আল-আমিন
আমি খুব কাছ থেকে হেমন্ত দেখেছি। আমি দেখেছি আমাদের বাড়ির দনি পাশে সারি সারি খেজুর গাছ থেকে নানু মিয়ার নিখুঁত হাতে খেজুর রস সংগ্রহ করার দৃশ্য। এই হেমন্তের ভোরে বাড়ির পূর্বদিক থেকে গাছের সবুজ পাতা আর বাশঁঝাড় ভেদ করে আসা সূর্যের আলোর রস্মি উঠোনে পড়ার দৃশ্য এখনো ভুলবার নয়। বাড়ির পশ্চিম দিকে পুকুরপাড় দিয়ে একটু পথ এগুলেই চোখে পড়ে বিশাল হাওরে সোনার ধানের সাম্রাজ্য। এসময় এই মাঠ থেকে ঘরে তোলে নেওয়া হয় নতুন ফসল। সমস্ত মাঠের সোনার ধানের আভা বিকেলের পশ্চিম আকাশকে রাঙিয়ে দেয় সোনালী রঙে। মানুষের মনে জায়গা করে নেয় আনন্দ। এই নির্মল আনন্দে সৃষ্টির উল্লাসে মিশে যায় কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী সব বয়সী মানুষের মন। পুরো হেমন্তজুড়েই দেখি সুন্দর ও সবুজ কাঁচা ধানগাছে সতেজ থাকা আমন ধানের তে। মাটির উপর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা সারা মাঠ সবুজ গাছ আর সোনালী রঙে রাঙানো পুরো ফসলি মাঠ। এই মাঠে ধানের ওপর বাতাস ঢেউ খেলে যায় মাঠের এ প্রান্ত থেকে ঐ প্রান্তে। এই ঢেউ খেলা অজানা নিরুদ্দেশ যাওয়ার সুন্দর ও ভালোলাগার। এই দৃশ্য হৃদয়ে ঝড়তুলে, মুগ্ধতা ছড়ায় অসীম ভালোবাসায়। এই হেমন্তের বিকেলের সূর্য কিরণের মিষ্টতা অপরূপ সৌন্দর্যের দৃশ্য বাড়িয়ে দেয় পুরো দেশজুড়ে। পাকাধানগুলো পুরো মাঠজুড়ে সোনালী সূর্যের মতো চিকচিক করে কৃষকের ভালোবাসায় আহাদী হওয়ার অপোয় প্রহন গুনে। হেমন্তের স্নিগ্ধ করা ভালোলাগার দৃশ্য ভোরের ধানগাছের ডগায় শিশির জমে থাকার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয় হেমন্তের মায়াবী রূপের ঝলকে সৌন্দর্যেরই পূর্বাভাস নিয়ে। দিন শুরুর প্রথম রোদের আলোয়ে গাছের পাতাগুলো হেসে ওঠে প্রকৃতির মায়ায়। চোখ যত দূর যায়, চোখে পড়ে আলোকোজ্জ্বল এক অপূর্ব একটি সকালের অভাবনীয় সৌন্দর্যে। শিশিরস্নাত সকাল, কাঁচাসোনার মতো রোদমাখা স্নিগ্ধসৌম্য দুপুর, পাখির কলকাকলি ভরা সন্ধ্যা আর মেঘমুক্ত আকাশে জ্যোৎস্না ডুবানো আলোকিত রাত হেমন্তকে আরও রহস্যময় করে তোলে সবার চোখে এবং প্রকৃতিতে এনে দেয় ভিন্নমাত্রা।
হেমন্তের এই মৌনতাকে ছাঁপিয়ে বাংলাদেশের মানুষের জীবনে নবান্ন প্রবেশ করে জাগরণের গান হয়ে। মানুষের জীবনে এনে দেয় উৎসবের ছোঁয়া।
ধানের মৌ মৌ গন্ধ, মাঠে মাঠে ধান কাটার ব্যস্ততা। বাড়ির উঠোনে ধান আর বাড়ির আঙিনায় থাকা মাচাঁয় লাউ কুমড়াগাছের সবুজ পাতাগুলো লক লক করে বেড়ে ওঠার সৌন্দর্য হেমন্তের মিষ্টি রোদে আরো মায়াময় করে তুলে। সন্ধ্যা হওয়ার আগেই সকালে বের হওয়া পাখিরা নিজ নীড়ে ফিরতে শুরু করে দল বেঁধে। তাদের কিচিরমিচির ধ্বনির সঙ্গে যোগ হয় বাঁশঝাড় থেকে আসা এক ধরনের শিরশির শব্দ। তৈরি হয় অন্যরকম এক সুরের আবেশ। রাতের আকাশে দেখা মেলে অসংখ্য তারার মেলা। আকাশের কোথাও বিন্দু জমাট বাঁধা মেঘের উকিঁ দেখা যায় না। মিটিমিটি তারা জ্বলে সারা রাত। সেই সঙ্গে চাঁদের শরীর থেকেও জ্যোৎস্না ঝরে পৃথিবীজুড়ে। এই রাতে ঝিরিঝিরি বাতাস আর মৃদু আলোর ঝলকানিতে তৈরি হয় মায়াময় এক ভালোবাসার রজনী। প্রকৃতির পরতে পরতে বিচিত্র রঙ মিশে যায় ভালোবাসার মানুষের মনের গহিনে। প্রকৃতি এই বহু বিচিত্র রূপ-রস-গন্ধ আমাদেরকে মুগ্ধ করে, বিস্মিত করে। এই রূপবিলাসিতায় বাংলার এই ঋতু প্রকৃতির সাথে আমাদেরকে ভাবনায় নিমজ্জিত করে। এঋতুতেই প্রকৃতি ও মানুষের রূপবদল বড় অপূর্ব করে তুলে। মাঠজুড়ে সবুজ পাতার মাঝে হলুদ আর সোনালী রঙের ধান। দলে দলে মানুষজন এসব ধান কাটে আঁটি বাঁধে আর এসব ধানের আঁটি কেউ মাথায় আবার কেউ কাঁধে ঝুলিয়ে করে বাড়ি ফেরে। হেমন্তের ভোরে কুয়াশা পড়া মাঠে বিন্দু বিন্দু শিশির জমে থাকা ধানগাছের পাতার ওপর ওড়াউড়ি করে সবুজ রঙের ফড়িং। এই সোনালি ধানের তে ডিঙিয়ে পূর্ব দিগন্ত রাঙিয়ে উঠে ভোরের সূর্য। ভোরের ভিতর হালকা শীতের মাঝে মিষ্টি রোদ অন্যরকম ভালোলাগার অনুভূতি দেয়।
হেমন্তেই অনেক শীতের সবজি উঠতে শুরু করে। লালশাক, মুলাশাক, বাঁধাকপি, ফুলকপিসহ নানা ধরনের শাকসবজি এই হেমন্তেকে ঘিরেই মাঠে ফলে। একদিকে কৃষক ধান কেটে গোলায় তোলে, আবার অন্যদিকে রবি ফসল ফলানোর ব্যস্ততায় বয়ে যায় কৃষক-কৃষাণীর জীবনে অনাবিল পার্বণের আনন্দে। সবুজ ধানতেগুলো ধীরে ধীরে সোনারঙে বদলে যাওয়া আর অতিথি পাখিদের আগমন গ্রামে গ্রামে খেজুর রস আর নতুন ধানের পিঠার ঘ্রাণ বাংলার মানুষের জীবনকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছে। স্নিগ্ধ, মায়াময় প্রকৃতির মধ্যে মানুষের জীবনকে এই প্রকৃতির মাঝেই খুঁজে এবং খুঁজে পায়। এই ঋতুতে মানুষের আসে প্রেম, আকঙ্া, অভিলাষ এবং মানুষের মনের মধ্যে জাগিয়ে তোলে ভাব, প্রকৃতিপ্রেম, বাঙালিয়ানা আর সৃজনশীল চিন্তাভাবনা। এ ঋতু বাংলার কৃষকদেরকে যেভাবে কর্মচাঞ্চল্য ফিরিয়ে দেয় তেমনি কবিদের দেয় অফুরন্ত কল্পনা শক্তি। বাংলা কবিতা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় হেমন্ত ঋতুর সাহিত্যে ধান কাটা, নবান্ন, শালিক, ঘুঘু, দূর্বা ঘাসে শিশিরবিন্দু প্রভৃতি চিত্র ওঠে এসেছে প্রকৃতির রূপ বৈচিত্র্যের ভেতর। সৃষ্টিশীল মানুষরাও নিভৃতে চর্চা করে শিল্পের চর্চা। নিঃশব্দে কবির মনের ভাবনা এবং কবিতা। গল্প, উপন্যাস, চিত্রকলা, চলচ্চিত্র, নাটক, যাত্রাপালা, পুতুলনাচ, জারি-সারি, বাউল গান, সবকিছুতেই হেমন্ত এনে দেয় নতুন মাত্রা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দীন, জীবনানন্দ দাশসহ অনেক কবিই লিখেছেন এই হেমন্ত নিয়ে। একই সঙ্গে এই ঋতু মানবমনেও প্রভাব ফেলে। মানুষকে ভাবিয়ে তুলে শিল্পী ও সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে। হেমন্তের আগমনীর প্রকৃতি ও স্বভাবের এক চঞ্চল রূপ এঁকেছেন কাজী নজরুল ইসলাম “অঘ্রাণের সওগাত” কবিতায়। কাজী নজরুল ইসলাম এই কবিতায় কেবল হেমন্তের প্রকৃতির ছবিই আঁকেননি, একই সঙ্গে পারিবারিক সংস্কৃতির চিত্রও তুলে ধরেছেন। কাজী নজরুল ইসলাম হেমন্তের দিনের চেয়ে রাতের সৌন্দর্যে বেশি মোহিত ছিলেন। কবি চাঁদকে দেখেছেন প্রকৃতির আলোর উৎস হিসেবে অপার সৌন্দর্য উপভোগের আশায়। কবি সুফিয়া কামাল হেমন্ত কবিতায় বলেছেন, “সবুজ পাতার খামের ভেতর, হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে। কোন পাথারের ওপার থেকে, আনল ডেকে হেমন্তকে?” কেননা, বাংলাদেশ চিরসবুজের দেশ। আদিগন্ত সবুজের হাতছানি এদেশে। মাঠ থেকে পাহাড় তে থেকে প্রান্তর। বাড়ির ওঠোন থেকে বাগান সর্বত্র সবুজের সমারোহ। অথচ এই সবুজের ভেতরই যেন হঠাৎ করেই হলুদবরণ এক ঋতু হেমন্ত এসে পড়েছে। এই হলুদ মানুষের জীবনে অনন্য প্রাপ্তি মানুষের বেঁচে থাকার অবলম্বন সোনারঙ ধান।চিরসবুজের দেশে এই ঋতু সোনা আভা ছড়িয়ে দেয়। বদলে দেয় প্রকৃতির রূপ।
কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতায় হেমন্ত, প্রকৃতি আর আত্মমগ্ন একে অন্যের পরিপূরক হয়ে উঠে। যেন সোনার ধানের গন্ধ, সবুজ শস্য আর লাবণ্যময়ী ঋতু হেমন্ত। কবি জীবনানন্দের কাব্যে যখন প্রকৃতির জন্ম ঘটেছে, তখন হেমন্ত ছয় ঋতুর একটি ঋতুর উপকরণ হয়ে এসেছে। কারণ হেমন্ত শস্যের, তৃপ্তির, প্রকৃতির ঋতু। আর এই শস্যভরা ঋতুকে সবচেয়ে বেশি মহিমান্বিত করেছেন কবি জীবনানন্দ দাশ। কবি হেমন্তকে দেখেছেন প্রেমে, দেহে, সৃষ্টিতে, তৃপ্তিতে, বিরহে, মুগ্ধতায়। তিনি তাঁর একটি কবিতায় লিখেছেন, “এদেহ অলস মেয়ে, পুরুষের সোহাগে অবশ, চুমে লয় রৌদ্রের রস। হেমন্ত বৈকালে, উড়ো পাখপাখালির পালে, উঠানের পেতে থাকে কান, শোনে ঝরা শিশিরের ঘ্রাণ, অঘ্রাণের মাঝরাতে।” হেমন্ত রাতের নৈঃশব্দ্য স্পষ্ট করার জন্য কবি ঘ্রাণ শক্তির সঙ্গে শ্রবণ শক্তির মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। হেমন্তের ছবি আঁকতে গিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম যেমন চাঁদকে উপজীব্য করেছেন, তেমনি জীবনানন্দও চাঁদের রূপের বর্ণনা দিয়েছেন মানুষের সৌন্দর্যবোধের সঙ্গে মিল রেখে। উপমা ও চিত্রকল্পে কাজী নজরুল ইসলাম জীবন্ত প্রাণচঞ্চল করে আর জীবনানন্দ হৃদয়ের, বাস্তব মাঠের চিত্র তুলে ধরেছেন বাংলা সাহিত্যে। আল মাহমুদের কবিতায় হেমন্ত এসেছে মানুষের প্রেমে ও প্রকৃতির সৌন্দর্যে। তাঁর কাছে হেমন্ত এক ধরনের পরিপূর্ণতার নাম। তাঁর “আঘ্রাণ” কবিতায় লিখেছেন, “আজ এই হেমন্তের জলদ বাতাসে, আমার হৃদয় মন মানুষের গন্ধে ভরে গেছে রমণীর প্রেম আর লবণসৌরভে।” হেমন্তের এই কোমল হাওয়ায় কবি মনে এক ধরনের ভালোবাসার অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছে। যে অনুভূতি আমাদেরকে নিয়ে যায় মাটির মানুষের দেহের ঘ্রাণের কাছে। আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় সৃষ্টি, ফসল ও তৃপ্তির সার্থকতার কথা। যেখানে ভালো মন্দের স্মৃতি হাত ধরাধরি করে চলে। মনে পড়ে কৈশোরের প্রেম, প্রাকৃতিক দৃশ্যরাজির আদিগন্ত শোভা।
প্রকৃতির সাথে মানুষের অস্তিত্বের সম্পর্ক নিবিড়ভাবে মিশে আছে। প্রকৃতি ছাড়া মানুষ কল্পনা করতে পারে না। প্রকৃতির ওপর এক বিশ্বস্ত অভিধানের গল্প যুগ যুগ ধরেই চলছে। কবিতার মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে উঠে এসেছে এসব প্রকৃতির প্রেম, বিরহ, বিদ্রোহ ও চিত্রকল্প। তাই জীবনানন্দ দাশ আবার আসিব ফিরে কবিতায় লিখেছিলেন,”আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে, এই বাংলায় হয়তো মানুষ নয়, হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে। হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে। কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব কাঁঠাল ছায়ায়।” হেমন্তের মতো সৌন্দর্যরূপ এই ঋতু থাকায় বাংলা সাহিত্যও দিনদিন সমৃদ্ধি হয়েছে। কবিতা সেজে ওঠেছে নিজস্ব ঢঙে। কবিতার রূপ-রস-গন্ধ ছড়িয়েছে নবান্নে সৌরভের মতো। শিউলি, কামিনী, মল্লিকার সৌরভে সুরভিত হয়েছে চারদিক। অগ্রহায়ণে এই আমন ধানের শুভ্রতায় প্রাণ ফিরে পায় পুরোনো জীর্ণতা। কিষানীর উঠানের ধুলোর গন্ধ কবিতার শরীরের সাথে মিশে যায় নিপুণভাবে। ফসলি মাঠ আর শীতের হাওয়া দোল দেয় গ্রামের প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার কবিতায় এভাবেই লিখেছেন-“আজি হেমন্তের শান্তি ব্যাপ্ত চরাচরে,জনশূন্য ত্রে মাঝে দীপ্ত দ্বিপ্রহরে। শব্দহীন গতিহীন স্তব্ধতা উদার, রয়েছে পড়িয়া শ্রান্ত দিগন্ত প্রসার স্বর্ণশ্যাম ডানা মেলি”।
Development by: webnewsdesign.com