রাত পোহালেই ২০২১। পুরােনাে বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত বিশ্ববাসী। শেষ হবে ২০২০ সাল নামক ব্যতিক্রমী এ বছরটি। যে বছর জুড়ে ছিল শুধুই প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস মহামারির রাজত্ব। যা সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে আমাদের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। বছরের বেশিরভাগ সময়ই বন্ধ ছিল ক্যাম্পাস। অনলাইনে পড়াশােনা-ক্লাস-পরীক্ষা নিয়ে আলােচনা-সমালােচনা ছিল বছরজুড়েই। এ বছরটি অনেক কিছুই শিখিয়েছে। ২০২০-এর এই শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে ২০২১- এ কী হবে আমাদের প্রত্যয়? কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ভাবনা ও মতামত তুলে ধরেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ক্যাম্পাস সাংবাদিক মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ।
নতুন বছরে নতুনত্বের আবিষ্কার হোক
স্বাভাবিকভাবেই বছরের শুরু, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে পদার্পণ তাই নান্দনিক অনুভূতি যেকোন বছরের চেয়ে অনেক বেশী ছিল। আলোর চাকচিক্যময় রশ্মি জীবনে পুরোপুরি আলো ছড়ানোর আগেই নেমে আসে আঁধারের কালো ছায়া৷ থমকে দাঁড়ায় পৃথিবী, স্তম্ভিত হই আমরা। সামাজিক দূরত্ব, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, স্যানিটাইজিং, ঘরের বন্দীদশার মতো অনেক অকল্পনীয় বিষয় সামনে এসে অবস্থান করে। দীর্ঘ বিরতি একদিকে যেমন তৈরী করেছে ‘এনার্জি সেভেয়িংয়ের’ পথ অন্যদিকে নিজের দক্ষতাকে বাড়িয়ে বা ঝালিয়ে নেবার দিয়েছে অবারিত সুযোগ। মহামারী আমাদের জীবনে নতুনত্বের সৃষ্টি করেছে, শিখিয়েছে মানবিকতা, পাশে দাঁড়ানোর নৈতিক শিক্ষা, তুলে ধরেছে জগতের নির্মম বাস্তবতাকে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে থাকার সুযোগ না হলেও ঘরে বসে অনলাইন ক্লাস শিখিয়েছে পরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়ে চলার মতো সক্ষমতাকে। শত দূরাবস্থায় ২০ শিখিয়েছে মানিয়ে চলার মতো বাস্তবমুখী শিক্ষা, যা হবে ২১ এ দূর্বার গতিতে এগিয়ে চলার মূলমন্ত্র।
অনন্য প্রতীক রাউত
শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ।
বিশ্বায়নের সাথে তাল মিলাতে হবে
বিশের বিষে জর্জরিত হয়ে নতুন বছরে নতুন কিছু করার উদ্যম যেন লকডাউনে বন্দি এক সত্তা। অনেকেই বন্দিত্বকে ইতিবাচকভাবে কাজে লাগাতে পেরেছি আবার অনেকেই ক্যাম্পাস, বন্ধু-আড্ডা ছেড়ে চুড়ান্ত হতাশায় পৌঁছে গেছি। আসছে নতুন বছর ২০২১। নতুন বছরে নতুন ছকে কর্মপরিকল্পনা করে ২০২০ এর বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে যাওয়া এখন সময়ের দাবি। করোনাকালীন সময়ে নিজেদের বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার এক অবাধ বাস্তবায়ন করা শিখেছে দেশের প্রতিটি মানুষ। সরকারের সকল খাতে কার্যক্রম অব্যাহত রেখে দেশের মানুষকে অনেকটা স্বস্তি দিয়েছে। করোনো আমাদের নতুনভাবে মানুষের প্রতি সহযোগিতার এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা, বন্ধন বৃদ্ধির দৃঢ় আভাস দিয়েছে। তারপরও বলতে হয় প্রযুক্তি আর চিকিৎসা ক্ষেত্রগুলো আরো অগ্রসর হওয়া উচিত। বিশ্বায়নের এই সময়ে ২০২০ এ আমরা প্রযুক্তির প্রয়োজনীয়তা আরো ভালোভাবে অনুধাবন করেছি। সেই শিক্ষা কাজে লাগিয়ে ইন্টারনেটের ইতিবাচক ব্যবহারে আরো সচেতন হতে হবে। সকলকে মানবিক হয়ে বিপদে-আপদে একে অন্যের পাশে থাকতে হবে। ইতিবাচক মানসিকতা, একে অপরকে মানসিক সমর্থন দেয়ার মাধ্যমে হতাশা নামক কালো অধ্যায় থেকে মুক্তি পেতে পারি খুব সহজেই।
ফারহানা লিয়া
শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ।
পদ্ম পাতার জলের মতো ক্ষণস্থায়ী জীবন আমাদের। প্রতিনিয়তই ক্ষণস্থায়ী জীবনের এক একটি পৃষ্ঠা বদল হচ্ছে। পাওয়া না পাওয়ার অভিযোগ কে পিছনে ফেলে দিয়ে ভাবনার নতুন প্রত্যয় কে জাগ্রত করে, বরণ করে নিয়েছিলাম আমরা ২০২০ কে। নতুন কিছু করার স্বপ্ন। প্রিয়জনের পাশে থাকার অদম্য ইচ্ছাশক্তি ছিল। পরিচিত মানুষগুলোর মুখে এক টুকরো হাসি ফোটানোই ছিল মূল লক্ষ্য। জীবন নদীর শান্ত গতিপথ হঠাৎ যেন আটকে যায় করোনা নামক ভাইরাসের বাকেঁ। বছর জুড়ে মানসিক হতাশায় দিন কেটেছে সবার। প্রবাহমান এই সময়ের দুনিয়ায় কালের বিস্তারে ২০২১ এ আবারও সবাই এক নতুন দিগন্তের পথে ডানা মেলবে। সকলের স্বপ্নগুলো নতুন বছরে নতুন করে জাগ্রত হবে। নতুন করে আবারো সবাই ভালোবাসার উষ্ণতা ছড়িয়ে দিবে সবার মনে। দূরত্বের গতিপথে দেখা দিবে ঘনঘটা। নতুন বছরে প্রিয়জনের মুখে হাসি ফুটোক এই প্রত্যাশা সবার। মনের কোণে এই প্রত্যয়ই ব্যক্ত ২০২১ কে আশীর্বাদ পূর্ন বছর করে আগমন জানাবে সবাই।
সানজিদা মাহমুদ মিষ্টি
শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট।
বর্তমানের শিক্ষা হোক আগামীর পথচলা
‘সবুজ নেশায় ভোর করেছি ধরা, ঝড়ের মেঘে তোরি তড়িৎ ভরা’ – কবিগুরুর এমন উদ্ধৃতি এবং হাজারো স্বপ্ন ও অনুভূতি নিয়ে ২০২০-এর পদযাত্রা শুরু করেছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করেই ঝড়ের মতো কোভিড-১৯ মহামারি পুরো পৃথিবীকে থমকে দিয়েছে। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সকল অর্থনীতিক হাতিয়ারের পথ হার মেনেছে করোনাভাইরাসের কাছে। কতটা অদক্ষ জনবল নিয়ে পরিচালিত হচ্ছিল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আর এ ব্যবস্থার সকল দুর্বলতা, দুর্নীতি ও সিদ্ধান্তহীনতা পরিচয়কে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। জ্ঞান-অর্জন যেখানে দুষ্কর হয়ে পড়েছিল এমন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন অনলাইনের বিভিন্ন মাধ্যম জুম, স্কাইপি ব্যাবহার করে শিক্ষার্থীদের পাঠদানের সুষম পরিকল্পনা করেন যাতে জ্ঞানচর্চা অব্যাহত থাকে। এই সঙ্কটে সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো স্ব-নির্ভরতা ও স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে সচেতন থাকা। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রীর পরিকল্পনা অনুযায়ী ডিজিটাল দেশে পরিনত হতে চলেছে। তাই ২১-এ আমাদের প্রত্যয় হবে অভিজ্ঞতাসঞ্জাত জ্ঞান ও অর্জিত দক্ষতাকে প্রায়োগিক করে গড়ে তোলা এবং পূর্বের ন্যায় স্বাভাবিক জীবনযাপন করা।
মোঃ মোসাদ্দিকুর ইসলাম
শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ।
বিগত দিনের শিক্ষা বাস্তবায়িত হোক
প্রাপ্তি, হতাশা, গ্লানি বা অবসাদের বছর ইত্যাদি যে নামেই ২০২০ কে অবহিত করি না কেন, কোনটায় বোধহয় নামান্তর করা ভুল হবে না। থাকুক প্রাপ্তি বা অপ্রাপ্তি সবকিছুই কোন না কোন শিক্ষা বা অভিজ্ঞতা জানান দিয়ে যায়। তেমনি ২০২০ সালটাও ঘরবন্দী অবস্থায় বিষাদময় পরিস্থিতিতে থাকতে শিখিয়ে গেল। বছরটিতে প্রাপ্তির চেয়ে হারানোর বেদনাই ছিল বেশি। হারানোর দিকটা বলতে গেলে প্রথমেই আসবে ক্যাম্পাসে থেকে বিচ্ছিন্ন প্রায় একটি বছর। আর প্রাপ্তির দিকটা বলতে গেলে প্রথমেই আসবে মা বাবাকে বড় হওয়ার পর সবচেয়ে বেশি কাছে পাওয়া, বিরক্তিকর অনলাইন ক্লাস, মহামারী করোনা ভাইরাস, বিষাদময় কিছু দিনসহ এমন কঠিন ও বিভীষিকাময় পরিস্থিতি পাড়ি দেওয়ার অভিজ্ঞতা। নতুন বছরে বিগত দিনের এই শিক্ষাগুলো বাস্তবায়নে সচেষ্ট হতে হবে। সামনের সোনালী দিনে হঠাৎ করে কর্মবিমুখ মানুষের মানিয়ে চলার পথে যা হবে দীর্ঘ বাঁধা। নতুন বছরের প্রত্যয় থাকবে বিগত বছরের হারিয়ে যাওয়া বা প্রাপ্তির শেষ থেকে শুরু করে আবার সবাইকে নিয়ে যেকোনো পরিস্থিতিতে একসাথে বাঁচতে শেখা।
রিদুয়ান ইসলাম
শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ।
২০-এর শোক হোক ২১-এর শক্তি
কালের পরিক্রমায় ক্যালেন্ডারের শেষ পাতাটাও উল্টানোর সময় এসে গেছে, শপথ নিতে হবে নতুনের। কিন্তু প্রাক্তন (২০২০) আমাদের কাছে মোটেই সুখকর ছিলো না। মৃদু শীতের রেষকে উপেক্ষা করে মহামারী আর শঙ্কার উত্তাপ যেন গোটা পৃথিবীকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে অল্প সময়ের ব্যবধানে। মহামারি করোনা ভাইরাসের প্রকট এতো তীব্রভাবে আমাদের ঘ্রাস করবে সেটা সকল শিক্ষার্থীদেরই অজানা ছিল। শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে এ বছরটিতে। শিক্ষা, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রগতি, সমাজ, সংস্কৃতি সমগ্র খাতকে করেছে অচল। ধর্ষণসহ অন্যান্য ব্যধিও মহামারীর মত ছড়ালেও করোনা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে কিভাবে সবাইকে নিয়ে একসাথে বাঁচতে হয়, দেশ ও জাতিকে বাঁচানোর যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়। বিশেষ করে এ যুদ্ধে তারুণ্যকে আমরা দেখেছি যেন সেনাপতির ভূমিকায়। করোনার ভয়াল থাবা আমাদের আপনজনদের পাশাপাশি কেড়ে নিয়েছে নক্ষত্রতুল্য অসংখ্য গুণীজনদের। এই শোককে নতুন বছরের শক্তিতে পরিণত করে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশ ও জাতির জন্য কাজ করতে পারলেই স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।
রেজওয়ান আহম্মেদ
শিক্ষার্থী, ইংরেজি ডিসিপ্লিন।
জীবন নামক ক্ষুদ্র গ্রন্থের বিরল এক অধ্যায়ের নাম করোনার এই বছর ২০২০। ঝড়া পালকের মত একটি বছর যেন, আমাদের জীবন থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে। বিশ্বকে থামিয়ে দেওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট ছিলো। সবকিছু থমকে গিয়েছে। অনেক কিছু দিয়েছে, নিয়েছে, শিখিয়েছে এই ২০২০ সালটি৷ করোনা মোকাবিলায় সচেতনতা বৃদ্ধি ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার নেই৷ করোনো আমাদের নতুনভাবে মানুষের প্রতি সহযোগিতার এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা, বন্ধন বৃদ্ধির দৃঢ় আভাস দিয়েছে। তারপরও বলতে হয় প্রযুক্তি আর চিকিৎসা ক্ষেত্রগুলো আরো অগ্রসর হওয়া উচিত। করোনার এই বছরটি আমাদের মনে এমন একটা সাহস জুগিয়েছে, যা সামনের কোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় আমরা কাজে লাগাতে পারবো। আর সামনের দিনগুলোর জন্য আমাদের অভিলাষ হবে যেন, এমন কোনো মহামারীর সময়ে আতংকিত না হয়ে সচেতনতার মাধ্যমে তা প্রতিরোধ করতে সম্ভব হয়।
মিথিলা দেবনাথ ঝিলিক
শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ।
২০২০! এ যেন ভয় আর উৎকণ্ঠায় ছেয়ে যাওয়া অভিশপ্ত এক বছর। করোনাভাইরাসের প্রভাবে মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধির যেন ক্লান্তি নেই!
তবুও এই বছরে বাংলার প্রাপ্তির ঝুড়িটা একেবারে খালিও না। অনলাইনে ঘরে বসে ক্লাস করার মাধ্যমে সম্পূর্ণ এক নতুন প্রযুক্তি আয়ত্ত্বীকরণ এই অভিশপ্ত সময়েই হয়েছে। করোনা যুদ্ধ মোকাবেলায় সরকারের ঘরে ঘরে খাবার ও প্রয়োজনীয় ঔষধ সরবরাহ এবং অনলাইনে চিকিৎসাসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান যেন ‘ডিজিটাল বাংলাদেশের’ বাস্তবতা মেলে ধরেছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন সঙ্কটসহ নানামুখী চ্যালেঞ্জ পাড়ি দিয়ে পদ্মা সেতু দৃশ্যমান, গ্লোব বায়োটেকের ‘ব্যানকোভিড করোনা ভ্যাকসিন’ উৎপাদন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, মানবসূচক উন্নয়ন ও বিভিন্ন প্রণোদনা বাস্তবায়নের দ্বারাই ‘২০ দুঃসময়কে জয় করতে শিখিয়ে গেছে। করোনাকালীন সময়ের বড় বাঁধা বন্দীকালীন দূরাবস্থার জন্য সৃষ্টি হওয়া মানসিক অস্থিরতা। দৃঢ় পারিবারিক বন্ধন গড়া, মানবিকতার মহিমা ও পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব এ সবই নতুন করে যেন শিখিয়ে গেল বছরটি। ২০২০ এর শেখা ও ‘২১ এর প্রত্যয় হোক-ডিজিটাল বাংলাদেশে স্বনির্ভরতায়, ভালোবাসায় এগিয়ে যাওয়ার প্রয়াস। সকল অশুভকে দূরে সারিয়ে আলোকিত হয়ে উঠুক ২০২১।
রুকাইয়া মিজান মিমি
শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ।
Development by: webnewsdesign.com