অস্ত্র ও মাদক আইনের দুটিসহ তিন মামলায় নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের বহিস্কৃত নেত্রী শামিমা নূর পাপিয়াসহ গ্রেফতার চারজনের ৫ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। ঢাকা মহানগর হাকিম মাসুদুর রহমানের আদালত সোমবার এ আদেশ দেন।
এর আগে সোমবার দুপুরে পাপিয়াসহ ৪ আসামিকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়। তাদের প্রত্যেকের ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বিমানবন্দর থানার পুলিশ পরিদর্শক কাজী কায়কোবাদ। অপর আসামিরা হলেন পাপিয়ার স্বামী মফিজুর রহমান ওরফে সুমন চৌধুরী ওরফে মতি সুমন (৩৮), সাব্বির খন্দকার (২৯) ও শেখ তায়্যিবা (২২)। শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম মাসুদুর রহমান পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ড আবেদনের প্রতিবেদনে পুলিশ উল্লখ করে, পাপিয়াসহ চার আসামি সংঘবদ্ধভাবে অবৈধ অস্ত্র, মাদক ব্যবসা, চোরাচালান, জাল নোটের ব্যবসা, চাঁদাবাজি, তদবির বাণিজ্য, জমি দখল-বেদখল, অনৈতিক ব্যবসার মাধ্যমে বিপুল অর্থ-বিত্তের মালিক হয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন। মামলার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে এবং আসামিদের কাছ থেকে উদ্ধারকৃত বৈদেশিক মুদ্রার উৎস ও জাল টাকা তৈরি চক্রের সক্রিয় সদস্যসহ মূলহোতাকে গ্রেফতার, আসামিদের নিয়ে পুলিশ অভিযান পরিচালনা ও ঘটনার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের পুলিশ রিমান্ড একান্ত প্রয়োজন। গত শনিবার দুপুরে রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে দেশত্যাগের সময় শামীমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউসহ (২৮) চারজনকে আটক করে র্যাব-১। গ্রেফতারের পর রোববার বিকালে রাজধানীর কারওয়ানবাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাব-১ অধিনায়ক (সিও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাফী উল্লাহ বুলবুল বলেন, চাকরিপ্রত্যাশী নারীদের দেহব্যবসায় বাধ্য করতেন শামীমা নূর পাপিয়া। আর অনৈতিক কর্মের ভিডিও ধারণ করে ব্যবসায়ীদের ব্ল্যাকমেইল করতেন। এ দুই উপায়ে তিনি শত শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। অস্ত্র ও মাদক মজুদের পাশাপাশি কিউঅ্যান্ডসি নামে ক্যাডার বাহিনীও গঠন করেছেন। তিনি জানান, পুলিশের এসআই ও বাংলাদেশ রেলওয়ের বিভিন্ন পদে মানুষকে চাকরি দেয়ার কথা বলে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন র্যা বের হাতে গ্রেফতার হওয়া পাপিয়া ও তার স্বামী সুমন। শুধু তাই নয়, জমির দালালি, সিএনজি পাম্পের লাইসেন্স দেয়া, গ্যাসলাইন সংযোগের নামেও সাধারণ মানুষের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন তারা। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ব্যাংকে নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ অর্থ রেখেছেন এই দম্পতি।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে জাল টাকা বহন ও অবৈধ টাকা পাচারের অভিযোগে শামীমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউসহ চারজনকে গ্রেফতার করে র্যাব। গ্রেফতারকৃত অন্যরা হলেন- পাপিয়ার স্বামী মফিজুর রহমান ওরফে সুমন চৌধুরী ওরফে মতি সুমন (৩৮), সাব্বির খন্দকার (২৯) ও শেখ তায়্যিবা (২২)।
লে. কর্নেল শাফী উল্লাহ বুলবুল বলেন, প্রাথমিক তদন্তে ফার্মগেটে পাপিয়ার দুটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, নরসিংদী শহরে দুটি ফ্ল্যাট, দুই কোটি টাকা মূল্যের দুটি প্লট, চারটি বিলাসবহুল গাড়ি এবং গাড়ি ব্যবসায় প্রায় দেড় কোটি টাকা বিনিয়োগের তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশের ব্যাংকে নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ অর্থ গচ্ছিত থাকার কথা জানা গেছে।
র্যা বের দাবি, পাপিয়া ও তার স্বামী সুমন চৌধুরী রেলওয়ে ও পুলিশে চাকরির প্রলোভনে ১১ লাখ টাকা, একটি কারখানায় অবৈধ গ্যাস সংযোগ দেয়ার কথা বলে ৩৫ লাখ টাকা, একটি সিএনজি পাম্পের লাইসেন্স করে দেয়ার কথা বলে ২৯ লাখ টাকা নিয়েছেন বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর বাইরে নরসিংদী এলাকায় চাঁদাবাজি, মাদক ও অস্ত্র ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করেছেন তারা। র্যাব-১ এর অধিনায়ক বলেন, পাপিয়ার আয়ের অন্যতম উৎস নারীদের দিয়ে জোরপূর্বক অনৈতিক কাজ করানো। ঢাকার বিভিন্ন বিলাসবহুল হোটেলে কম বয়সী মেয়েদের অনৈতিক কাজে বাধ্য করতেন তিনি। যাদের অধিকাংশকে নরসিংদী এলাকা থেকে চাকরির প্রলোভনে ঢাকায় আনা হয়েছিল। অনৈতিক কাজে বাধ্য না হলে তাদের নানাভাবে নির্যাতন করা হতো। পাপিয়ার সঙ্গে বিশিষ্টজনদের ছবির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বর্তমানে যদি কেউ কারও সঙ্গে ছবি তুলতে চায় তা হলে বিষয়টি সাধারণত এড়ানো যায় না। তাই কারও সঙ্গে ছবি থাকা মানেই সখ্য নয়।
এদিকে পাপিয়া ও তার স্বামীসহ গ্রেফতারকৃতদের বিমানবন্দর থানায় হস্তান্তর করেছে র্যাব। তাদের আজ আদালতে তোলা হবে। তাদের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা হবে। এর মধ্যে বিশেষ ক্ষমতা আইনে একটি মামলা হয়েছে। বাকি দুটি মামলা অন্যান্য থানায় হবে।
র্যাব জানায়, যুবলীগ নেত্রী পাপিয়া পিউ নামেই বেশি পরিচিত। এই নেত্রীর প্রকাশ্য আয়ের উৎস গাড়ি বিক্রি ও সার্ভিসিংয়ের ব্যবসা। এর আড়ালে জাল মুদ্রা সরবরাহ, বিদেশে অর্থপাচার এবং অবৈধ অস্ত্র রাখাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে এসব অভিযোগের অনুসন্ধান করছিল র্যািবের একটি দল। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে শনিবার সকালে তড়িঘড়ি করে দেশত্যাগের চেষ্টা করেন পাপিয়া। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। সহযোগীসহ গ্রেফতার হন তিনি।
র্যাব কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাফীউল্লাহ বুলবুল বলেন, গাড়ির ব্যবসার আড়ালে তিনি অবৈধ অস্ত্র, মাদক ব্যবসা ও চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। সমাজসেবার নামে তিনি নরসিংদীর অসহায় নারীদের অনৈতিক কাজে লিপ্ত করে আসছিলেন। তিনি গুলশানের একটি অভিজাত হোটেলের প্রেসিডেন্ট স্যুট নিজের নামে বুক করে নানা ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপ চালিয়ে আসছিলেন।
র্যাব জানায়, পাপিয়ার স্বামীর থাইল্যান্ডে বারের ব্যবসা রয়েছে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ অস্ত্র-মাদক ব্যবসা ও চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা বিচারাধীন। তিনি স্ত্রীর মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলের অসহায় নারীদের অনৈতিক কাজে ব্যবহার করেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ২০০০ সালের দিকে নরসিংদী শহর ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক মফিজুর রহমান চৌধুরী সুমনের উত্থান শুরু। শৈশব থেকেই চাঁদাবাজি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও ব্ল্যাকমেইল ছিল সুমনের প্রধান পেশা। চতুর সুমন রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। ২০০১ সালে পৌরসভার কমিশনার মানিক মিয়াকে যাত্রা প্যান্ডেলে গিয়ে হত্যার পর তিনি আলোচনায় আসেন। এরই মধ্যে পাপিয়া চৌধুরীকে বিয়ে করেন তিনি। এর পর তিনি স্ত্রী পাপিয়াকে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করান। ২০১৪ সালের ১৩ ডিসেম্বর জেলা যুব মহিলা লীগের সম্মেলনে তৌহিদা সরকার রুনা সভাপতি ও পাপিয়া চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। গ্রেফতারের পর পাপিয়াকে যুব মহিলা লীগ থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়।
এদিকে, অস্ত্র-মাদকসহ নারী বিষয়ক অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার দায়ে গ্রেফতার নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক শামীমা নূর পাপিয়ার পরিচয় যেটাই হোক, অপরাধ অনুযায়ী তার বিচার হবে বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সোমবার সচিবালয়ে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) কান্ট্রি ডিরেক্টর মনমোহন প্রকাশের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ মন্তব্য করেন। পাপিয়ার গ্রেফতারের বিষয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘অপরাধ অনুযায়ী অপরাধী শাস্তি পাবে। সরকার দলের হোক কিংবা বাইরের হোক- কোনো অপরাধীকে পার পেয়ে যেতে দেইনি। সব অপরাধীকেই বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। পাপিয়ার পরিচয় যেটাই হোক, অপরাধী হিসেবে এবং অপরাধ অনুযায়ী বিচার হবে।’ তার (পাপিয়া) পেছনে যারা আছেন, তাদের খুঁজে বের করা হবে কি না? জবাবে তিনি বলেন, ‘অপরাধের বিচার করতে গেলে তো পেছনের লোক খোঁজা হয়-ই, হবে না কেন? তারা সামনে আসবে না, এটা মনে করার তো কোনো কারণ নেই। আমাদের সরকারের আমলে এ ধরনের বিচার প্রক্রিয়া চলেছে। বিষয়টি যখন আদালতে যাবে, তখন তো সবকিছুই আসবে।’ পাপিয়া যে অপরাধ করছেন, আপনারা কি দলীয়ভাবে সেটা বুঝতে পারেননি? এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘বুঝতে পরলে তো আর এটা হতো না।’ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাকে ধরেছে, দলীয়ভাবে তাকে অপরাধী হিসেবে শনাক্ত করা যায়নি? জবাবে কাদের বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কি সরকারের বাইরে? এ সরকারের আমলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অপরাধের জন্য যাদের গ্রেফতার করছে, শাস্তি দিচ্ছে- এটা কি সরকারের ইচ্ছার বাইরে হচ্ছে? সরকারের সায় এবং এসব বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি আছে বলেই আজকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবস্থা নিচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সেই স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। অপরাধ-অন্যায় যারাই করবে, তাদের যেটাই পরিচয় হোক তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। সেই অনুযায়ী অ্যাকশন নেয়া হচ্ছে।’ আওয়ামী লীগের নাম ব্যবহার করে অনেকে অপকর্ম করছে, দলের মধ্যে কি আরও এমন রয়েছে? তিনি বলেন, ‘আমি একটা বিষয় পরিষ্কার করে বলতে চাই, এ দেশে আগেও সরকার ছিল। ১৯৭৫ সালের পর ২১ বছর আমরা পুরোপুরি পাওয়ারে (শক্তি) ছিলাম না। পার্থক্যটা হচ্ছে, অন্যান্য সরকার অপরাধী-অপকর্মকারীদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসার বিষয়টি অবহেলা ও উপেক্ষা করেছে। তাই অপরাধীরা শাস্তি পায়নি।’ সেতুমন্ত্রী বলেন, ‘এই সরকারের আমলে কেউ যদি অপরাধ করে তার পরিচয় যদি দলীয়ও হয়, সরকারের পক্ষ থেকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে নির্দেশ দেয়া আছে, পরিচয়ই যেটাই হোক অপকর্মের জন্য যেন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়। বিচার করা হয়।’
Development by: webnewsdesign.com