ছয় বছর আগে রাজধানীর রামপুরায় মহানগর আবাসিক এলাকার নিজ বাসায় খুন হন আইনজীবী ফাহমিদা আক্তার মিথুন। ঘটনাস্থলে তার হাত-পা বাঁধা লাশ পড়ে থাকে। খুনের ঘটনার সত্যতা স্বীকারও করেছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। কিন্তু সাক্ষী না পাওয়া এবং খুনিদের শনাক্ত করা যায়নি বলে আদালতকে জানিয়েছেন তিনি।
রাজধানীর এমন অন্তত ১১টি চাঞ্চল্যকর খুনের কোনো ক্লু বের করতে পারেননি তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা। এর মধ্যে পাঁচটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে দিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তদন্তও শেষ হয় না, রহস্যও উদ্ঘাটন হয় না চাঞ্চল্যর অনেক খুনে। গত পাঁচ বছরে সারা দেশে ১ হাজার ২৯৮টি খুনের কোনো রহস্য উদ্ঘাটন করতে না পেরে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে সংস্থাটি। তবে এর মধ্যে ঢাকা জেলার চাঞ্চল্যকর ক্লুলেস মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন গত পাঁচ বছরের হিসাবে দেখা গেছে ৬৮টি।
দীর্ঘ তদন্ত শেষে আইনজীবী ফাহমিদা আক্তার মিথুন হত্যার কোনো কূলকিনারা না পাওয়া প্রসঙ্গে তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার কানিজ ফাতেমা এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘মিথুনের খুনিদের খুঁজে না পেয়ে গত বছর ২৬ এপ্রিল মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। মামলাটি তদন্ত করেছিলেন পুলিশ পরিদর্শক নুরুন্নবী। তবে খুনিদের চিহ্নিত করতে আমরা সব দিক থেকে চেষ্টা করেছি।’
এদিকে বিশিষ্ট সুরকার ও গীতিকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী হওয়ার পর তার ছোট ভাই মিরাজ আহমেদ খুন হন ২০১৩ সালের ৯ মার্চ। রাজধানীর খিলক্ষেত কুড়িল বিশ্বরোডের রেললাইনের পাশ থেকে মিরাজ আহমেদের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এরপর খুনের রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য গোয়েন্দা পুলিশকে (ডিবি) তদন্তভার দেওয়া হয়। তারপর সিআইডির কাছে ন্যস্ত করা হয় তদন্তভার। তদন্তে কোনো অগ্রগতি না পেয়ে ২০১৫ সালের ৩১ আগস্ট আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন সিআইডির পরিদর্শক রেজাউল করিম। সে সময় তিনি বলেন, ‘আমরা কোনো কিছু পাইনি তাই চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছি। যদি পরবর্তী সময়ে কোনো ক্লু বের হয় তাহলে পুনরায় তদন্ত শুরু করা হবে।’
২০১৫ সালের ১৩ মে পল্লবীতে নিজের ফ্ল্যাটে খুন হন গৃহবধূ সুইটি আক্তার ও তার মামা আমিনুল ইসলাম। প্রথমে মামলাটি তদন্ত করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এর তিন বছর পর তদন্তভার দেওয়া হয় সিআইডিকে। গত বছর ১ জানুয়ারি খুনিদের খুঁজে না পেয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় সংস্থাটি।
এর তদন্ত কর্মকর্তা তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার (বর্তমানে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার) রতন কৃষ্ণ নাথ এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘শুরুতেই ওই মামলার আলামত ঠিকভাবে পাওয়া যায়নি। থানা পুলিশ ও ডিবি তদন্তের সময় আলামত সুষ্ঠুভাবে সংগ্রহ করলে খুনিদের পাওয়া যেত। আমরা যখন মামলাটি পেয়েছি তখন কোনো কিছু না পেয়ে অন্ধকারে অনুসন্ধান করেছি।’
২০১৬ সালের ৯ নভেম্বর মগবাজারের মধুবাগে বাসার ভিতর থেকে ডলি রানী বণিক নামের এক গৃহবধূর লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় ১৬ নভেম্বর রমনা থানায় একটি হত্যা মামলা হয়। মামলা নম্বর ৩০। মামলাটি তদন্ত করছে সিআইডি। সংস্থাটি এখনো রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি।
২০১২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর হাজারীবাগের বাসায় ১২ বছরের স্কুলছাত্রী তাসনিম রহমান করবীকে শ্বাসরোধে ও গলা কেটে হত্যা করা হয়। দীর্ঘ সময় তদন্ত শেষে কোনো কূলকিনারা না পেয়ে গত বছর ২৫ এপ্রিল আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পুলিশ পরিদর্শক ময়নুল ইসলাম।
এ ঘটনায় হতাশার কথা জানিয়ে করবীর মা আফরোজা ফারহানা আহম্মেদ বলেন, “দীর্ঘ সময় অনেক তদন্ত কর্মকর্তা তদন্ত করে কিছুই করতে পারেননি। এখন আর কোনো সংস্থার ওপর আমার কোনো আস্থা নেই। তবে আমি বিশ্বাস করি, কোনো না কোনোভাবে আমার মেয়ের খুনিরা চিহ্নিত হবে। যদি তদন্ত কর্মকর্তারা সঠিকভাবে আলামত সংগ্রহ ও ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা নিয়ে আপডেট থাকতেন, তাহলে তারা খুনিদের খুঁজে বের করতে পারতেন। চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার আগে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ‘আপা, আমরা অনেক চেষ্টা করে কোনো কিছু পাইনি। মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার চাপ আছে। পরে কোনো ক্লু পেলে আবারও তদন্ত শুরু করা হবে।’ এসব শুনে আমরা আর নারাজি দিইনি।”
সিআইডি সূত্রে পাওয়া সংস্থাটির এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর সারা দেশে ৬ হাজার ১২৪টি মামলার তদন্ত করে সিআইডি। এর মধ্যে ৩ হাজার ১৯৯টির অভিযোগপত্র দিয়েছে। আর রহস্য উদ্ঘাটন করতে না পেরে ১ হাজার ২৯৮টির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। এ সময়ে সিআইডির ঢাকা জেলা ৬৮টি ক্লুলেস মামলার রহস্য না পেয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে। এখনো তাদের হাতে অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার-সংক্রান্ত ১৯টি মামলা তদন্তাধীন। তবে সিআইডির ঢাকা মেট্রোর পরিসংখ্যানটি পৃথকভাবে পাওয়া যায়নি।
২০১৪ সালের ২৭ আগস্ট পূর্ব রাজাবাজারে নিজ বাসায় খুন হন টেলিভিশনে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের উপস্থাপক মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী। মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়েছে অন্তত পাঁচবার। এখনো কোনো রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি সিআইডি। বর্তমানে মামলাটি তদন্ত করছেন সংস্থাটির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার জিসানুল হক।
২০১৩ সালের ২১ ডিসেম্বর রাজধানীর গোপীবাগের বাসায় লুৎফর রহমান ফারুকসহ ছয়জনকে গলা কেটে খুন করা হয়। এ ঘটনায় ওয়ারী থানায় একটি মামলা হয়। মামলা নম্বর ১৪। সেই ঘটনায় করা মামলার তদন্ত প্রায় আট বছরেও শেষ হয়নি। কবে তদন্ত শেষ হবে তা বলতে পারছেন না তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, এ মামলায় এ পর্যন্ত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ১০৯ বার সময় নিয়েছে বিভিন্ন তদন্ত সংস্থা। বর্তমানে মামলাটি ডিবি পুলিশের পরিদর্শক সোহরাব হোসেন তদন্ত করছেন। তিনি জানান, এখনো ওই ঘটনায় কোনো কিছু করতে পারেননি তারা। এখনো মামলাটি তারা রেখে দিয়েছেন কোনো ধরনের ক্লু পাওয়ার আশায়।
এসব বিষয়ে কথা হয় পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘খুনের মামলায় কোনো লিমিটেশন নাই। তবে মামলাগুলোর চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার কারণ তদন্ত কর্মকর্তারাই বলতে পারবেন। অনেক সময় হয় যে, ঘটনা সত্য, কিন্তু সাক্ষী-প্রমাণ নাই। এটি তদন্ত কর্মকর্তারা চূড়ান্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করতে পারেন। তবে পরবর্তী সময়ে আবারও এসব তদন্ত পুনরুজ্জীবিত করা যায়।’
আরও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৮ সালের ২০ নভেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যশোর-৬ (কেশবপুর) আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী আবু বকর আবুর লাশ পাওয়া যায় রাজধানীর বুড়িগঙ্গা নদীতে। ২২ নভেম্বর রাতে কেরানীগঞ্জ থানার ফেসবুক পেজে লাশটি দেখে আবু বকর আবুর লাশ শনাক্ত করেন তার ভাতিজা হুমায়ুন কবির। মামলাটির এখনো কোনো ক্লু বের করতে পারেনি তদন্ত সংস্থা। এর রহস্য উদ্ঘাটনে কাজ করছে পিবিআইর ঢাকা জেলা ও যশোর জেলা। গত বছর ১৪ মার্চ আশুলিয়ার নবীনগরে বাসের বাক্সে ট্রলি ব্যাগের ভিতর থেকে অজ্ঞাত এক নারীর (৩০) লাশ উদ্ধার করা হয়। ২০১৯ সালের ৪ ডিসেম্বর আশুলিয়ার রাঙ্গামাটিয়া ব্রিজের নিচ থেকে উদ্ধার হয় ২৬ বছর বয়সী এক নারীর লাশ। একই বছর ৪ আগস্ট সাভার ডেইরি ফার্মের পাশের খাল থেকে এক যুবকের লাশ উদ্ধার হয়। এসব ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে তদন্ত করছেন পিবিআইর ঢাকা জেলার কর্মকর্তারা।
Development by: webnewsdesign.com