জকিগঞ্জ ইউপি নির্বাচন নিয়ে টাকার নেশায় মেতে উঠেছিলেন নির্বাচন কর্মকর্তা সাকিব

সোমবার, ১০ জানুয়ারি ২০২২ | ১২:১১ অপরাহ্ণ

জকিগঞ্জ ইউপি নির্বাচন নিয়ে টাকার নেশায় মেতে উঠেছিলেন নির্বাচন কর্মকর্তা সাকিব
apps

ইউপি নির্বাচনে টাকার নেশায় মেতে উঠেছিলেন সিলেটের জকিগঞ্জের নির্বাচন কর্মকর্তা শাদমান সাকিব। নির্বাচনে প্রতীক বরাদ্দ, সিল মারা ব্যালট বিক্রি, কেন্দ্রে পৌঁছানো সহ নানা ঘটনা তিনি টাকার বিনিময়েই ঘটিয়েছেন। এ জন্য শাদমান সাকিবকে নিয়েই জকিগঞ্জে গত পাঁচদিন ধরে সব জল্পনা। তার ব্যক্তিগত জীবন রহস্যঘেরা। আছে ইয়াবা, ফেনসিডিল সেবনের অভিযোগও। এ কারণে ৫ই জানুয়ারি গ্রেপ্তারের সময় তার গাড়ি থেকে ফেনসিডিলের বোতল ও ইয়াবা সেবনের সরঞ্জাম পাওয়া গিয়েছিল। উপজেলা নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা জানিয়েছেন; সাদমান সাকিব দুই বছর থেকে নির্বাচন কর্মকর্তা হিসেবে জকিগঞ্জে কর্মরত ছিলেন। এই সময়ে তিনি নানা ঘটনার জন্ম দিয়েছেন।

এসব ঘটনায় নানা সময় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উপস্থাপন করা হলেও কৌশলে তিনি এসব অভিযোগের সমাধানও করে নেন। ফলে তাকে নিয়ে তেমন আলোচনা হয়নি। এবারের ইউপি নির্বাচনে তিনি টাকার নেশায় মেতে উঠায় শেষ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হতে হয়েছে। জকিগঞ্জের কয়েকটি ইউনিয়নের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা জানিয়েছেন, সাদমান সাকিব ইউপি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে টাকা আয়ের ধান্ধা শুরু করেন। তার তরফ থেকেই একাধিক প্রার্থীকে নির্বাচনে জয়ী করে দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়। অনেকেই তার এই প্রস্তাবে সাড়া দেননি। তবে প্রতীক বরাদ্দের সময় তিনি পছন্দের প্রতীক পাইয়ে দিতে প্রার্থীদের কাছ থেকে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা করে নেন। এরপর নির্বাচন আচরণবিধি ভঙ্গ করা নিয়ে প্রার্থীদের নানা ভাবে উত্ত্যক্ত করেন। ভয় দেখিয়েও লুটে নেন টাকা। আর নির্বাচনের আগে পছন্দের প্রিজাইডিং অফিসার ও সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার নিয়োগ দিয়ে নির্বাচনের ফলাফলকে প্রভাবিত করেছেন। তারা জানিয়েছেন, প্রকাশ্য টাকার নেশায় মেতে উঠায় গোয়েন্দা নজরদারিতে ছিলেন সাদমান সাকিব। আর ভোটের দিন গোয়েন্দা জালেই তিনি বন্দি হন। পরবর্তীতে নির্বাচনের দিন রাতে যখন প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাকে জেরা করেন; তখন সাদমান সাবিক সব স্বীকারও করেন। এ সময় তিনি নিজেকে বাঁচাতে ঊর্ধ্বতনদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেও তার কথায় কর্ণপাত করেননি কেউ। বরং আইনের পথেই হাঁটেন সবাই। উপজেলা প্রশাসনের কর্মচারীরা জানিয়েছেন, নির্বাচন কর্মকর্তা সাদমান সাকিবের সঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আরিফুল হককে নিয়ে আফসোসের অন্ত নেই। কারণ নির্বাচন কর্মকর্তার প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে আরিফুল হক সিলমারা ব্যালট কেন্দ্রে পৌঁছাতে রাজি হয়েছিলেন। এরপর হাতেনাতে ধরা পড়েন তারা। গ্রেপ্তারের পর থানা হাজতেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়া কৃষি কর্মকর্তা আরিফুল হক এখনো সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। ঘটনার দিন নির্বাচন কর্মকর্তা সাদমান সাকিব ও কৃষি কর্মকর্তা আরিফুল হক মাদক সহ গ্রেপ্তার হলেও তাদের বিরুদ্ধে মামলার এজাহারে মাদকদ্রব্য আইনে কোনো অভিযোগ উপস্থাপন করা হয়নি। এ নিয়ে ক্ষোভ বিরাজ করছে জকিগঞ্জে। তবে পুলিশ জানিয়েছে; উদ্ধারকৃত সব মালামালই জব্দ করা হয়েছে। তদন্তে এসব বিষয় তুলে ধরে অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে। এদিকে ইউপি নির্বাচন নিয়ে সাদমান সাকিবের বেপরোয়া বাণিজ্যের বিষয়টি প্রকাশ হওয়ার পর জকিগঞ্জে ক্ষোভ বিরাজ করছে। ইতিমধ্যে ‘বিতর্কিত’ নির্বাচন বাতিলের দাবিতে স্থানীয় বারহাল ইউনিয়নে শনিবার মানববন্ধন হয়েছে। আর শনিবার রাত ৯টায় সিলেটে সংবাদ সম্মেলন করেছেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা। ওই সংবাদ সম্মেলনে তারা জকিগঞ্জের ৯টি ইউনিয়নে পুনঃনির্বাচন দাবি করেছেন তারা। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন মানিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী বর্তমান চেয়ারম্যান মো. মাহতাব হোসেন চৌধুরী। তিনি সকল প্রার্থীর পক্ষে লিখিত বক্তব্যে বলেন, ‘৯টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে থানা নির্বাচন অফিসার ছিলেন সাদমান সাকিব। একই সঙ্গে তিনি জকিগঞ্জ সদর, সুলতানপুর ও বারঠাকুরী ইউনিয়নের রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্বেও ছিলেন। জকিগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিসার মো. আরিফুল হক বারহাল ও কাজলসার ইউনিয়ন পরিষদের রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্বে ছিলেন। সাদমান সাকিব ও আরিফুল হকের অধীনে ও তত্ত্বাবধানে বারহাল, কাজলসার, জকিগঞ্জ সদর, সুলতানপুর ও বারঠাকুরী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রকাশ্যে জালিয়াতি করা হয়েছে। সরকারি গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে সাদমান সাকিব ও আরিফুল হক মানুষের রায় নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছেন। তারা মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে নিজেদের নির্ধারিত প্রার্থীদের বিজয়ী করতে কাজ করেছেন। তারা নিজেরা খাবারের প্যাকেটের নাম করে কেন্দ্রে কেন্দ্রে নিজেদের চুক্তিকৃত প্রার্থীর বিজয় সুনিশ্চিত করতে সিলমারা ব্যালট সরবরাহ করেছেন। তাদের এই অনৈতিককাজে সহযোগিতা করেছেন প্রায় প্রতিটি কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার ও সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের দায়িত্বশীলরা। এর মাধ্যমে জনরায়কে গলাটিপে হত্যা করা হয়েছে। জালিয়াতি করে জনগণের মনোনীত প্রার্থীকে হারিয়ে দেয়া হয়েছে। তাই আমরা অবিলম্বে জকিগঞ্জ উপজেলার ৯টি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান ও মেম্বার পদে পুনরায় নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছি। বাংলাদেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক অধ্যায় রচনাকারী নির্বাচনী কর্মকর্তা সাদমান সাকিব ও আরিফুলকে সরকারি চাকরি থেকে অব্যাহতি প্রদান করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।’ লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ‘নির্বাচনের দিন নির্বাচনী অফিস থেকে উক্ত দুই কর্মকর্তা ব্যালটে নৌকা মার্কায় ও তাদের পছন্দের প্রার্থীর প্রতীকে সিল দিয়ে সাদমান সাকিব ও আরিফুল হক একটি কালো গাড়িযোগে ৫টি ইউনিয়ন পরিষদের প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে অফিসার হিসেবে যাতায়াত করেন। তারা নিজেদের সঙ্গে সিলমারা ব্যালটগুলো প্রিজাইডিং অফিসারের সাহায্যে ব্যালট বাক্সে ঢুকান। তারা বেলা তিনটা পর্যন্ত উক্ত ৫টি ইউনিয়ন পরিষদে রক্ষকের বেশে ভক্ষক হয়ে অবৈধভাবে সিলমারা ব্যালট ঢুকিয়ে জনগণের রায়কে পাল্টে দিয়েছেন। লিখিত বক্তব্যে প্রার্থীদের অনেকেই কান্নাজড়িত কণ্ঠে দাবি করেন, এমন ঘটনা নজিরবিহীন। সরকারি কর্মকর্তারা কয়েকজন প্রভাবশালী প্রার্থীর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে নিজেদের নির্ধারিত প্রার্থীকে বিজয়ী করার জন্য কাজ করেছেন। সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জকিগঞ্জ সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী মো. হাসান আহমদ, বারঠাকুরী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী মো. নাছির উদ্দিন নছির, মানিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী মো. জাহাঙ্গীর শাহ চৌধুরী হেলাল, কসকনপুর ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান ও চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী মো. আব্দুর রাজ্জাক রিয়াজ প্রমুখ। এ ছাড়া বেশ কয়েকজন মেম্বার প্রার্থীও উপস্থিত ছিলেন।

Development by: webnewsdesign.com