হুঙ্কার ছেড়েছেন তার ছেলে প্রিন্স চার্লসও। আদরের ছোট ছেলে হ্যারিকে আর কানাকড়িও দেবেন না চার্লস। রাজপরিবারের সদস্য হিসেবে সরকারি অর্থ গ্রহণ না করার ঘোষণা দিয়েছেন হ্যারি-মেগান দম্পতি। শুধু তাই নয়, রাজপরিবার ছেড়ে সাধারণ মানুষের জীবন বেছে নেবেন তারা। কিন্তু কীভাবে চলবে তাদের জীবন? লিখেছেন পরাগ মাঝি
হতবিহ্বল রাজপরিবার
রাজবাড়ির খাস কর্মচারীদের জরুরি তলব পাঠিয়েছেন স্বয়ং রানী এলিজাবেথ। দিনরাত এক করে সেই কর্মীরা তাই এখন নানা ফন্দি ফিকিরে ব্যস্ত। ব্রিটিশ রাজপরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ও রানী এলিজাবেথের আদরের দৌহিত্র প্রিন্স হ্যারি ও তার স্ত্রী মেগানের রাজপরিবার ছেড়ে যাওয়া ঠেকাতেই সর্বশেষ চেষ্টা চালাচ্ছেন তারা। আর এটি ঠেকানো সম্ভব না হলে কেমন হবে বিপুল সম্পত্তির হিসেব-নিকেশ তা নিয়েও চলছে অঙ্ক কষা। ব্রিটিশ রাজপরিবারের প্রয়াত প্রিন্সেস ডায়ানার ছোট ছেলে প্রিন্স হ্যারি ও তার স্ত্রী মেগানের বিষয়টি সমাধানের জন্য রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের বেঁধে দেওয়া তিন দিন সময়ের আজ শেষ দিন। রাজপরিবারের ঘনিষ্ঠ মহলকে উদ্ধৃত করে এই দাবি করেছে একটি প্রথম সারির ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড।
সিংহাসনের উত্তরাধিকারের তালিকায় আছেন রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের দুই নাতি প্রিন্স উইলিয়াম ও প্রিন্স হ্যারি। সে অনুযায়ী উইলিয়াম ও তার স্ত্রী কেট, হ্যারি ও তার স্ত্রী মেগান রাজপরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্য হিসেবে বিবেচিত হন। এজন্য তাদের নির্দিষ্ট কিছু রাজকীয় দায়িত্ব পালন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। হ্যারি-মেগান এই জ্যেষ্ঠ সদস্যের পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর কথা জানিয়েছেন। এর অর্থ দাঁড়ায়, তাদের ওপর থাকা রাজকীয় দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চাইছেন তারা।
আলোচিত সেই সিদ্ধান্ত
গত ৮ জুন হঠাৎ করেই রাজপরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্যের খেতাব ত্যাগ করার সিদ্ধান্তের কথা জানান ডিউক ও ডাচেস অব সাসেক্স (হ্যারি ও মেগান)। রাজপরিবারের আর্থিক সুযোগ-সুবিধা ছেড়ে সাধারণ মানুষের মতো আয় করে জীবন অতিবাহিত করার মনোভাব পোষণ করেন তারা। বিশ্বখ্যাত এই জুটির এমন সিদ্ধান্তে নড়েচড়ে বসে ব্রিটিশ রাজপরিবার। কারণ আচমকা এই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে কোনো পূর্বধারণাই ছিল না রাজকীয় এই পরিবারটির।
বিবৃতিতে হ্যারি-মেগান বলেন, ‘আমরা পরস্পরের সঙ্গে অনেক আলোচনার পর এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এটি বহু মাসের আলোচনার প্রতিফলন। আমরা রাজপরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্য হিসেবে পদত্যাগ করলেও রানীকে সমর্থন করা অব্যাহত রাখতে চাই। আমরা আর্থিকভাবে স্বাধীন হওয়ার জন্য কাজ করার পরিকল্পনা নিয়েছি।’
কেন এই সিদ্ধান্ত
রাজকীয় জৌলুস ছেড়ে কেউ সাধারণ মানুষের জীবন বেছে নিতে চায়? হ্যারি-মেগানের সিদ্ধান্তের পর এই প্রশ্নটি এখন ঘুরপাক খাচ্ছে পৃথিবীজুড়ে। সাধারণ মানুষের মতো নিজেদের আয়ে নিজেরা চলবেন এমন মনোবাসনা ব্যক্ত করলেও এর নেপথ্যে আরও অনেক কারণ থাকতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিভিন্ন গণমাধ্যম এই বিষয়ে এখন চুলচেরা বিশ্লেষণে ব্যস্ত।
২০১৯ সালের মে মাসে হ্যারি-মেগানের পুত্র আর্চির জন্মের পর থেকেই শোনা যাচ্ছিল হ্যারি ও মেগান পরিচিতির আলো থেকে সরে আসতে চান। বড়দিনের ছুটিও তারা যুক্তরাজ্যের বদলে কানাডায় কাটান। তবে, রাজপরিবার থেকে সরে যাওয়ার কারণ হিসেবে অনেকেই বড় ভাই প্রিন্স উইলিয়ামের পরিবারের সঙ্গে দ্বন্দ্বকে সামনে টেনে আনছেন। এই ধরনের দ্বন্দ্বের বিষয়ে গত বছরের অক্টোবরে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়। সেই সময়টিতে ব্রিটিশ রাজপরিবারের দুই ভাইয়ের মতপার্থক্য প্রকাশ্যে চলে আসে। প্রিন্স হ্যারির কাছ থেকেই এর ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তিনি একটি ব্রিটিশ টেলিভিশনকে বলেন, ‘উইলিয়ামের সঙ্গে আমার দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। আমরা দুজন এখন অনেকটাই দুই পথের মানুষ।’
এর আগে একই বছরের সেপ্টেম্বরে মেগানের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের সময় হ্যারি বলেছিলেন, ‘আমরা দুই ভাই, আমরা সর্বদা ভাই থাকব। হয়তো এই মুহূর্তে দুজন দুই পথে রয়েছি কিন্তু আমি সর্বদা তার পাশে রয়েছি এবং আমি জানি সেও আমার পাশে আছে। আমি তাকে অনেক ভালোবাসি কিন্তু ব্যস্ততার কারণে আমাদের দুজনের দেখা হয় না।’
গুঞ্জন রয়েছে, রাজপরিবারের এই ভাঙনের আভাস মিলেছিল গত বছরের শুরুতেই। আর ধারণা করা হয়, এই ভাঙনের পেছনে হাত রয়েছে প্রিন্স উইলিয়ামের স্ত্রী ডাচেস অব কেমব্রিজ কেট মিডলটন এবং প্রিন্স হ্যারির স্ত্রী ডাচেস অফ সাসেক্স মেগান মার্কেলের। দুই জা’র মধ্যে সম্পর্কের অবনতিই চূড়ান্ত ভাঙনের পথে এগিয়ে গেছে।
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিভিন্ন গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে দুই ভাইয়ের রাজকীয় কার্যালয়, মিডিয়া পরামর্শদাতা টিম এবং স্টাফ সবকিছুই আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা জানা যায়। শুধু তাই নয়, উইলিয়ামকে ছেড়ে কেনসিংটন প্রাসাদ থেকে দূরে প্রিন্স হ্যারির আলাদা সংসার পাতার খবরটিও আসে তখন। প্রিন্স উইলিয়াম এবং প্রিন্স হ্যারি ১০ বছর ধরে কেনসিংটন প্যালেসে একসঙ্গে ছিলেন। ধারণা করা হয়, এই আলাদা হওয়ার পেছনে দুই ভাইয়ের স্ত্রীদের মধ্যে রেষারেষিই ছিল প্রধান কারণ। উইলিয়ামের স্ত্রী কেট এবং হ্যারির স্ত্রী মেগানের সম্পর্কে চিড় ধরার গুঞ্জন এর আগে থেকেই শোনা যাচ্ছিল। এমন দ্বন্দ্ব থেকেই কেনসিংটন প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে উইন্ডসর এস্টেটের ফ্রগমোর কটেজে বসবাসের সিদ্ধান্ত নেন হ্যারি-মেগান।
এছাড়া গণমাধ্যমের বাড়াবাড়ি নিয়েও কিছুটা বিরক্ত ছিলেন হ্যারি-মেগান। বিবিসি’র বরাতে জানা যায়, ২০১৮ সালের মে মাসে হ্যারি-মেগানের বিয়ে হলেও দুই বছর আগেও অভিনেত্রী মেগান মার্কেল ব্রিটিশ প্রেসের কাছে পছন্দের পাত্রী ছিলেন। তারা মেগানের ব্যাপারে বেশ উৎসাহী ছিল। কিন্তু সেই মেগানই ধীরে ধীরে হিরোইন থেকে ভিলেনে পরিণত হলেন।
গত বছর ৬ জুলাই প্রিন্স হ্যারি ও মেগানের ছেলে আর্চি হ্যারিসনকে উইন্ডসর ক্যাসেলের কাছে একটা চার্চে খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত করা হয়। কিন্তু দীর্ঘদিনের প্রথার বাইরে গিয়ে প্রকাশ্যে অনুষ্ঠানের পরিবর্তে এটি অনুষ্ঠিত হয় রুদ্ধদ্বারে। এ ঘটনা মেগানের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনার পথ তৈরি করে।
২০১৯ সালের বসন্ত এবং গ্রীষ্মে ব্রিটিশ ট্যাবলয়েডগুলোর প্রকাশনায় নিজেকে নারী ভিলেন হিসেবে খুঁজে পান ডাচেস অব সাসেক্স মেগান। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, ব্রিটিশ রাজপরিবারের সঙ্গে খাপ খাইয়ে উঠতে পারছেন না তিনি। অথচ ২০১৭ সালের বসন্ত সংখ্যায় ব্রিটিশ প্রেসের কাছে মেগান ছিলেন প্রিয় পাত্রী। হ্যারির সঙ্গে বিয়ের পর থেকেই তার সম্পর্কে বিদ্রƒপাত্মক লেখা প্রকাশ করতে শুরু করে ট্যাবলয়েডগুলো। গত বছর এই দম্পতি তাদের প্রথম সন্তানের জন্ম দিলেও, বসন্ত এবং গ্রীষ্মকালীন সংখ্যায় ট্যাবলয়েডগুলোতে মেগান ছিলেন সবচেয়ে সমালোচিত ব্যক্তিদের একজন। ঘর মেরামতের জন্য বড় অংকের অর্থ খরচ, সাধারণ মানুষের সঙ্গে তার ব্যবহার, তার জনসমক্ষে আসা এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করা নিয়েও সমালোচনার শিকার হন তিনি।
গত জুনে নিজেদের ফ্রগমোর কটেজ মেরামতের জন্য ২.৪ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ করে সংবাদ মাধ্যমের তোপের মুখে পড়েন হ্যারি-মেগান দম্পতি। এতে অভিযোগ করা হয়, খরচ হওয়া পুরো অর্থই এসেছে ব্রিটিশ করদাতাদের পকেট থেকে।
২০১৯ সালের মে মাসে সন্তান জন্মদানও মেগান-হ্যারি দম্পতির সংসারের ভাবমূর্তি উন্নয়নে তেমন ভূমিকা রাখেনি। তাদের সন্তান আর্চির পায়ের ছবি তারা ইন্সটাগ্রামে প্রকাশ করেন। এ ঘটনায় মিরর ব্যাপক সমালোচনা করে বলে, সন্তান জন্মদানের তিন দিন পর ভক্তরা শুধু শিশুর পায়ের ছবি দেখতে চায় না।
অভিযোগ রয়েছে, মেগান প্রচলিত সব নিয়ম-কানুন ভাঙতে চান। যা সাধারণ মানুষ পছদ করে না। দাতব্যকাজ নিয়েও দুই ভাইয়ের পরিবারের মধ্যে ফাটল ধরে। গত বছর জুনে ‘ডিউক অ্যান্ড ডাচেস অফ কেমব্রিজ ফাউন্ডেশন’ থেকে আলাদা হয়ে ‘সাসেক্স রয়্যাল চ্যারিটি’ তৈরি করেছিলেন হ্যারি-মেগান।
ব্রিটিশ রাজপরিবারের বাকিদের থেকে কিছুটা আলাদা হ্যারি-মেগান জুটি। ছোট ছোট নানা ঘটনায় সেই পরিচয় দিয়েছেন তারা। কিন্তু তা বলে এমন একটা সিদ্ধান্ত, তাও রাজপরিবারের কাউকে কিছু না জানিয়ে?
যা হারাবেন হ্যারি-মেগান
অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হতে চান প্রিন্স হ্যারি এবং তার স্ত্রী মেগান। আর এই স্বাধীনতা উপভোগ করার জন্যই রাজপরিবার থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা। রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ তার প্রিয় নাতির এমন সিদ্ধান্তে হতবাক হয়েছেন। আর হ্যারির বাবা চার্লস তো ঘোষণাই দিয়ে দিয়েছেন যে, প্রতি বছর হ্যারি এবং মেগানকে তিনি যে পরিমাণ অর্থ প্রদান করেন তা বন্ধ করে দেবেন। তবে, হ্যারি-মেগানের বক্তব্য থেকে এটাও স্পষ্ট যে, তারা সব জেনেবুঝেই রাজপরিবার ছেড়ে সাধারণ মানুষের জীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
রাজপরিবারের সদস্য হিসেবে হ্যারি-মেগান যে বিলাসী জীবনযাপন করেন তার সব ব্যয় এতদিন রাজপরিবার থেকেই বহন করা হয়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবনে তারা এই ধরনের কোনো অনুদান পাবেন না। তাই তাদের যাবতীয় ব্যয় নিজেদেরই বহন করতে হবে। কিন্তু কীভাবে তারা এই কাজটি করবেন তা নিয়েই চলছে জোর আলোচনা।
ফোর্বসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রিন্স হ্যারি এবং মেগান রাজপরিবারের বিভিন্ন উৎস থেকে প্রতি বছর ঠিক কী পরিমাণ অর্থ পেতেন তা যথাযথভাবে নিরূপণ করা কঠিন। সাসেক্সের একজন মুখপাত্রকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান। তবে, বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে জানা গেছে, এই জুটির আয়ের ৯৫ শতাংশই আসে হ্যারির বাবা প্রিন্স চার্লসের কাছ থেকে। মূলত রাজপরিবারের ব্যক্তিগত সম্পদ ডুসি অব কর্নওয়ালই এই অর্থের উৎস। এই ট্রাস্টের অধীনে অন্তত ১ লাখ ৩১ হাজার একরের ভূসম্পদ রয়েছে এবং এখানে প্রায় সাড়ে চারশ মিলিয়ন ডলারের ব্যবসায়িক সম্পদ রয়েছে। রাজপরিবারের অর্থের জোগান দেওয়ার জন্য ১৩৩৭ সালে ডুসি অব কর্নওয়াল প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এই প্রতিষ্ঠান থেকে হ্যারি-উইলিয়াম দুই ভাইয়ের পরিবারকে সম্মিলিতভাবে ৬৫ লাখ ডলার অর্থ প্রদান করা হয়। আগের অর্থবছরের চেয়ে সেবার অর্থ সরবরাহের পরিমাণ একটু বেড়েছিল। কারণ এই সময়ের মধ্যে হ্যারি-মেগান জুটির পুত্রসন্তান অর্চির জন্ম হয়। ডুসি অব কর্নওয়াল থেকে সম্মিলিতভাবে যে অর্থ প্রদান করা হয় তা ভাগাভাগি করে খরচ করে দুই ভাইয়ের পরিবার। এক্ষেত্রে উইলিয়াম এবং কেট দম্পতির তিন সন্তান হওয়ার কারণে তারা তুলনামূলক বেশি অর্থ পান।
Development by: webnewsdesign.com