নারীর উত্তরাধিকার ও সমাধিকার

বৃহস্পতিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ | ১০:৩৩ অপরাহ্ণ

নারীর উত্তরাধিকার ও সমাধিকার
apps

সম্প্রতি হাইকোর্ট থেকে একটি মামলার রায় দেয়া হয় । এই রায়টিতে বলা হয়েছে যে, হিন্দু বিধবা নারীরা তার স্বামীর কৃষি জমিরও ভাগ পাবেন। এর পুর্বে শুধু মাত্র অকৃষি জমির ভাগ পেতেন। হাইকোর্টের প্রদান করা রায়ের ফলে নারীদের সমাধিকার প্রাপ্তির বিষয়টি আরো এক ধাপ এগিয়ে গেলো। ১৯৯৬ সালে খুলনার গৌরদাসী নামে এক নারী তার মৃত স্বামীর কৃষি জমির ভাগ দাবী করেন। ঐ নারীর দাবী নাকচ করে দেয় তার দেবর জ্যোতিন্দ্র নাথ মণ্ডল। গৌরদাসী জমি দখল পেতে চাইলে দেবর জ্যোতিন্দ্র মণ্ডল খুলনা জজ আদালতে একটি দেওয়ানী মামলা দায়ের করেন। জ্যোতিন্দ্র মন্ডলের দায়ের করায় মামলায় জজ আদালত হিন্দু বিধবা নারীদের স্বামীর সম্পত্তিতে অধিকার রয়েছে এই মর্মে রায় দেয়। ফলে গৌরদাসী মৃত স্বামীর কৃষি জমিরও উত্তরাধিকারী হয়ে যান। জ্যোতিন্দ্র মণ্ডল মামলাটিতে হেরে যান , এবং গৌরদাসীকে কৃষি জমি না দেয়ার উদ্যেশ্যে উচ্চ আদালতে আপীল করেন। ২০২০ সালে হাইকোর্ট জ্যোতিন্দ্র মণ্ডলের আপীলকৃত মামলাটির রায় প্রদান করে। এই রায়টিতেও বলা হয় হিন্দু বিধবা নারীরা তার স্বামীর কৃষি জমিতে উত্তরাধিকারী হবেন।

বৃটিশ শাসনামলে ১৯৩৭ সালে প্রণীত একটি আইনে হিন্দু বিধবা নারীরা স্বামীর সম্পত্তির কি কি বিষয়ে উত্তরাধিকারী হবেন তা বর্ণিত আছে। ১৯৩৭ সালের আইনানুযায়ী হিন্দু ধর্ম পালনকারী বিধবা নারীরা তার মৃত স্বামীর কৃষি এবং অকৃষি উভয় ধরনের জমির উত্তরাধিকারী হতে পারবেন। কিন্তু ধর্ম শাস্ত্রের অজুহাতে তাদেরকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হতো। শ্রাস্ত্রের পণ্ডিতদের মতে , যারা মৃত ব্যাক্তির পিণ্ডদান করার অধিকার রাখেন কেবরমাত্র তারাই তার রেখে যাওয়া সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারবেন। বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে হিন্দু ধর্ম পালনকারী বিধবা নারীরা ১৯৩৭ সালের আইনানুযায়ী তার স্বামীর সম্পত্তির অধিকারী হয়ে আসছেন। ১৯৩৭ সালে সিলেট ছিল আসাম প্রদেশের অর্ন্তগত একটি জেলা। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর এই জেলাটি পুর্ব বাংলার অন্তর্গত হয়। কিন্তু ১৯৩৭ সালের আইননুযায়ী হিন্দু ধর্মপালনকারী বিধবা নারীদের স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকার বিষয়টি এই জেলায় নির্ধারিত হয়ে আসছে। প্রচলিত দু ধরনের প্রথার বিষয়টি আশ্চর্য হওয়ার মতো কারণ একই দেশে একই ধর্মপালনকারী নারীদের ক্ষেত্রে দু রকম প্রথা। নারীদের অধিকারের বিষয়টি আইনের চেয়ে ধর্মীয় প্রথার মাধ্যমেই পরিচালিত হয়। তাই নারীরা তাদের নায্যতা থেকে বঞ্চিত। মুসলিম রীতি অনুসারে একজন বিধবা নারী তার স্বামীর সম্পত্তির কতটা পাবেন তা বর্ণিত আছে , একজন মুসলিম বিধবা নারী যদি তার স্বামীর সন্তান থাকে তাহলে পাবেন আট ভাগের এক ভাগ , আর স্বামী সন্তানহীন হলে চার ভাগের এক ভাগ। অপরদিকে স্বামী ক্ষেত্রে বলা আছে , স্বামী পাবেন স্ত্রী রেখে যাওয়া সম্পদের (যদি সন্তান থাকে) চার ভাগের এক ভাগ , আর সন্তান না থাকলে অর্ধেক। আর পৈত্রিক সম্পত্তির ক্ষেত্রে পুরুষের অর্ধেক পাবেন নারী। উল্লেখিত হিসাব অনুযায়ী দেখা যায় , উত্তরাধিকারী হিসাবে সম্পতি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে মুসলিম ধর্ম মতেও নারীরা বৈষমের শিকার। একই দেশে বসবাস করে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হওয়ার বিষয়টি নারীদের বেলায় শুধু মাত্র ভিন্নতা।

কিছু সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন, আর্ন্তজাতিক সংস্থা ও কথিত নারীবাদীরা নারীদের সমাধিকারের বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন। তারা জেন্ডার ডিসক্রিমিনেশান বলে বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলছেন। নারীদের সম্পত্তির উত্তরাধিকারীর বিষয়টি নিয়ে তাদেরকে মাঠে আওয়াজ তুলতে দেখা যায় না। বর্তমানে কিছু মানুষকে ( নারী ও পুরুষ) ঋবসরহরংঃ হতে দেখা যায় তারা কিন্তু কেউ ঐঁসধহ অপঃরারংঃ না , তারা যদি প্রকৃত হতেন ঐঁসধহ অপঃরারংঃ, তাহলে তারা সমাজ এবং ধর্মীয় রীতি যে, নারীদের নায্যতা থেকে বঞ্চিত করছে তা নিয়ে আন্দোলন করতেন বিশেষ করে সম্পত্তির উত্তরাধিকার বিষয়টি বেশী গুরুত্ব দিতেন। জেন্ডার সমতার নামে এই সংগঠন গুলো নারীদেরকে পুরুষ বিদ্বেষী করে গড়ে তুলছে। এ ধরনের কর্মসুচির মাধ্যমে বাড়ছে পারিবারিক দ্ধন্ধ সংঘাত । ফলে নারীরা তাদের প্রকৃত নায্যতা থেকে আরো বঞ্চিত। নারী এবং পুরুষের মধ্যে একটি দীর্ঘকালীন দ্ধন্ধ সৃষ্টি করতেই আজকে নারীবাদ এবং পুরুষতান্ত্রিকতা নামক তাত্ত্বিক কথাটির জন্ম । কথিত জেন্ডার সমতার কর্মসুচির দিয়ে নারীদেরকেই কৌশলে সংগ্রামী বানানোর চেষ্টা করা হয়, আর এরকম দীর্ঘকালীন নারী ও পুরুষের দ্ধন্ধে নারীদেরকে অংশ গ্রহন করানোর মাধ্যমে সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি করার একটি পরিকল্পিত প্রচেষ্টা চলছে দীর্ঘদিন থেকে। নারী ও পুরুষের এ ধরনের দ্ধন্ধ সৃষ্টির করে পরোক্ষ ভাবে নারীকে পণ্যেই রুপান্তরিত করা হয়। একজন নারীকে স্বল্প কাপড়ে রেম্পে হাটানোর মাধ্যমে নারীর সমাধিকার প্রতিষ্ঠা পায় না, বরং এ ধরনের কার্যক্রমে নারীর দৈহিক সৌষ্ঠবতা প্রদর্শিত হয়। আর এ প্রদর্শনের মাধ্যমে নারীও পণ্যেই পরিণত করা হচ্ছে। প্রতিটি পণ্যের বিজ্ঞাপনে নারীর দেহকে প্রদর্শন করা একটি নৈমিতিক বিষয় , কোন পণ্যের বিজ্ঞাপনই নারী ছাড়া হয় না। অনেক বিজ্ঞাপনে নারীর উপস্থিতিটা বিষয়বস্তুর সাথে সামঞ্জস্যহীন। অথচ নারীকে নানা ভঙ্গিমায় প্রদর্শিত করা হচ্ছে। কিছু কথিত ঋবসরহরংঃ গন নারীর রেম্পে হাটার বিষয়কেও বলে থাকেন নারী তার অধিকার পাওয়ার পথে একধাপ এগুলো। পুজিবাদী দুনিয়ায় পুজিবিকাশের এবং মুনাফা আহরণের লক্ষে নারীকেও তারা অধিকার দেয়ার নামে রাস্তায় নামিয়ে পণ্যে রুপান্তরিত করছে। পশ্চিমা বিশ্বের অর্থাযনে তৃতীয় বিশ্বে কিছু বেসরকারী সংস্থা পরিচালিত হয় ।

এই সংস্থাগুলো নারীদেরকে সমাধিকারের নামে পুরুষ বিদ্বেষী করে গড়ে তুলে। নারীদের এ রকম সমাধিকার আন্দোলনে কাজ করে কিছু পুরুষ। যারা নিজেদেরকে ঋবসরহরংঃ । এরা কিছু নারীকে হঠকারী বানিয়ে সমাজে এক ধরনের বিরোধ সৃষ্টি করছে পশ্চিমা দুনিয়ার ব্যবসায়ীদের স্বার্থে। বাংলাদেশের তথাকথিত বাঙালী নারীবাদী লেখক তসলিমা নাসরিন, তার এক লেখায় বলেছেন , পুরুষের অণ্ডকোষে কষে মারো লাথি । তসলিমা নাসরিনের পুরুষের বিশেষ অঙ্গে এই লাথির মাধ্যমে বাঙালী নারীরা কি সমাধিকার পেয়ে যাবে। তার কোন লেখায় কি, তিনি জোরালো ভাবে নারীর সম্পত্তি প্রাপ্তির আইনী বিষয়টি তুলে ধরেছেন, বা কোন প্রক্রিয়া আন্দোলন করলে নারী ও পুরুষ উভয়েই উত্তরাধিকার হিসাবে সম্পত্তির সম ভাগিদার হতে পারবেন। মানুষের সামাজিক ভীতটা গড়ার পেছনে তার সম্পদ বড় ধরনের নিয়ামক হিসাবে কাজ করে। সমাজের কোন ব্যাক্তির অবস্থান নির্ধারনের হয় সাধারনত তার সম্পদের উপর ভিত্তি করে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারীরা উত্তরাধিকার হিসাবে সম্পত্তি প্রাপ্তির বিষয়ে রয়েছে বৈষম্যতা, আর এই বৈষম্যের প্রতিফলনটা সামাজে ফুটে উঠে ফলে নারীরা সামাজিকভাবেও বৈষম্যের শিকার হন।

নারীরা অফিস আদালতে কাজ করছে এই বিষয়টি নারীর সমাধিকার আন্দোলনের ফসল, তবে এদেশে প্রাচীন কাল থেকেই কিন্তু নারীরা উৎপাদর প্রক্রিয়ার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। গ্রামের দরিদ্র নারীরা বহু যুগ আগ থেকেই কৃষি কাজ করছে , এ রকম ঘরের বাইরে কাজ করার পরও কি নারী তার সমাধিকার পেয়েছেন, বর্তমান সময়ে এসে দেখা যাচ্ছে , নারী বৈমানিক থেকে শুরু করে নানা ধরনের বিভিন্ন পেশার সম্পৃক্ত হচ্ছেন , এ ধরনের নারী পেশাজীবি হওয়ার পরও কি নারীরা সমাধিকার পাবে ? অনেকেই এ রকম পেশায় নারীর যোগদানের বিষয়টিকে সমাধিকারের এক ধাপ বলে থাকেন তবে এটা ঠিক না কারণ নারীরা এরকম পেশায় জড়িত হতে পেরেছেন নারী তার নিজস্ব যোগ্যতায়। এটা কারো দয়া বা অনুকম্পা নয়। নারী এতসব কর্ম করার পর কেন সমাধিকার পায়না না পাওয়ার মুল কারণ হলো সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া। অনেকেই বলতে পারেন, নারী অর্থ উপার্জন করে নিজের নামে সম্পদ করবে । এটা ঠিক যে অনেক নারীই অর্থ উপার্জন করে নিজের নামে সম্পদ করছেন। তবে তিনি মারা েেগল তার রেখে যাওয়া সম্পদ তারই কন্যা সন্তানটি পাবে পুত্র সন্তানের অর্ধেক। তাহলে বিষয়টি কি দাড়ালো , নারীর সামাজিক অবস্থান যে তিমির সেই তিমির থাকলো তার অবসান হলো না। এত শ্রম ঘাম নারী বিনিয়োগ করার পরও। তাই নারী যতই ঘরের বাহির হোক আর যতই উপার্জন করুক শেষ ফলাফলটি পুর্বের জায়গায় চলে যায়। শহর বা গ্রামে , উচ্চবিত্ত থেকে নিন্ম বিত্ত প্রতিটি পরিবারে নারীর অবস্থানটা দুর্বল তার মুল কারণ তার সম্পত্তি কম। নারী সমাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে নারীকে সম্পদের অধিকার প্রাপ্তির আইনী বিষয়টিতে সমাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

সম্পদে সমাধিকার প্রতিষ্ঠা না হলে সমাজে নারীর সমাধিকার প্রতিষ্ঠা পাবে না। রাষ্ট্রেীয় আইনে নারী বা পুরুষের সম্পত্তির উত্তরাধিকার হওয়ার বিষয়টি সবার সমান হওয়া উচিত । এ ক্ষেত্রে ধর্ম, বর্ণ বিষয়টিতে নির্ভর করা ঠিক না। সংবিধানে বলা আছে প্রতিটি নাগরিক সম অধিকার ভোগ করবেন, আবার অন্যদিকে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হবে ধর্মীয় রীতির নীতির মাধ্যমে। এটা কতটা কতটা রাষ্ট্রীয় সমাধিকার কথাটির সাথে সংগতিপুর্ণ তা ভেবে দেখার প্রয়োজন।

উত্তরাধিকারী হিসাবে সম্পদ প্রাপ্তির বিষয়টি সাংবিধানিক ভাবে ধর্ম র্বণ নির্বিশেষে নারী পুরুষের সমান হওয়া উচিত।

লেখক :- কলামিস্ট , শাহ মো. জিয়া উদ্দিন

Development by: webnewsdesign.com