন ওরফে সাদ্দাম হোসেনকে এ মামলার আসামি করা হয়েছে। সেই সময় হাসপাতালের অসিফ সহকারী কম্পিউটা অপারেটর নূও মোহাম্মদ দূর্নীতির সিলেট নগরীর বিশাল সম্পদ অর্জন করেছে। তাকে নিয়ে নিয়মিত বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখা লেখি হলোও বার বার সে আইনের ফাকে বেরিয়ে যায়।

এ ব্যাপারে সিলেট জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. নুর-ই-আলম বলেন, প্রাথমিক তদন্তে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। মামলাটি অধিকতর তদন্ত করে চার্জশিট দেবে দুদক। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, হাসপাতালের ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এমএসআর সামগ্রী ও বিবিধ মালামাল কেনার জন্য মেসার্স এমএস এন্টার প্রাইজকে কার্যাদেশ দেয়া হয়। সে অনুযায়ী এমএস এন্টারপ্রাইজ মালামাল সরবরাহ করে। হিসাবের কোড নং ৩-২৭৪০-০০৬০-৪৮৬৮ এর বিপরীতে ছয়টি বৈধ বিলের সঙ্গে ১৩টি ভুয়া বিল এবং হিসাবের কোড নং ৩-২৭৪০-০০৬০-৪৮৯৯ এর বিপরীতে আটটি বৈধ বিলের সঙ্গে তিনটি ভুয়া বিল দাখিল করা হয়।
বিলগুলো পর্যালোচনা ও তদন্ত করে বিষয়টি নিশ্চিত হয় দুদক। বিলগুলো তৈরি করেছেন ছুটিতে থাকা হাসপাতালের হিসাবরক আব্দুল কুদ্দুস আটিয়া। বিলগুলো পাস করেছেন সাবেক উপপরিচালক ডা. মো. আব্দুস সালাম। বিলগুলো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স এমএস এন্টারপ্রাইজের মালিক এমএস হোসেন বিভাগীয় হিসাবরণ অফিসে দাখিল করেছেন। বিভাগীয় হিসাব নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে বিলগুলো পাস হওয়ার পর এসব টাকা তিনজন মিলে আত্মসাৎ করেছেন।

মামলার এজাহারে আরও উল্লেখ করা হয়, শুধু টাকা আত্মসাৎ করেই থেমে থাকেননি অভিযুক্তরা। ১৬টি বিল ও বিল পাস করার নোটিশটিও গায়েব করে দিয়েছেন তারা। এ ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। এদের মধ্যে সাবেক উপপরিচালক ডা. আব্দুস সালাম ও হিসাবরক আব্দুল কুদ্দুছ আটিয়া সরকারি চাকরি থেকে ইতোমধ্যে অবসর নিয়েছেন। পাশাপাশি আব্দুস সালাম ওই মামলায় জেলহাজতে রয়েছেন।

Development by: webnewsdesign.com