আসন্ন প্রথম ধাপের পৌরসভা নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন বিক্রিতে প্রথম দফায় কড়াকড়ি করেছিল আওয়ামী লীগ। তৃণমূল থেকে প্রার্থীর নাম পাঠানো না হলে কেউ দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করতে পারতেন না। দ্বিতীয় ধাপে নিজেদের অবস্থান থেকে সরে এসেছে ক্ষমতাসীন দলটির হাইকমান্ড। মনোনয়ন ফরম বিক্রি শিথিল করা হয়েছে। এমপি-মন্ত্রী এবং জেলা-উপজেলা পর্যায়ের প্রভাবশালী নেতাদের বলয় ভাঙতে এবং মনোনয়ন ‘বাণিজ্য’ ঠেকাতে নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে টানা তৃতীয়বারের ক্ষমতায় থাকা দলটি।
দ্বিতীয় ধাপের পৌর নির্বাচনে দলের দুর্দিনের ত্যাগী, পরিশ্রমী, পরীক্ষিত এবং বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের বিরুদ্ধে মাঠের আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় থাকা নেতা-কর্মীদের দলীয় প্রার্থী করতে মনোনয়নপত্র অনেকটাই ‘উন্মুক্ত’ করেছে আওয়ামী লীগ। সেক্ষেত্রে তৃণমূলের পাঠানো তালিকায় নাম না থাকলেও দলের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করতে পারবেন মেয়র পদে নৌকা প্রত্যাশী নেতারা। এ জন্য আগ্রহীদের দলের বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রেসিডিয়াম সদস্য, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক কিংবা কেন্দ্রীয় নেতার সুপারিশ নিতে হবে। এর আগে তৃণমূল আওয়ামী লীগের পাঠানো তিন সদস্যের তালিকার বাইরে কেউ মনোনয়ন ফরম ক্রয় করতে পারেননি।
সূত্রে জানা যায়, পৌরসভা নির্বাচন সামনে রেখেই মঙ্গলবার রাতে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয়ে এক অনির্ধারিত বৈঠক করেন দলটির কেন্দ্রীয় এবং বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। অনির্ধারিত ওই বৈঠকে উঠে আসে আসন্ন পৌর নির্বাচনে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল। বিশেষ করে তৃণমূল সংগঠনের রেজুলেশনে মনোনয়নপ্রত্যাশীর নাম দিতে ‘বাণিজ্য’, এমপি-মন্ত্রীদের কাছের লোক হিসেবে পরিচিত, নিকটাত্মীয় ‘অজনপ্রিয়’ প্রার্থীর নাম পাঠানো, জেলা-উপজেলা-পৌর আওয়ামী লীগের নেতাদের স্বেচ্ছাচারিতা, তৃণমূলের সিনিয়র নেতাদের সিন্ডিকেট করে প্রার্থী বাছাই করার বিষয়গুলো। ইতিমধ্যে বঞ্চিত অনেক নেতাই বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্তদের কাছে মৌখিক অভিযোগ করেছেন বলে বৈঠকে উঠে আসে।
প্রথম দফায় ২৫ পৌরসভায় দলের মনোনয়ন তুলতে না পারা বঞ্চিতদের অভিযোগ, নির্বাচন সামনে রেখে দলীয় প্রার্থী বাছাই করতে মন্ত্রী-এমপি এবং তৃণমূলের সিনিয়র নেতারা নিজ নিজ সিন্ডিকেটের বাইরে ‘জনপ্রিয়তা’ থাকলেও অন্য প্রার্থীর নাম কেন্দ্রে পাঠান না। তারা সুকৌশলে পিছিয়ে রাখছেন তৃণমূলের নিবেদিতপ্রাণ পরীক্ষিত নেতাদের। আবার তৃণমূলে ভোট দিয়ে প্রার্থী বাছাইয়ের নামেও চলে বড় ধরনের আর্থিক লেনদেন, যা নিবেদিত কর্মী বা নেতারা হাইব্রিড ও এমপি-মন্ত্রীদের আত্মীয়স্বজনদের কারণে পেরে উঠতে পারেন না। সে কারণেই তৃণমূল সংগঠনের রেজুলেশনে নাম না থাকা মনোনয়নপ্রত্যাশীদের জন্য ফরম বিক্রি কিছুটা শিথিল করেছে আওয়ামী লীগ। গতকাল দুপুরে দলীয় সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে আসেন আওয়ামী লীগের এক শীর্ষস্থানীয় নেতা। এ সময় তিনি মনোনয়ন বিক্রির সঙ্গে যুক্ত দলীয় নেতা এবং সভানেত্রীর কার্যালয়ের স্টাফদের নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘তৃণমূল থেকে নাম না পাঠালেও দলের নেতা-কর্মীরা মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করতে পারবেন। যারাই দলের মনোনয়ন ফরম নিতে দলীয় সভানেত্রীর কার্যালয়ে আসবেন তাদের যেন মনোনয়ন ফরম দেওয়া হয়। তিনি শর্ত জুড়ে দেন, এতে বিভাগীয়, প্রেসিডিয়াম, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক কিংবা কেন্দ্রীয় কোনো নেতার সুপারিশ থাকতে হবে।’ ধানমন্ডি কার্যালয়ে উপস্থিত একাধিক নেতা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাছিম বলেন, ‘পৌরসভা নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন ফরম বিতরণে কিছুটা শিথিলতা আনা হয়েছে। মনোনয়নের জন্য আমাদের তৃণমূল যে তালিকা পাঠায়, এর বাইরে যদি কেউ দলীয় মনোনয়ন নিতে আগ্রহী থাকেন, তাহলে আওয়ামী লীগের বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদকদের সুপারিশ থাকতে হবে, কিংবা দলের কেন্দ্রীয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা সিনিয়র নেতাদের সুপারিশ থাকতে হবে। তাহলে তৃণমূলের পাঠানো তালিকার বাইরে থাকা আগ্রহী নেতারা মনোনয়ন ফরম নিতে পারবেন। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ও সিনিয়র নেতাদের সুপারিশে মনোনয়ন ফরম ক্রয় করা নেতাদের বিষয়টি মনোনয়ন বোর্ড সভায় আলাদাভাবে উপস্থাপন করা হবে। জনপ্রিয়তা ও বাস্তবতা বুঝে চূড়ান্ত করা হবে প্রার্থী।
আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, প্রথম ধাপের পৌরসভা নির্বাচনের দলীয় প্রার্থী বাছাইয়ে হার্ডলাইনে ছিলেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত নির্বাচনে যারা বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন, তাদের মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। তিনটি পৌরসভায় একক প্রার্থীর নাম পাঠানো হয়। কিন্তু তারা বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন। পরে তথ্য জানাজানি হলে মনোনয়ন পরিবর্তন করা হয়। তৃণমূল থেকে পাঠানো নাম ও এমপি-মন্ত্রীদের পছন্দের প্রার্র্থীদের বাদ দিয়ে তৃণমূলে জনপ্রিয় ও ত্যাগীদের মূল্যায়নের নিদের্শ দেন দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ জন্য কয়েকজন নেতাকে বিশেষ দায়িত্বও দেন তিনি। নেতারা তৃণমূলে খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারেন, এমপি-মন্ত্রী এবং জেলা-উপজেলার শীর্ষস্থানীয় নেতারা প্রার্থী বাছাইয়ে ‘প্রভাব’ বিস্তার এবং ‘বলয়’ ভারী করছেন। সে কারণেই দলীয় মনোনয়ন ফরম বিতরণে শিথিলতা আনা হয়েছে।
Development by: webnewsdesign.com