রাজধানীর বস্তিগুলো মাদক আর অপরাধের আঁতুড়ঘর হিসেবে পরিচিত। দেশের বিভিন্ন স্থানে চুরি, ডাকাতি ও খুনের মতো অপরাধ করে অপরাধীদের অনেকেই বস্তিতে আত্মগোপন করছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে- এমন সব অপরাধের সঙ্গেই কোনো না কোনোভাবে বস্তির যোগসূত্র রয়েছে। বিশেষ করে ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়ে যাওয়া অতিষ্ঠ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ জন্য বস্তির উপর নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি নিয়মিত অভিযান চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যেই রাজধানীর বিভিন্ন বস্তিসহ আশপাশের এলাকায় বসানো হয়েছে কৃত্রিম গোয়েন্দা ক্যামেরা। তবে অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বস্তিবাসীদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হলে বস্তিকেন্দ্রিক অপরাধ অনেকাংশে কমে আসবে।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) প্রধান পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক বনজ কুমার মজুমদার বলেন, চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি ছাড়াও খুনের মতো অপরাধ করেও খুনি আত্মগোপন করতে বস্তিকে বেছে নিচ্ছে। কারণ বস্তিতে থাকা অপরাধীদের শনাক্ত করা তুলনামূলক অনেক কঠিন। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ২০১৯ সালের ১ নভেম্বর রাতে ধানমন্ডির একটি বাড়ির ফ্ল্যাটে গৃহকর্ত্রী আফরোজা বেগম (৬৫) ও গৃহকর্মী দিতিকে (১৮) ছুরিকাঘাতে হত্যার ঘটনা ঘটে। দুই বছর পর জোড়া খুনের ঘটনায় বাড়ির কেয়ারটেকার বাচ্চু মিয়া ও আগারগাঁও বস্তির বাসিন্দা সুরভী আক্তার নাহিদাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
উচ্চবিলাসী নাহিদা আর বাচ্চু মিলে দুই জনকে হত্যা করে বাসা থেকে স্বর্ণালঙ্কার ও টাকা লুটে নেয়। লুটে নেওয়া সেই স্বর্ণালঙ্কার ও টাকা রাখা হয় নাহিদার আগারগাঁও বস্তি ঘরের মাটির নিচে। পরে সেগুলো উদ্ধার করা হয়। বস্তির বাসিন্দাদের সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য না থাকায় এ ধরনের অপরাধ করে অনেক অপরাধীই বস্তিতে আত্মগোপন করে। তাদের গ্রেপ্তার করা তুলনামূলক অনেক কঠিন। ঢাকা মহানগর পুলিশের পরিসংখ্যান মতে, গত বছর রাজধানীতে ২৩টি ডাকাতি, প্রায় দেড়শ’ ছিনতাই বা দস্যুতা ও ৮৮টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া প্রায় সাড়ে ৬শ’ সিঁদেল চুরির ঘটনাও ঘটেছে। গাড়ি ও বৈদুতিক তারসহ অন্যান্য চুরির ঘটনা ঘটেছে প্রায় দেড় হাজার। আর মাদক উদ্ধার সংক্রান্ত মামলা হয়েছে সাড়ে ১৬ হাজার। সবমিলিয়ে প্রায় সাড়ে ২৭ হাজার মামলা হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত বছর ও চলতি বছর ছিনতাইয়ের ঘটনায় উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত রাজধানীর ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী, বারিধারা এলাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনা তুলনামূলক বেশি ঘটছে। এতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতিতে রয়েছে।
দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, করোনার কারণে চাকরিচু্তি ও মাদকসেবীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়া এর অন্যতম কারণ বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। এসব বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া বিভাগের উপকমিশনার মো. ফারুক হোসেন বলেন, ছিনতাই ঠেকাতে ঢাকা মহানগর পুলিশের সব ইউনিটকে বাড়তি সতর্কতার পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে মোটরসাইকেলে ছিনতাইয়ের ঘটনাগুলো বিপজ্জনক। কারণ আচমকা ছিনতাইকারীরা আরোহীর ব্যাগ ধরে টান দিয়ে নিয়ে যায়। এতে করে আরোহী পড়ে গিয়ে মারাত্মক দুর্ঘটনার শিকার হন। অতীতে এমন অনেক দুর্ঘটনা ঘটেছে।
উপকমিশনার মো. ফারুক হোসেন আরও বলেন, ছিনতাইকারীসহ অন্যান্য অপরাধীদের শনাক্ত করতে কৃত্রিম গোয়েন্দা ক্যামেরা (ইন্টেলিজেন্স সিসি ক্যামেরা) বসানো হচ্ছে। ইতোমধ্যেই ঢাকার অনেক এলাকায় এমন অনেক ক্যামেরা বসানো হয়েছে। তবে তিনি নিরাপত্তা ও ছিনতাইকারীদের গ্রেপ্তারের স্বার্থে কোন এলাকায় কি পরিমাণ ক্যামেরা বসানো হয়েছে, তা জানাননি। পুরো ঢাকা মনিটরিং করতে পর্যায়ক্রমে এক হাজার ইন্টেলিজেন্স সিসি ক্যামেরা বসানোর চেষ্টা চলছে। এসব ক্যামেরা কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেল থেকে মনিটর করার ব্যবস্থা থাকছে। তিনি আরও বলেন, আবার অনেক ছিনতাইকারী রাজধানীর অন্য এলাকা থেকে ছিনতাই করে ঢাকার দূরের কোনো বস্তিতে গিয়ে আত্মগোপন করছে। তাদের গ্রেপ্তার করার সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ বা অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ চলছে। আর বস্তি থেকে মাদক নির্মূলে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করতে বিশেষ নির্দেশ জারি করেছেন ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম।
এদিকে সরেজমিনে রাজধানীর মিরপুর মডেল থানাধীন কল্যাণপুর পোড়া বস্তিতে গিয়ে দেখা গেছে, অনেকটা প্রকাশ্যেই বিক্রি হচ্ছে গাঁজা, হেরোইন ও ইয়াবা। এ নিয়ে বস্তির বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এতো নিত্য দিনের ঘটনা। বস্তির অনেক উঠতি বয়সী ছেলেরা মাদক সেবনের পাশাপাশি মাদক বিক্রি করে। তাদের বাঁধা দিতে গেলে নানা ঝামেলা পোহাতে হয়। বস্তির সামনে মাদক বিক্রি হয়। এমন দৃশ্য নিত্য দিনের। তাদের দাবি, স্থানীয় প্রভাবশালী কিছু অসাধু ব্যক্তি এবং প্রশাসন এর সঙ্গে জড়িত। তাদের কারণেই বস্তির কিছু উঠতি বয়সী ছেলে মাদক সেবন ও বিক্রি করে থাকে। বস্তির ভেতরে রাতে মাদকের আসরও বসে। বাঁধা দিতে গেলেই নানাভাবে হয়রানি শুরু হয়। পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে দেয়া থেকে শুরু করে স্থানীয় প্রভাবশালীদের হুমকি তো আছেই।
সম্প্রতি বস্তিতে মাদকের বিস্তার আগের চেয়ে বেড়েছে। কারণ হিসেবে তারা বলেছেন, অনেক যুবক করোনার কারণে কর্মহীন হয়ে পড়েছে। তারা অলস সময় পার করতে মাদকের নেশায় বুঁধ হয়ে থাকছে। এক সময় মাদকের টাকা যোগাড় করতে নেমে পড়ছে মাদক ব্যবসায়। এমন তথ্য জানা গেছে রাজধানীর রূপনগরের শিয়াল বাড়ি বস্তির বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে। রাজধানীর অনেক এলাকায় চুরি, ছিনতাই, রাহাজানি, ডাকাতিসহ নানা ধরণের অপরাধ করার পর অপরাধীরা আশ্রয় নিচ্ছে বস্তিতে। কারণ বস্তি নিরাপদ। এখানে কে আসছে আর আর কে যাচ্ছে তা জানার কোন ব্যবস্থা নেই।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর প্রতিটি বাড়িতে পুলিশের তরফ থেকে ভাড়াটিয়া ও বাড়িওয়ালা সর্ম্পকে তথ্য জানতে ফরম সরবরাহ করা হয়েছে। এমনকি ওইসব ফরম পুরণ করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই সংশ্লিষ্ট থানায় জমা দেয়ার নির্দেশনা রয়েছে। শতভাগ না হলেও ঘন ঘন বাসা পরিবর্তনকারীদের মধ্যে অন্তত ৮০ ভাগের উপর নজরদারি থাকে পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দাদের। তবে বস্তিতে বসবাসকারীদের জন্য কোন তথ্য ফরম সরবরাহ করা হয়নি। এমনকি বস্তির অধিকাংশ বাসিন্দাদের সর্ম্পকেই পুলিশের কাছে তেমন কোন তথ্য নেই। এমন সুযোগটিকেই অপরাধীরা কাজে লাগায়। তারা অপরাধ সংঘটিত করে বস্তিতে আত্মগোপন করে।
এসব বিষয়ের্ যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, বস্তির উপর গোয়েন্দা নজরদারি করা খুবই কঠিন। তারপরেও বস্তিকেন্দ্রিক মাদক ব্যবসাসহ চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি বা লুন্ঠিত মালামাল বস্তিতে লুকিয়ে রাখার বিষয়ের্ যাব তৎপর আছে। প্রায়ই এসব বস্তিতে অভিযানে চুরি, ছিনতাই ও মাদকসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িতরা গ্রেপ্তার হচ্ছে। তারা জামিনে ছাড়া পেয়ে আবারও অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। তবে তারা আর পুরনো বস্তিতে থাকছে না, বসবাসের জন্য বেছে নিচ্ছে অন্য বস্তিকে। এতে করে এসব অপরাধীদের শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে।
বস্তিকেন্দ্রিক অপরাধ নিয়ন্ত্রণে করণীয় সর্ম্পকে বিশিষ্ট অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডক্টর জিয়া রহমান বলেন, বস্তিকেন্দ্রিক অপরাধ কমাতে সবার আগে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করা জরুরী। পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করতে হবে। যাতে বস্তিতে বসবাসকারীরা অপরাধের দিকে ঝুঁকে না পড়ে। এছাড়া নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে।
বস্তিতে শিক্ষাসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা বাড়ানো প্রয়োজন। যাতে বস্তিবাসীদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটে। সবচেয়ে বড় বিষয়, তাদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করা। যদিও সরকার ইতোমধ্যেই গৃহহীন অনেক পরিবারের জন্য জমি কিনে পাঁকা ঘর নির্মাণ করে দিয়েছেন। এ ধারা আরো গতিশীল করতে হবে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকামন্ত্রণালয় এবং ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিসংখ্যান মতে রাজধানীতে বর্তমানে প্রায় একশ’ বস্তি আছে। দিন দিন এসব বস্তির আকার ছোট হয়ে আসছে। অগ্নিদূর্ঘটনাসহ নানা কারণে কমে আসছে বস্তির সংখ্যাও। জীবনযাপনের ব্যয় বাড়ায় অনেকেই ছোট ছোট বস্তি ছেড়ে বড় বড় বস্তিতে আশ্রয় নিয়ে সেখানেই ছোটখাটো কিছু করার চেষ্টা করছেন।
Development by: webnewsdesign.com