সিলেটে পাথর উত্তোলন, পরিবহন ও ভাঙার কাজে সম্পৃক্ত প্রায় পাঁচ লাখ শ্রমিক। কাজগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হলেও ৯৯ শতাংশ শ্রমিকই কোনো ধরনের সুরক্ষা উপকরণ ব্যবহার করেন না। এতে একদিকে দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি শ্বাসকষ্টসহ দীর্ঘমেয়াদি নানা স্বাস্থ্য সমস্যায়ও ভুগছেন পাথর শ্রমিকরা। বেসরকারি সংগঠন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) তথ্য বলছে, গত তিন বছরে পাথর উত্তোলনকালে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৭৪ শ্রমিক।
সীমান্তবর্তী সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে অনুমোদনহীন অসংখ্য কোয়ারি ও অস্থায়ী পাথর ভাঙা কারখানা। সুরক্ষা উপকরণপ্রাপ্তি ও ব্যবহার নিশ্চিত না করেই শ্রমিকদের কাজে নিয়োগ করছে মালিকপক্ষ। বিশ্রাম ও সুরক্ষা ছাড়াই লম্বা সময় ধরে কাজ করতে হচ্ছে শ্রমিকদের। কারখানা ও কোয়ারিগুলোর অধিকাংশ বেআইনিভাবে গড়ে ওঠায় সমন্বয়ের অভাব থেকেই যাচ্ছে। মূলত মালিকপক্ষের উদাসীনতার কারণেই বিয়োগান্ত ঘটনা ঘটছে পাথর কোয়ারিগুলোয়।
গত তিন বছরে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে সিলেটের শাহ আরফিন টিলা, উত্মাছড়া, ভোলাগঞ্জ, জাফলং, বিছনাকান্দি, লোভাছড়া ও কানাইঘাটের বাংলাটিলায়।
২০১৭-এর জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত পাথর কোয়ারিগুলোয় ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার তথ্য দিয়ে বেলা জানিয়েছে, ২০১৭ সালে সবচেয়ে বেশি পাথর শ্রমিকের প্রাণহানি ঘটে। ওই বছর পাথর উত্তোলনকালে নিহত হন ৩৩ শ্রমিক। এরপর ২০১৮ সালে ৩২ ও সর্বশেষ ২০১৯ সালে নয়জন শ্রমিক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান।
নিহতদের মধ্যে শাহ আরফিন টিলায় ২৬ ও জাফলংয়ে ২১ জন মারা যান। কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জে মারা যান ১২ জন। এছাড়া গোয়াইনঘাটের বিছনাকান্দিতে পাঁচ, কানাইঘাটের বাংলাটিলায় ছয় এবং বাকিরা লোভাছড়া ও উত্মাছড়ার পাথর কোয়ারিতে পাথর তুলতে গিয়ে প্রাণ হারান।
বেলার তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনকালে টিলা ধসে কিংবা গর্ত খননকালে মাটি ও পাথরচাপায় মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে বেশি। অতিরিক্ত পরিশ্রমের ফলে ক্লান্তি, প্রশিক্ষণ না থাকা এবং অসাবধানতার কারণে এসব দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনাগুলোর বেশির ভাগই ঘটেছে দুপুরের পর বেলা ১টা থেকে ৩টার মধ্যে।
বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বেলা সিলেট অঞ্চলের সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শাহ শাহেদা। তিনি বলেন, পরিবেশের বিষয়টির পাশাপাশি আমরা শ্রমিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়েও বেশ চিন্তিত। পরিবেশ বাঁচিয়ে রেখে সামগ্রিকভাবে কীভাবে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকের স্বার্থ সংরক্ষণ করা যায়, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এসে গেছে।
সিলেটের পাথর শিল্পের ওপর গবেষণা করেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মো. মহসিন আজিজ খান ও প্রভাষক সাইফুল ইসলাম। তাদের গবেষণার ফলাফল বলছে, পাথর শিল্পের (বিশেষত পাথর ভাঙা) সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের মধ্যে সুরক্ষা উপকরণের ব্যবহার একেবারে নেই। ৯৯ শতাংশ শ্রমিক কোনো ধরনের সুরক্ষা উপকরণ ছাড়াই বছরের পর বছর কাজ করছেন। সুরক্ষা ছাড়া কাজ করতে গিয়ে ৫৭ শতাংশ শ্রমিক বড় ধরনের আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করেন। ৯২ শতাংশ শ্রমিক সুরক্ষা উপকরণ ব্যবহার করতে চাইলেও কারখানাগুলোয় ৮৫ শতাংশ সুরক্ষা উপকরণই পাওয়া যায় না। অন্যদিকে ৯৭ শতাংশ শ্রমিক সুরক্ষা উপকরণ ব্যবহারসংক্রান্ত কোনো প্রশিক্ষণ পান না। ৯৪ শতাংশ কারখানায় ন্যূনতম প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই।
সিলেটের পাথর শিল্প ও শ্রমিকদের জীবন নিয়ে দীর্ঘ পর্যবেক্ষণের কথা জানিয়ে অধ্যাপক ড. মো. মহসিন আজিজ খান বলেন, সামগ্রিকভাবে এ খাতে জড়িত সব শ্রমিক প্রায় শতভাগ অরক্ষিত অবস্থায় কাজ করছেন। গবেষণা করতে গিয়ে পরিস্থিতি দেখে মনে হলো, দেখার তেমন কেউ নেই। এখানে শ্রমিকদের জীবন অনেকটাই মূল্যহীন। সুরক্ষার উপকরণ ব্যবহার না করায় শ্রমিকদের মধ্যে আহত হওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি।
ভারী কাজ করালেও মালিকপক্ষ তাদের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে একেবারে উদাসীন উল্লেখ করে তিনি বলেন, শ্রমিকরা ব্যাক পেইন, শ্বাসকষ্ট ও সিলোকোসিসের মতো দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এছাড়া শ্রমিকদের বয়স ৩০-এর গণ্ডি না পেরোতেই স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারাচ্ছে—গবেষণায় এমনটি উঠে এসেছে। এ ব্যাপারে সরকারকে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
এদিকে টাস্কফোর্সের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করে বোমা মেশিন ধ্বংস করে বেআইনিভাবে পাথর উত্তোলনের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের কথা বলছে সিলেট জেলা প্রশাসন। পাথর শ্রমিকদের জীবন ও স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবেলায় মাঝেমধ্যে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো হয়—এমন দাবি করে জেলা প্রশাসক এম কাজী এমদাদুল ইসলাম বলেন, যারা এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, আমরা তাদের এ ব্যাপারে তাগিদ দিয়ে থাকি। এছাড়া পাথর ভাঙা কারখানাগুলো নিয়ে গোয়াইনঘাটে আলাদা একটি অঞ্চল করার পরিকল্পনা পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রের অপেক্ষায় আছে।
Development by: webnewsdesign.com