মাটি সোনার চেয়েও খাঁটি। মাটির সামগ্রীতে মানুষের হাসি-কান্না, সুখ-দুখের অনুভূতি, প্রেম-বিরহের নানা দৃশ্যপট, মনোমুগ্ধকর ছবি হাতের স্পর্শে ফুটিয়ে তুলতেন শিল্পীরা। নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলা বিভিন্ন এলাকায় এখন পুঁজির অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে এখানকার মৃৎশিল্প। এই পেশায় এখন ভর করেছে অভাব-অনটন। মেলা-পার্বনেও তেমন চাহিদা নেই মাটির তৈজসপত্রের। তবে কিছু হোটেল-মিষ্টির দোকানে এবং সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পূজায় এখনও প্রয়োজন হয় মাটির সামগ্রীর। পহেলা বৈশাখে মাটির সরাইয়ে (সানকি) তে পান্তাভাত খাওয়ার রীতিও চালু আছে।
একটা সময় ছিল বাংলা নববর্ষকে ঘিরে নির্ঘুম ব্যস্ত সময় পার করতেন রূপগঞ্জের মৃৎশিল্পীরা। পহেলা বৈশাখ বাঙালির নববর্ষ। নববর্ষে উপজেলার বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে বসে বর্ষবরণ মেলা। সেই মেলায় চাহিদা থাকে নানা রকমের খেলনা, মাটির জিনিসপত্রের। মেলাকে দৃষ্টিনন্দন করতে মৃৎশিল্পীরা নিজের হাতে নিপুণ কারুকাজে মাটি দিয়ে তৈরি করতেন শিশুদের জন্য রকমারি পুতুল, ফুলদানি, রকমারি ফল, হাঁড়ি, কড়াই, ব্যাংক, বাসন, থালা, বাটি, হাতি, ঘোড়া, বাঘ, টিয়া, ময়না, ময়ূর, মোরগ, খরগোশ, হাঁস, কলস, ঘটি, মুড়িভাজার ঝাঞ্জুর, চুলা, ফুলের টবসহ মাটির বিভিন্ন তৈজসপত্র।
আধুনিক যুগেও কিছুসংখ্যক মানুষ এখনো মাটির তৈরি জিনিসপত্রের ব্যবহার ভুলে যাননি। কেননা মৃৎ শিল্পীরা তাদের পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া মাটির কাজ করে এখনো টিকে থাকার লড়াই করছেন। কিন্ত মাটির তৈরি পণ্যের ক্রেতা এবং সঠিক মূল্যায়ন না থাকায় ধীরে ধীরে মৃৎশিল্পীরা এ পেশা থেকে অন্য পেশায় ঝুকতে শুরু করেছে।
বাজারে চোখে পড়ে না মাটির তৈজসপত্র। তার স্থান দখলে নিয়েছে প্লাস্টিক ও সিরামিক সামগ্রী। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম-বাংলার এই ঐতিহ্য। মৃৎশিল্পীরা দিন-রাত পরিশ্রম করে নিপুণ হাতে তৈরি করেন মাটির জিনিসপত্র। গ্রামীণ মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় গৃহস্থালি জিনিসপত্রের চাহিদা মেটাতো এই মৃৎশিল্প। কদর কমে যাওয়ায় অনেকে ছেড়েছেন এই পেশা।
উপজেলার পালপাড়া এলাকায় মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িত রয়েছে প্রায় ৫০টি পরিবার। তারা বিভিন্ন উৎসবসহ মাটির জিনিসপত্র তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করে। বাংলা বর্ষবরণে উপজেলার বিভিন্ন স্থানের মেলায় মাটির অধিকাংশ সামগ্রী সরবরাহ করতেন এ মৃৎশিল্পীরা। তাই এখানে পুরুষ মৃৎশিল্পীর পাশাপাশি নারীরাও সমানতালে কাজ করতেন। তার মধ্যে উপজেলার গোলাকান্দাইল পালপাড়া গ্রামে বসবাসরত প্রায় ২০টি পাল পরিবারের অধিকাংশ নারী-পুরুষই এ কাজের সাথে জড়িত ছিলেন।
বৈশাখী মেলা উপলক্ষে নারী শিল্পীরা নিজের হাতে নিপুণ কারুকাজে মাটি দিয়ে তৈরি করতেন শিশুদের নানা খেলনা। পহেলা বৈশাখের কিছু দিন আগে শুরু করতেন খেলনাগুলোকে দৃষ্টিনন্দন করতে বিভিন্ন রঙ দিয়ে সাজানোর কাজ বলে জানান এখানকার শিল্পীরা।
সেসব এখন শুধুই স্মৃৃতি। হাটে বাজারে আর মেলায় এখন চোখে পড়ে না মাটির তৈজসপত্র। তার স্থান দখলে নিয়েছে প্লাস্টিক ও সিরামিকের সামগ্রী। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম-বাংলার এই ঐতিহ্য। মৃৎশিল্পীরা দিন-রাত পরিশ্রম করে নিপুণ হাতে তৈরি করেন মাটির জিনিসপত্র। গ্রামীণ মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় গৃহস্থালি জিনিসপত্রের চাহিদা মেটাতো এই মৃৎশিল্প। কদর কমে যাওয়ায় অনেকে ছেড়েছেন এই পেশা।
এখন যে যুগ আসছে মাটির পাতিলাটা ধৈর্য সহকারে ব্যবহার করবে সে ধৈর্য্য আর আমাদের ঘরওয়ালীদের নেই। আগে গৃহিণীরা ১৫ থেকে ২০ জন লোকের খাবার এই মাটির পাতিলায় রান্না করে খাওয়াত। মাটির পাতিলায় রান্না হলে স্বাস্থ্যসম্মত হতো। আড়াই কেজির চাল চড়ানোর পাতিল ৭০ থেকে ৮০ টাকায় পাওয়া গেলেও ভেঙে যাওয়ার ভয়ে কিনতে চায় না।
চিকিৎসকদের মতে মাটির প্লেট বা মাটির হাড়িতে যদি কেউ রান্না করে খায় তবে পেটের গ্যাসের সমস্যা পোহাতে হবে না। এখনও কিছু পরিবার এ মাটির জিনিসপত্র বানাচ্ছে। তবে এই শিল্পটা এখন প্রায় ধ্বংসের মুখে। কারিগরদের ছেলেপুলেরা এই মাটির কাজ ছেড়ে দিয়ে অনেকেই স্বর্ণের কাজ বেছে নিচ্ছে। বাড়ীর মহিলারা অন্য কোন কাজে যেতে না পারায় বাধ্য হয়ে এ মাটির কাজ করে দিন কাটাচ্ছে।
উপজেলার কয়েকটি পরিবার এখনও ধরে রেখেছেন পুরনো পেশা। উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় পালপাড়াগুলোতে এখনও দৃষ্টিনন্দন মাটির কলসি, হাঁড়ি, পাতিল, সরা, মটকা, দই পাতিল, মুচি ঘট, মুচি বাতি, মিষ্টির পাতিল, রসের হাঁড়ি, ফুলের টব, জলকান্দা, মাটির ব্যাংক, ঘটি, বাটি, জালের চাকা, প্রতিমা, বাসন-কোসন, ব্যবহারিক জিনিসপত্র ও খেলনা সামগ্রী ইত্যাদি প্রায় ৯০ ধরনের সামগ্রী তৈরি হয়।
কথা হয় মৃৎশিল্পের কারিগর রাজু মল্লিক এর সাথে তিনি বলেন, মাটি সংগ্রহের পর প্রথমে চাকে দেওয়া হয়। পরে কাঠের তৈরি মাস্তুল দিয়ে বিভিন্ন আকৃতি দেওয়া হয়। এরপর রোদে শুকাতে হয়। শেষে পোড়ানো হয় আগুনে। এভাবেই তৈরি হয় বিভিন্ন আকৃতির তৈজসপত্র। জানা যায়, একসময় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা এসে এখানকার কুমোর পাড়া থেকে মাটির তৈরি জিনিসপত্র কিনে নিয়ে যেতেন।
মৃৎশিল্প পণ্যের বিক্রেতারা জানান, বাপ-দাদারা ৮০ বছর পূর্ব থেকেই মৃৎশিল্পের সাথে জড়িত ছিলেন। এলাকায় শতাধিক পরিবার এ পেশায় জীবিকা নির্বাহ করতো। এখনও আমরা পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্য ধরে রেখেছি। মাটির তৈজসপত্র বানাতে প্রধান উপকরণ এঁটেল মাটি অনেক দূর থেকে সংগ্রহ করতে হয়। জানা গেছে, কুমার পাড়ার ৭-৮টি পরিবার এখনও মৃৎশিল্পের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত রেখেছেন। সরকার এই শিল্পের জন্য আলাদা ব্যাংক ঋণ, সরকারি-বেসরকারি অনুদানের ব্যবস্থা করলে মৃৎশিল্পকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব বলে মনে করেন স্থানীয়রা।
জানা যায়, একসময় রূপগঞ্জ উপজেলার মৃৎশিল্পের জন্য পরিচিত ছিল। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা এসে এখানকার কুমোর পাড়া থেকে মাটির তৈরি জিনিসপত্র কিনে নিয়ে যেতেন। মাটির সামগ্রীতে মানুষের হাসি-কান্না, সুখ-দুখের অনুভূতি, প্রেম-বিরহের নানা দৃশ্যপট, মনোমুগ্ধকর ছবি হাতের স্পর্শে ফুটিয়ে তুলতেন শিল্পীরা। কিন্তু এখন পুঁজির অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে এখানকার মৃৎশিল্প।
রুপগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ আইভী ফেরদৌস বলেন, প্লাষ্টিক বা মেলামাইনের কোন কনটেইনার (পাত্রে) কোন কিছু গরম করা হলে সেখানে এক ধরনের ক্যান্সারের উপাদান ওখান থেকে বের হয়। আর সেটার কারণে ক্যান্সার হতে পারে। প্লাষ্টিকের জিনিসপত্র ব্যবহারে ক্যান্সারের ঝুঁকি থাকে। সেক্ষেত্রে আমরা যদি মাটির জিনিসপত্র ব্যবহার করি বা আগের দিনে তারা ব্যবহার করত সেটার মধ্যে কোন ভয় নাই। মাটির জিনিস যদি ভালোভাবে তৈরি করে ব্যবহার করা হয় তবে সেটা স্বাস্থ্যসম্মত হবে।
Development by: webnewsdesign.com