আমদানি ঋণপত্রের বিপরীতে বিলের মূল্য বা এলসি দায় পরিশোধে অনাকাঙ্ক্ষিত দেরি করছে কিছু ব্যাংক। এতে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে দেশের। বিষয়টি নিয়ে এতদিন মৌখিকভাবে সতর্ক করে আসছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এতেও পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় এলসি দায় পরিশোধে ব্যর্থ ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের হুঁশিয়ারি দিয়ে গতকাল প্রজ্ঞাপন জারি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
আমদানি দায় পরিশোধে ব্যাংকগুলোর ব্যর্থতার সূত্রপাত প্রায় তিন বছর আগে। বাজারে ডলার সংকটের কারণে এ সমস্যা দেখা দেয় তখন। বর্তমানে ডলারের সংকট অনেকাংশেই কেটে গেছে। তার পরও নির্ধারিত সময়ে আমদানি দায় পরিশোধ করছে না কোনো কোনো ব্যাংক। এ নিয়ে দেশের শীর্ষ আমদানিকারক দেশগুলোর দূতাবাস থেকে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে কয়েক দফায় অভিযোগও জানানো হয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতেই দেশের বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেনে নিয়োজিত ব্যাংকগুলোকে সতর্ক করল বাংলাদেশ ব্যাংক।
গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগ থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘কোন কোন তফসিলি ব্যাংক আমদানি ঋণপত্রের বিপরীতে বিলের মূল্য পরিশোধে অনাকাঙ্ক্ষিত বিলম্ব করছে মর্মে বাংলাদেশ ব্যাংকের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। আমদানি মূল্য পরিশোধ না করা বা অনাকাঙ্ক্ষিত বিলম্ব করার ফলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। একই সঙ্গে বিলম্বের জন্য সুদ পরিশোধসহ ঋণপত্রে বিদেশী ব্যাংকের কনফার্মেশন বাবদ ব্যয় বৃদ্ধি আমদানিকে ব্যয়বহুল করছে। আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি প্রত্যক্ষভাবে বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যে অধিকতর নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করছে।’
এ অবস্থায় যথাসময়ে আমদানি দায় পরিশোধের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট নির্দেশনা ও বিধিগুলো যথাযথভাবে পরিপালন নিশ্চিত করার জন্য সব অনুমোদিত ডিলার ব্যাংকের শাখাকে নির্দেশনা দিতে শীর্ষ নির্বাহীদের পরামর্শ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেই সঙ্গে যথানিয়মে আমদানি দায় পরিশোধের ক্ষেত্রে ব্যত্যয় পরিলক্ষিত হলে সংশ্লিষ্ট অনুমোদিত ডিলার শাখার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও সতর্ক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
যথাসময়ে আমদানি দায় পরিশোধে ব্যর্থ ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের হুঁশিয়ারিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরফান আলী। তিনি বলেন, আমরা চাই ব্যাংকগুলো যথাসময়ে আমদানি দায় পরিশোধ করুক। এক্ষেত্রে সব ব্যাংককেই নির্দিষ্ট মানদণ্ড অনুসরণ করা দরকার। আমদানি দায় যথাসময়ে পরিশোধ না করাটা দেশের সুনামের জন্যও ক্ষতিকর। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক যে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে, সেটি অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।
দেশের আমদানি বাণিজ্যে এখন শ্লথগতি চলছে। তার পরও নির্ধারিত সময়ে আমদানি দায় পরিশোধে ব্যাংকগুলোর ব্যর্থতাকে উদ্বেগজনক বলছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-নভেম্বর) আমদানি কমছে ৫ দশমিক ২৬ শতাংশ। এ সময়ে মোট ২ হাজার ৩৯৯ কোটি ৬০ লাখ ডলারের পণ্য ও মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে শুধু নভেম্বরেই আমদানি ১৩ দশমিক ৫৬ শতাংশ কমেছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরেও আমদানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ১ দশমিক ৭৮ শতাংশ।
ব্যাংকগুলো কেন নির্ধারিত সময়ে আমদানি দায় পরিশোধ করতে পারছে না, এমন প্রশ্নের উত্তরে দুটি মৌলিক কারণের কথা বলেছেন প্রাইম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাহেল আহমেদ। তার মতে, গ্রাহকের ক্যাশ-ফ্লো ঘাটতি থাকলে অনেক সময় ব্যাংককে টাকা পরিশোধে গড়িমসি করেন। ফলে ব্যাংকও আমদানি দায় পরিশোধ করতে কিছুটা বিলম্ব করে। আবার কিছু ক্ষেত্রে আমদানিকারক পণ্য সরবরাহকারীর সঙ্গে বিরোধে জড়ান। কাঙ্ক্ষিত পণ্য কিংবা পণ্যের মানে ঘাটতি থাকলে গ্রাহকরা দায় পরিশোধ কিছুটা পেছানোর দাবি করেন। এ কারণেও অনেক ক্ষেত্রে নির্ধারিত সময়ে আমদানি দায় পরিশোধ করা সম্ভব হয় না। তবে ব্যাংকগুলোকে নির্দিষ্ট সময়ে আমদানি দায় পরিশোধের বিষয়ে সতর্ক থাকা দরকার। যথাসময়ে এলসি দায় পরিশোধ না হলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সুনাম ক্ষুণ্ন হবে। ফলে এলসি কমিশনও বেড়ে যাবে।
Development by: webnewsdesign.com