রপ্তানি সংকটে থাকা চামড়া খাত এবার মহাসংকটে পড়েছে। করোনাভাইরাসের প্রভাবে চীননির্ভর চামড়া রপ্তানির বাজার বন্ধ হয়ে গেছে। এতে ট্যানারিগুলোতে চামড়ার মজুদ বেড়ে ৭০ লাখ বর্গফুটে পৌঁছেছে। এর রপ্তানিমূল্য প্রায় ১২০ কোটি টাকা।
এ ছাড়া ভাইরাসের কারণে অন্য বাজারেও খারাপ অবস্থা যাচ্ছে। আগে থেকেই সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়া শিল্পনগরী পরিবেশবান্ধব চামড়া উৎপাদন না হওয়ায় ইউরোপের ক্রেতারা চামড়া কিনছে না। ইউরোপের বাজার বন্ধের পরে চীনের বাজারেই ৬৫ শতাংশ ফিনিশড চামড়া রপ্তানি হতো। এখন চীনে করোনাভাইরাসের প্রভাব দীর্ঘায়িত হলে দেশের চামড়া খাত পুরোপুরি স্থবির হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের শেষ ছয় মাস চীনের বাজার চালু থাকলে দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি চামড়া রপ্তানি হতো। এখন এই চামড়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় ব্যবসায়ীরা।
লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি ও পিকার্ড বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ফিনিশড লেদারের সিংহভাগ চীনে রপ্তানি হয়। করোনাভাইরাসের কারণে চীনে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে।
আগামী ১৭ ফেব্রুয়ারি চীনে কলকারখানা খোলার কথা। এই ভাইরাসের প্রভাবে নির্দিষ্ট পরিমাণ চামড়া ও চামড়াপণ্য রপ্তানি কমে যাবে। এ ছাড়া চামড়াপণ্য তৈরির নানা উপাদান চীন থেকে আসে। এখন আমদানি বন্ধ থাকায় চামড়াপণ্য উৎপাদনেও দেরি হচ্ছে।
বিশ্বজুড়ে এখন মহামারি আকার ধারণ করা করোনাভাইরাসের প্রভাব সব বাজারে পড়বে।বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ মাহিন সমকালকে বলেন, পরিবেশবান্ধব চামড়া উৎপাদনের লক্ষ্যে শিল্প স্থানান্তর হলেও শেষ পর্যন্ত অপরিকল্পিতভাবেই হয়েছে। এ কারণে ইউরোপের বাজার হারাতে হয়েছে। এর পরে চামড়া খাতে রপ্তানির বড় বাজার ছিল চীন। একক দেশ হিসেবে চীনে ৬৫ শতাংশ চামড়া ও চামড়াপণ্য রপ্তানি করা হয়।
এখন করোনাভাইরাসের কারণে যেসব ঋণপত্র, রপ্তানি আদেশ ও পণ্য সরবরাহ আদেশ পাওয়ার কথা তা আসেনি। তার প্রতিষ্ঠান আরএমএম লেদারের ছয় কোটি টাকার চামড়া যায়নি। একই সঙ্গে অ্যাপেক্স, বে, ঢাকা হাইড, ভুলুয়া ও রিলায়েন্সসহ বড় ট্যানারিগুলো রপ্তানি করতে না পারায় মজুদ বাড়ছে। তিনি বলেন, চীন পণ্যের দাম তেমন ভালো দেয়নি। ইউরোপের বাজার বন্ধ হওয়ার পরে এ খাত বেঁচে থাকার ভরসা ছিল চীন। এখন করোনাভাইরাসের কারণে ওই বাজার হারাতে হচ্ছে। এতে ব্যবসায়ীরা আবারও মহাসংকটে পড়েছেন। ইতোমধ্যে ১০ থেকে ১৫টি মাঝারি ট্যানারি বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে বেশিরভাগ ট্যানারি চালানোর মতো অবস্থা থাকবে না। এ অবস্থায় ব্যাংকিং আইন অনুযায়ী ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হবে না। এতে বেশিরভাগ ট্যানারি মালিক খেলাপি হবেন। একের পর এক এভাবে চামড়া খাত ধাক্কা খেলে টিকে থাকা কঠিন হবে। এ জন্য এখনই সরকারের নীতি সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো ও অ্যাসোসিয়েশনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ট্যানারি স্থানান্তরের পর থেকেই টানা কমছে রপ্তানি। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৮৮ কোটি ৩১ লাখ ডলারের চামড়া পণ্য ও ২৭ কোটি ৭৯ লাখ ডলারের পাদুকা মিলে মোট ১১৬ কোটি ১০ লাখ ডলারের রপ্তানি হয়। পরের বছরে তা বেড়ে ১২৩ কোটি ৪০ লাখ ডলারে পৌঁছে। ওই বছর চামড়া বর্ষ পণ্য ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই বছর পাঁচ বিলিয়ন ডলারের চামড়াপণ্য রপ্তানির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু এর পরে চামড়াশিল্প পরিবেশবান্ধব না হওয়ায় রপ্তানি কমছে।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১০৮ কোটি ৫৫ লাখ ডলারের চামড়া ও চামড়াপণ্য রপ্তানি হয়। গত অর্থবছরে তা আরও কমে প্রায় ১০২ কোটি ডলারে নেমেছে। চলতি অর্থবছরের সাত মাসে (জুলাই থেকে জানুয়ারি) ৫৫ কোটি ৮৯ লাখ ডলারের চামড়া পণ্য রপ্তানি হয়েছে। মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, একের পর এক চামড়া খাতে এমন অবস্থার মুখে পড়লে রপ্তানির লক্ষ্য অর্জন তো দূরের কথা, উল্টো কমবে। তিনি বলেন, চীনের পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে চামড়া রপ্তানি অর্ধেকের বেশি কমে যাবে। এ ক্ষেত্রে টিকে থাকতে নীতিনির্ধারকদের সহায়তা প্রয়োজন।বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, সাভারে চালু থাকা ১২৩টি ট্যানারির মধ্যে বেশিরভাগই চীনে চামড়া রপ্তানি করে। ভাইরাসের প্রভাবে চীনে রপ্তানি বন্ধ থাকায় ট্যানারিগুলোতে ৭০ লাখ বর্গফুট চামড়া মজুদ হয়ে গেছে। কারণ চীনের ক্রেতারা ট্যানারি চামড়া পরিদর্শনে আসতে পারছেন না। আর কবে আসবেন তার নিশ্চয়তা নেই। ফলে ট্যানারিগুলোতে এখন উৎপাদন প্রায় বন্ধ হয়ে পড়েছে। চামড়া শিপমেন্ট না হওয়ায় ট্যানারিগুলো আর্থিক সংকটে পড়ছে। এতে ঋণের সুদ বাড়ছে। কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে বেশিরভাগ ট্যানারি খেলাপি হবে। তিনি বলেন, চামড়া খাতে পরিবেশ দূষণের দায়ে ভালো ক্রেতা হারাতে হয়েছে। এখন দুর্বল ক্রেতাদেরও হারাতে হচ্ছে। এ মহাসংকট উত্তরণে সরকারের নীতিসহায়তা দরকার। যতদিনে পরিবেশবান্ধব চামড়া উৎপাদনে যাওয়ার প্রস্তুতি বিসিক শেষ করতে না পারবে, ততদিন পর্যন্ত ব্যাংক ঋণে বিশেষ সুবিধা চান উদ্যোক্তারা।
ভূলুয়া ট্যানারির চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল সমকালকে বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে মহাসমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন চামড়া খাতের উদ্যোক্তারা। চীনা ক্রেতারা অর্ডার দিয়ে গেছে। ট্যানারি মালিকরা চামড়া প্রস্তুত করে বসে আছেন। কিন্তু সরবরাহ করতে পারছেন না। অনেক ক্রেতা দেশে আসার কথা জানিয়েও আসছেন না। তার ট্যানারিতে পাঁচ লাখ বর্গফুট চামড়া মজুদ রয়েছে। তিনি বলেন, চীন ছাড়া অন্য বাজারের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের বাজারেও রপ্তানি কমেছে। সার্বিকভাবে এখন চামড়া খাতে ধস নেমেছে।রিলায়েন্স ট্যানারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শাহজাহান মিয়া বলেন, খারাপ অবস্থায় থাকা চামড়া খাত আরও খারাপ অবস্থায় পড়েছে। প্রায় সব ট্যানারি চীনে চামড়া রপ্তানিনির্ভর। সবাই এখন চামড়া প্রস্তুত করে বিপাকে পড়েছে। চীনা নববর্ষের ছুটির পরে দেশটির ক্রেতাদের আসার কথা ছিল। তারা আসতে পারেননি। উল্টো রপ্তানি আদেশ দেওয়া পণ্য নিতে পারছেন না। তার ট্যানারিতে পাঁচ লাখ বর্গফুটের বেশি প্রস্তুত করা চামড়া মজুদ হয়ে পড়েছে। এখন কোনো অর্ডারও নেই। এ কারণে নতুন করে আর চামড়া প্রক্রিয়া করছেন না তারা। এ ছাড়া বড় আরেকটি ট্যানারি ঢাকা হাইডেও প্রায় ১২ কোটি টাকার চামড়া মজুদ থাকার কথা জানা গেছে।
অ্যাপেক্স ট্যানারির নির্বাহী পরিচালক এম এ মাজেদ বলেন, চামড়া রপ্তানির বাজার আগে থেকেই খারাপ ছিল। এখন ভাইরাসের কারণে আরও খারাপ যাচ্ছে। কিছুদিন এমন থাকলে আরও সংকটে পড়তে হবে। বিশেষ করে চীন থেকে চামড়াপণ্য তৈরির নানা উপকরণ আমদানিতে সমস্যায় পড়তে হবে। এর ফলে রপ্তানিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে।
Development by: webnewsdesign.com