“কেলেঙ্কারির মূল হোতা বা মদদদাতারা আড়ালেই থেকে যাচ্ছে”

সোমবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ | ৩:৫৯ অপরাহ্ণ

“কেলেঙ্কারির মূল হোতা বা মদদদাতারা আড়ালেই থেকে যাচ্ছে”
apps

দেশে যেকোনো কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে এলেই তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণ করছে সরকার।কিন্তু দিনশেষে কেলেঙ্কারির মূল হোতা বা মদদদাতারা আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। গণমাধ্যমসহ রাজনীতিতে যখন দুর্নাম আসে তাৎক্ষণিক বিচারের প্রতিশ্রুতি ঘোষণা হয়।কিন্তু আরেকটি কেলেঙ্কারির এলে প্রথমটি ধামাচাপা পড়ে যায়।

এমন পরিস্থিতিতে শীর্ষ ব্যক্তিরা মনে করছেন, ঘটনার সমাধান ও দোষীদের বিচার না হওয়ায় বারবার কেলেঙ্কারির ঘটনা সরকারের সব অর্জন ম্লান করে দিচ্ছে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে দুর্নীতিবাজদের মদদদাতাদের আইনের আওতায় আনতেই হবে।

সূত্রে মতে, বর্তমানে দেশের সব থেকে আলোচিত নাম স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়িচালক আবদুল মালেক। তিনি চাকরির এই দীর্ঘ সময়ে নিজ কবজায় নিয়েছিলেন ওই দপ্তরের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের। তাদের প্রভাব দেখিয়ে রাজত্ব করতেন প্রতিটি নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ও কেনাকাটার টেন্ডার সিন্ডিকেটসহ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে।

চাকরিজীবনের অধিকাংশ সময় একাধিক ডিজি, অতিরিক্ত ডিজিসহ প্রভাবশালীদের গাড়ি চালানোর কারণে মালেক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মাধ্যমে গড়ে তুলেছিলেন শক্তিশালী সিন্ডিকেট। নানা কৌশলে আয় করেন কোটি কোটি টাকা।

মালেক এসব অপকর্ম প্রকাশ্যে আশার পর গত রোববার রাজধানীর তুরাগ থানার দক্ষিণ কামারপাড়ার বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব-১। গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকেই অবৈধ পথে উপার্জিত সম্পদের তথ্য ক্রমেই বেরিয়ে আসতে থাকে।

কর্মজীবনে মালেক অবৈধ পথে অর্থ উপার্জন করলেও তার পেছনে ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রভাবশালী কর্মকর্তারা। যদিও এখনো প্রকাশ্যে আসেনি মালেক সিন্ডিকেটের সাথে যুক্তদের নাম।
স্বাস্থ্যের কোটি কোটি টাকা লুটের ঘটনায় এ সিন্ডিকেটে যারা জড়িত, তাদের অন্তত ৫০ জনের নামের তালিকা পাঠানো হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন- দুদকে। শেষ পর্যন্ত সক্রিয় মালেক সিন্ডিকেটের সবাই ধরা পড়বেন, না কি অধরা থেকে যাবেন? বর্তমান সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে হার্ড লাইনে রয়েছেন। এই সিন্ডিকেটের সকলকে শাস্তির মুখোমুখি করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র দাবি করেছে।

হার্ড লাইনে রয়েছে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। বৈশ্বিক মহামরি করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রথম থেকেই কঠোর পরিশ্রম করছেন খোদ সরকার প্রধানসহ প্রতিটি ইউনিটির কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনগুলো।

কিন্তু করোনা টেস্টের ভুয়া রিপোর্ট প্রদান, অর্থ আত্মসাতসহ নানা প্রতারণার অভিযোগে রিজেন্ট গ্রুপ ও রিজেন্ট হাসপাতাল লিমিটেডের চেয়ারম্যান সাহেদ করিম ওরফে মো. সাহেদের বিরুদ্ধে।

তিনি আওয়ামী লীগের নেতা পরিচয়ে দেশের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে লাইভ প্রোগ্রামে কথা বলতেন। অথচ একসময় বিএনপির নেতা পরিচয় দিলেও সরকার পরিবর্তনের কারণে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা পরিচয় ব্যবহার করতেন তিনি।

এছাড়াও তিনি নিজেকে কখনো অবসরপ্রাপ্ত সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা, কখনো গোয়েন্দা সংস্থার ঘনিষ্ঠ, আবার কখনো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে পরিচয় দিয়ে বেড়াতেন।

শুধু তাই নয়, কৌশলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে ছবি তুলতেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে স্পন্সর করে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করতেন।

এরপর তার হাসপাতাল, অফিস ও বাসার দেয়ালে সরকারের ক্ষমতাধর ব্যক্তি বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে তোলা ছবি বাঁধাই করে টাঙিয়ে রাখতেন। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে তোলা ছবিকে পুঁজি করেই রিজেন্ট গ্রুপের মালিক সাহেদ অপকর্ম করে বেড়াতেন।

করোনা পরীক্ষায় প্রতারণার মামলায় গত ১৫ জুলাই সাতক্ষীরার দেবহাটা সীমান্ত থেকে অবৈধ অস্ত্রসহ তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে যাদের ওপর নির্ভর করে অপরাধ জগত তৈরি করেন সাহেদ। তাদের সবাই এখনো আড়ালেই রয়ে গেছে।

গত ১২ জুলাই গ্রেপ্তার করা হয় জেকেজি হেলথকেয়ারের চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা আরিফকে। তার বিরুদ্ধে করোনা ভাইরাসের নমুনা পরীক্ষায় ভুয়া রিপোর্ট ও অর্থ জালিয়াতি অভিযোগের সত্যতা পেয়ে গ্রেপ্তার করে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

রেজিস্টার্ড চিকিৎসক হয়েও নিজের খেয়াল-খুশিমত চলা, মিথ্যাচার, অনৈতিক সুবিধা নেয়া, এমনকি অধীনস্থদের সাথে দুর্ব্যবহার করাসহ অনেক অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে সুসম্পর্ক ছিলো সাবরিনার। সেই সম্পর্কের জোরেই ক্ষমতার রাজত্ব করেছেন স্বাস্থ্য খাতের প্রতিটি ইউনিটিতে।

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে করোনার নমুনা সংগ্রহ করে ১৫,৪৬০টি ভুয়া মেডিকেল রিপোর্ট প্রস্তুত ও সরবরাহ করে ৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন তিনি। রাতারাতি কোটিপতি বনে যান। তার এসব অপকর্মে সহযোগিতা করেছেন স্বাস্থ্য ও বিভিন্ন প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি। সাবরিনার অপকর্মের ওইসব সহযোগী এখনো ধোরাছোঁয়ার বাইরে। করোনার নমুনা সংগ্রহ ও ভুয়া রিপোর্ট দেয়ায় জেলে রয়েছেন ডা. সাবরিনা।

প্রায় এক যুগ সময় ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় রয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। দলটি ক্ষমতার এই দীর্ঘ সময়ে রাজধানী থেকে শুরু করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত নানামুখী উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে দেশ ও দেশের মানুষের কাছে প্রশংসা কুড়িয়েছে।

কিন্তু ক্ষমতাসীন দলটির হাতেগোনা কিছু নেতাকর্মীর ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ডর কারণে মাঝেমধ্যেই সমালোচনার মুখে পড়তো তারা। বিশেষ করে চলতি বছরের শুরুতে নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক পাপিয়া চৌধুরী ও তার স্বামী মফিজুর রহমান চৌধুরী সুমন ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সারা দেশে বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করেন।

যুব মহিলা লীগের ওই নেত্রী রাজনীতির আড়ালে অস্ত্র, মাদক, দেহব্যবসা ও মন্ত্রী-এমপিদের দপ্তরে তদ্বির করে বিশাল সম্পদের মালিক হন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে— সরকারি দলের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রভাবশালী নেতা, মন্ত্রী, এমপিদের ছত্রচ্ছায়ায় অনৈতিক কর্যকলাপে যুক্ত ছিলেন পাপিয়া।

এই নেত্রী বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। কিন্তু তিনি আটকের দীর্ঘ সময় পার হয়ে গেলেও এখনো অধরা রয়ে গেছে পাপিয়া তৈরির গডফাদাররা। যা নিয়ে খোদ ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে।

এছাড়া গত বছর দেশের বিভিন্ন স্পোর্টস ক্লাবে অভিযানে বেরিয়ে আসে ক্যাসিনো ও জুয়া-মাদকের আখড়া। যুবলীগ নেতা, হাইব্রিড ব্যবসায়ী কাম রাজনীতিবিদ, ক্রীড়া সংগঠকসহ অনেকে গ্রেপ্তার হতে থাকে ক্যাসিনোকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে।

এরপর প্রধানমন্ত্রীর দেয়া দুর্নীতির বিরুদ্ধে ভাষণ-বিবৃতি জনমনে আশার সঞ্চার করে। তাদের আশা, প্রধানমন্ত্রী হয়তো রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন অংশে ক্যান্সারের মতো বসে থাকা দুর্নীতি খুঁজে খুঁজে বিদায় করবেন।

এরপর সারা দেশে শুরু হয় শুদ্ধি অভিযান। গ্রেপ্তার হন বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা। ক্যাসিনোকাণ্ডের ওই সময় অভিযোগ উঠেছিল, ক্যাসিনো পাড়ার অবৈধ টাকার একটি অংশ প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদে পকেটে যায়। ওই সকল মদদদাতারা এখনো রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। যদিও সেসময় অভিযুক্তদের তালিকাও তৈরি হয়েছিল। সে তালিকাও আলোর মুখ দেখেনি।সুত্র:(আমার সংবাদ)

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মে. জে. (অব.) একে মোহাম্মদ আলী শিকদার বলেছেন, একটি অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দুর্নীতি না করলে কেউ দুর্নীতি করতে সাহস পাবে না। তাই এসব অধিদপ্তরের সব দুর্নীতির জন্য প্রতিষ্ঠানের প্রধানরাই দায়ী। তারাও এগুলোর ভাগিদার।

তিনি আরও বলেন, দুর্নীতিবাজদের আশ্রয়-প্রশ্রায় দেয়া হচ্ছে। এদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। দুর্নীতির রাঘবরা আড়ালেই থেকে যাচ্ছে।

Development by: webnewsdesign.com