সংবিধান একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য আয়নাস্বরূপ। রাষ্ট্র পরিচালনার সকল কার্যক্রম পরিচালিত হয় সংবিধানের বিধি মোতাবেক।সংবিধানের ধরণ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম। কোথাও লিখিত, কোথাও অলিখিত। বিভাজন করতে চাইলে আরো করা সম্ভব। সরকারের বা রাষ্ট্র পরিচালনার ধরণ অনুযায়ী সংবিধান নানা রকম রূপে আবর্তিত৷ ১৯৭১ সালে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর অল্প সময়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংবিধান যাত্রা শুরু করে। এপ্রিল ১৯৭২ এ ড.কামাল হোসেন কে আহ্বায়ক করে ৩৪ সদস্য বিশিষ্ট সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়। সংবিধান লেখার পর এর বাংলা ভাষারূপ পর্যালোচনার জন্য ড. আনিসুজ্জামানকে আহবায়ক, সৈয়দ আলী আহসান এবং মাজহারুল ইসলামকে ভাষা বিশেষজ্ঞ হিসেবে একটি কমিটি গঠন করে পর্যালোচনার ভার দেয়া হয়। নানা পর্যালোচনা এবং অধিবেশনের পর সংবিধান চূড়ান্ত হয়। যেখানে গণপরিষদের ৪০৪ জন সদস্য স্বাক্ষর করে। ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বর সংবিধান চূড়ান্ত ভাবে প্রণীত হয়। সেই সূত্র ধরেই ৪ঠা নভেম্বর সংবিধান দিবস।
বিজয়ের ঠিক এক বছরের মাথায় ১৯৭২ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান। যুদ্ধ বিদ্ধস্ত দেশ বির্নিমানের পাশাপাশি সংবিধান প্রণয়ন বড় চ্যালেন্জ ছিল অবশ্যই। যা বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী নেতৃত্ব এবং সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সহযোগিতায় সহজেই উতড়ে যায় বাংলাদেশ। সংবিধান হিসাবে আদর্শ একটি সংবিধান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা। জনগণের মৌলিক অধিকারকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে খুব ভালো ভাবেই। বৈশিষ্ট্যর দিক থেকে বিবেচনা করলে – অামাদের সংবিধানের লিখিত সংবিধান, অনুচ্ছেদ সংখ্যা ১৫৩, তফসিল ৪, ভাগ ১১, প্রস্তাবনা ১ টি। সময়োপযোগী তথা যুগোপযোগী আইন সৃষ্টি এবং সময়ের সাথে পাল্লা দিতে সংবিধান সংশোধন করা জরুরি।
এখন অব্দি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান ১৭ বার সংশোধন করা হয়েছে। তবে, দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ডের পর সাম্প্রদায়িক, দেশদ্রোহী নানা অপশক্তি অবৈধ ভাবে ক্ষমতা দখল করে নিজ ইচ্ছা মতো পবিত্র সংবিধানকে করেছে কলঙ্কিত। প্রণয়ন করেছে “ইনডেমনিটির” মতো কালো অাইন। পাশাপাশি, সুকৌশলে সংবিধানে নানা ধারায় স্থান দেয়া হয়েছে অনৈতিক তথা মহান মুক্তিযুদ্ধের শুদ্ধ চেতনা বিবর্জিত বিষয়। ক্ষুন্ন করা হয়েছে জনগণের মৌলিক অধিকার, ধ্বংস করা হয়েছে ভোটাধিকারের মতো অতীব প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক অধিকার।
পরবর্তীতে, সুস্থ নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদীয় গণতন্ত্র দেশে প্রতিষ্ঠিত হলেও রয়ে যায় সেই অস্বাভাবিকতা। যার খাঁদ থেকে অাজো বাংলাদেশ পুরোপুরি বের হতে পারে নি। অন্যদিকে, অশিক্ষা বড় একটি কারণ সাংবাদিক অধিকার প্রতিষ্ঠার অন্তরায় হিসেবে। অথচ, দেশের সর্ব স্তরের মানুষের কল্যাণের কথার যৌক্তিক প্রতিফলন রয়েছে সংবিধানে। অন্যদিকে, প্রভাবশালী মহল এবং রাজনৈতিক দখলদারিত্ব বা অাধিপত্য বিস্তারকারী মনোভাবের কারণে প্রতিনিয়ত ক্ষুন্ন হচ্ছে সংবিধানের মর্যাদা। এমনকি, সমাজের “ক্যান্সারস্বরূপ” এসব লোকেরা প্রশাসন পুলিশকেও নিয়েছে পকেটে। দিন যতো এগোচ্ছে খেটে -খাওয়া মানুষের টিকে থাকা ততোদিন কঠিন হচ্ছে বা বৃত্তের মধ্যে অাটকে যাচ্ছে। তাঁরা পরিপূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন কোন ভাবেই করতে পারছে না। অথচ, দেশকে স্বাধীন করার বড় কারণ ছিল এসব দুঃখী সন্তানদের মুখে হাসিয়ে ফুটিয়ে শিক্ষা ও জ্ঞানের বিকাশ ঘটানো।
যাতে এগিয়ে যায় সবুজ শ্যামলময় বাংলাদেশ। সাধারণ মানুষ হিসাবে আমার মতামত অশিক্ষা দূরীকরণের ব্যাপারে মানুষকে অনুপ্রেরণা প্রদান করা প্রয়োজন। বর্তমান সরকারের দূরদর্শীতার অংশ হিসাবে সেই অনুপ্রেরণার মাত্রা অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে, যেটা ইতিবাচক সংবাদ। প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করার দরূণ কাজটি সহজ, নির্মল হয়েছে। এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা পৃথিবীর অনেক দেশের জনসংখ্যার চেয়ে বেশী! প্রাথমিক শিক্ষার যেমন অগ্রগতি হচ্ছে তেমনী সাধারণ মানুষকে তাঁর অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা অতীব জরুরি। আর গ্রামের মোড়ল কালু মিয়ারা যেন হুক্কা বা সিগারেটে টান মেরে বলতে না পারে আজ থেকে তোর এসব আমার। কোন প্রভাবশালীর চক্করে যেন সর্বস্ব হারাতে না হয় হারাধন বাবুদের বা মানুষ হিসাবে বাঁচার অধিকার যেন পায় রিক্সা চালক রশিদ মিয়ারা তবেই প্রতিষ্ঠিত হবে আইনের পরিপূর্ণ শাসন। লঙ্ঘন হবে না মানবাধিকার, সমাজ হবে শান্তি, সমৃদ্ধির নীড়।
সংবিধানের মতো পবিত্র বিষয়কে দেশের সর্বত্র বাস্তবরূপে ছড়িয়ে দিতে কোন দিবসের প্রয়োজন নেই। ঐতিহাসিক নিয়ম রক্ষার অংশ হিসাবে না হয় হোক পালিত। তবে বাকি ৩৬৪ দিনই প্রজ্বলিত শিখার মতো অটুট থাকুক মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার, আইনের কার্যকরী শাসন এবং সঠিক বিচারব্যবস্থা এটাই কামনা। আইনের শাসনে বাংলাদেশ হোক রোলমডেল। আইন মেনে চলা, অধিকার ভোগ এবং কর্তব্য পালন করে প্রত্যকের হওয়া উচিত আদর্শ নাগরিক। এক এক করে একদিন সবাই হবো আদর্শ নাগরিক, ছড়িয়ে পড়বে অাদর্শ সংবিধানের বাস্তব সু-বাতাস এটাই প্রত্যাশা। প্রত্যাশার ফল কতোটা বাস্তবরূপ নেয় বা এ যাবতকালে দৃষ্টিগ্রাহ্য হবে কিনা সেটাই ভাবনার মতো বিশাল বিষয়বস্তু।
লেখক:: অনন্য প্রতীক রাউত
শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
Development by: webnewsdesign.com