কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ

বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০ | ৩:৫৩ অপরাহ্ণ

কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ
apps

১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৩। বাংলাদেশে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে স্মরণীয় একটি দিন। এ দিনে বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের শুভাগমন ঘটেছিল বাকৃবি’র সবুজ চত্বরে। ব্রহ্মপুত্রের তীরে সবুজ শ্যামল অঙ্গন ওই দিন এই মহান নেতার পদস্পর্শে মুখরিত হয়েছিল। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হ্নদয় নিংড়ানো ভালবাসা দিয়ে বরণ করেছিল প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুকে। সেদিন এখানে বঙ্গবন্ধু এক ঐতিহাসিক ভাষণ রাখেন, যা আজকের দিনে অত্যন্ত গুরুত্ব ও তাৎপর্য বহন করে।শত ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি ছুটে গিয়েছিলেন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আন্তরিক মিলন, নৈকট্য, কৃষিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে তাঁর মতবিনিময়, দিক নির্দেশনামূলক ভাষণ এবং কর্মব্যস্ততা এ দিনটিকে স্মরণীয় করে রেখেছে। আর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এটিই ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রথম ও শেষ সফর। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সেই সফর আজও কৃষিবিদদের মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছে। কৃষিবিদ সমাজ ঐতিহাসিক এ দিনটির অপরিসীম গুরুত্ব ও মর্যাদাকে স্মরণীয় করে রাখতে প্রতিবছর ‘কৃষিবিদ দিবস’ হিসাবে পালন করে থাকে।বঙ্গবন্ধুর দেয়া সেই ঐতিহাসিক ভাষণ : “মাননীয় উপাচার্য, সংসদের সদস্যবৃন্দ, ভদ্রমন্ডলী ও ভদ্র মহিলাগণ, আমার ছাত্র ভাইয়েরা ও বোনেরা- আমার আন্তরিক অভিনন্দন গ্রহণ করুন। আপনাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি, আপনারা আমাকে সুযোগ দিয়েছেন আপনাদের সঙ্গে মেশার। আমাকে কয়েকবার এখানে আসার জন্য বলা হয়েছিল, সময়ের অভাবে আর কাজের চাপে আসতে পারি নাই সেজন্য আমি দুঃখিত। অনেক আগেই আমার আসা উচিত ছিল, কিন্তু কেন যে আসতে পারি নাই তা আপনারা ভাল করেই জানেন। সে কৈফিয়ৎ আমি নাই-বা দিলাম।উপাচার্য ও সংসদের নেতৃবৃন্দ কয়েকবারই ঢাকা গিয়েছেন-বলেছেন একবার বিশ্ববিদ্যালয়ে আসুন-আমি বলেছি, আমি তো আসতে চাই, সুযোগ খুঁজছি, ময়মনসিংহ যখন যাই, নিশ্চয়ই আসব। সে প্রতিজ্ঞা আমাকে রাখতে হয়েছে আজ সকাল বেলা, যদিও আমার আরো অনেক প্রোগ্রাম রয়েছে। আপনাদের সহ-সভাপতি সশ্রদ্ধ অভিনন্দন জানিয়েছেন। আজ আমি স্মরণ করি এ বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সকল ছাত্র-কর্মী-শিক্ষকরা শহীদ হয়েছেন তাঁদের কথা। তাঁরা আমার ডাকে সাড়া দিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের মোকাবেলা করেছিলেন। যাঁরা আজ চলে গেছেন তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। তাঁরা যে ত্যাগ দেখিয়ে গেছেন সে আদর্শের দিকে নজর রেখে শিক্ষা গ্রহণ করে যেন আমরা আমাদের জীবন পথে অগ্রসর হই। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছি। সবুজ বিপ্লবের কথা আমরা বলছি। যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশের যে অবস্থা, সত্য কথা বলতে কি- বাংলার মাটি, এ উর্বর জমি বার বার দেশ বিদেশ থেকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে ও শোষকদের টেনে এনেছে এই বাংলার মাটিতে। এত উর্বর এত সোনার দেশ যদি বাংলাদেশ না হতো তবে এতকাল আমাদের পরাধীন থাকতে হতো না। যেখানে মধু থাকে সেখানে মক্ষিরা উড়ে আসে। সোনার বাংলার নাম আজকের সোনার বাংলা নয়-বহু দিনের সোনার বাংলা। বাংলার মাটির মত মাটি দুনিয়ায় খুঁজে পাওয়া যায় না, বাংলার সম্পদের মত সম্পদ দুনিয়ায় পাওয়া যায় না। সে জন্য শোষকের দল বার বার বাংলার উপর আঘাত করেছে এবং তারা তাদের শক্তি দিয়ে বাংলাকে দখল করে রেখেছে।দু’শত বৎসরের ইংরেজ শাসনে আমরা কি দেখতে পেয়েছি? যাঁরা ইতিহাসের ছাত্র আছে তাঁরা জানেন যে, যখন ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলাদেশকে দখল করে নেয় তখন কোলকাতাকে ভারতবর্ষের রাজধানী করা হয়েছিল বাংলাকে শোষণ করার জন্য। যখন আপনারা মিউজিয়ামে যান বা লাইব্রেরিতে পড়েন তখন দেখতে পারেন-এ বাংলার সম্পদ দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল বম্বে শহর, মাদ্রাজ, কলকাতা শহর- সে ইতিহাসের দিন চলে গেছে। ইংরেজ ২০০ বৎসর শাসন করেছে, বাংলার সম্পদ বাংলা থেকে চলে গেছে- বাংলার পাট, বাংলার চা, বাংলার চামড়া, বাংলার অন্যান্য সম্পদ লুট হয়েছে, সেই ইতিহাস গেল-তারপর দুর্ভাগ্যের ইতিহাস এলো ২৪ বৎসর আগে।জানতাম না, বুঝতাম না, তোমাদের মত যুবক ছিলাম, চোংগা নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিলাম- রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছি। ১৯৩৮ সালে প্রথম জেলে যাই- সেদিন এ দেশকে স্বাধীন করার স্বপ্ন দেখেছিলাম- কি স্বাধীনতা ২৫ বৎসর আগে পেলাম-হায়, এখন তা বুঝতে পেরেছি, স্বাধীনতা পেলাম না, গোলামী পেলাম- নতুন গোলামী, সাদা গোলামীর জায়গায় পেলাম কালো গোলামী। বাংলাদেশকে বাজার করা হলো, বাংলার সম্পদকে লুট করা হলো।১৯৪৭ সালের ইতিহাস যদি আপনারা জানেন- সেদিন যখন ভারতবর্ষ ভাগ হয়েছিল বাংলাদেশ দুর্ভাগ্যের চাপে পশ্চিম পাকিস্তানের লেজুড় হয়েছিল। সেদিন থেকে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা যা আয় হতো, তা হতো পাকিস্তানের আয় বাংলাদেশ আয় করতো শতকরা ৭০ ভাগ আর পশ্চিম পাকিস্তান আয় করতো শতকরা ৩০ ভাগ। একথা অস্বীকার করবার উপায় আজ তাদের নাই। বহুদিন যাবত এ সত্য গোপন রেখেছিল, কিন্তু আমাদের মত কয়েকজন হতভাগার জন্য তা পারে নাই। ৭০ ভাগ বাংলাদেশ আয় করতো, কিন্তু বাংলাদেশে ব্যয় হতো ৩০ ভাগ এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় হতো ৭০ ভাগ।গত ২৫ বৎসর থেকে বাংলাদেশের খাদ্য ঘাটতি কমপক্ষে ১৬ লক্ষ টন। কিন্তু এ খাদ্য ঘাটতি পূরণের জন্য অতীতে কোন বন্দোবস্ত করা হয়নি। অনেকে এসেছেন, নতুন কথা বলেছেন- শুধু আমাদের সম্পদকে লুট করা নয়, আমাদের কাঁচামাল বিক্রি করে পশ্চিম পাকিস্তানকে উন্নত করা হলো। বাংলাকে মর্টগেজ রেখে পশ্চিম পাকিস্তানে আমার অর্থে গড়ে উঠলো করাচী, আমার অর্থে গড়ে উঠলো লাহোর, হায়দরাবাদ, ইসলামাবাদ। অর্থ কোথা থেকে এলো, কিভাবে এলো আপনারা জানেন এ ইতিহাস অনেক বলা হয়েছে আমি আর বলতে চাই না। তারপর স্বাধীনতা সংগ্রাম- সে ইতিহাসও আপনারা জানেন।বার বার আঘাত করার চেষ্টা করেছি, বার বার বাংলাদেশে আলবদর-রাজাকার পয়দা হয়েছে অন্যান্য নামে, পারি নাই- ষড়যন্ত্রের আসামী হয়েছি, আঘাত করার চেষ্টা করেছি, প্রত্যাঘাত পেয়েছি; আবার উঠেছি, আবার সংগ্রাম করেছি, দীর্ঘ সংগ্রাম চলেছে। অনেকে সে ইতিহাস জানেন না, সে ইতিহাসের খবর রাখেন না- সময় আসলে সে ইতিহাস আমি লিখব, আপনারা পাবেন এবং কিছু কিছু আপনারা বুঝতে পারেন।আজ বাংলাদেশের অবস্থা বড় শোচনীয়। যাওয়ার পূর্বে তারা সমস্ত সম্পদ লুট করে নিয়ে গেছে। আমার দুধের বাচ্চাকে হত্যা করেছে, তা নয়। বাংলাদেশে যাঁদেরকে বুদ্ধিজীবী বলা হয় তাঁদেরকে হত্যা করার বিরাট ষড়যন্ত্র তারা নেয়। দুনিয়ার কোনদিন কোন ইতিহাসে এরকম দেখা যায় নাই যে, বেছে বেছে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়।হিটলার পড়েছি, মুসোলিনী পড়েছি, আপনারা অনেক ইতিহাস পড়েছেন। হিটলার বেঁচে থাকলে হয়তো আজকে লজ্জায় মাথা নত করতো। পশ্চিম পাকিস্তানীরা ১৫০ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছে। তিন দিনের মধ্যে আত্মসমর্পণের পূর্বে কার্ফু দিয়ে বেছে বেছে হত্যা করেছে। তার পেছনে বিরাট ষড়যন্ত্র ছিল, যাতে এদেশ আর মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। নৃঃশংসভাবে তাঁদেরকে হত্যা করেছে। গুলি করে হত্যা করত, আঘাত করে হত্যা করত, কোন দুঃখ ছিল না। চোখের ডাক্তারের চোখ উঠিয়ে নিয়ে হত্যা করেছে, হার্টের ডাক্তারের কলিজা উঠিয়ে নিয়ে হত্যা করেছে, সাংবাদিকদের হাতের আঙ্গুল কেটে কেটে হত্যা করেছে, বৈজ্ঞানিকদের মাথার মগজ বের করে হত্যা করেছে- মানুষ এমন পশু হতে পারে জানতাম না।

Development by: webnewsdesign.com