আগামী ১ জুলাই থেকে নিয়োগ পাওয়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সর্বজনীন পেনশন ‘প্রত্যয়’ স্কিমে যুক্ত করার নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। কিন্তু এ ঘোষণার পর থেকে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের ডাকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির ব্যানারে আন্দোলনে নেমেছেন শিক্ষকরা। সরকার যেখানে ২০২৫ সালের ১ জুলাই থেকে নিয়োগ পাওয়া সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও সর্বজনীন পেনশনে যুক্ত করার নির্দেশনা দিয়েছে, সেখানে শিক্ষকদের এই অনীহা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
সর্বজনীন পেনশন শিক্ষকদের কাছে কেন পছন্দ নয়, সে বিষয়ে বেশ কিছু যুক্তি তুলে ধরেছে ফেডারেশন। তারা বলছে, এ পেনশন স্কিম বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা কর্তনের মাধ্যমে শিক্ষকসমাজের মর্যাদা হনন, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও মনস্তাত্ত্বিক সংকট তৈরির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এতে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশার প্রতি আগ্রহী হবেন না। যদি কোনো শিক্ষক উচ্চতর পদে সরাসরি বা নতুন নিয়োগ পান, তাহলে তাঁকে বিদ্যমান পেনশনব্যবস্থা ত্যাগ করে সর্বজনীন পেনশনে যুক্ত হতে হবে, যা তাঁর বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
জানতে চাইলে ফেডারেশনের মহাসচিব ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মো. নিজামুল হক ভূঁইয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের দাবির ব্যাপারটি আমরা শিক্ষামন্ত্রী, উপদেষ্টা, প্রতিমন্ত্রীসহ প্রায় সবাইকেই জানাতে চেষ্টা করেছি।
কিন্তু তাঁরা কেউ আমাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলেননি। তাই আমাদের আন্দোলনে যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই। শিক্ষকদের তো আর কিছু নেই, আছে শুধু আত্মমর্যাদা। এখন আমরা মনে করি, বর্তমান প্রক্রিয়ায় সর্বজনীন পেনশনে যুক্ত হলে শিক্ষকরা বঞ্চিত হবেন, বৈষম্যের শিকার হবেন।
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও আগামী বছর থেকে সর্বজনীন পেনশনে যুক্ত করা হচ্ছে, তাহলে আপনাদের কেন অনীহা—এ প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক মো. নিজামুল হক ভূঁইয়া বলেন, ‘তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদেরও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে আগামী বছর থেকে যুক্ত করা হোক। এর আগে দেখতে হবে সরকারি কর্মচারীরা কী ধরনের সুবিধা পাবেন, আর আমরা কী ধরনের সুবিধা পাব? সব বিশ্লেষণ করতে হবে, আমাদের সঙ্গে বসতে হবে। এরপর সবার সম্মতিতে তা আগামী বছর থেকে শুরু করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।’
এদিকে সর্বজনীন পেনশনের ‘প্রত্যয় স্কিম’ বাতিলের দাবিতে আজ মঙ্গলবার থেকে আগামী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তিন দিন অর্ধদিবস কর্মবিরতি ও আগামী ৩০ জুন রবিবার পূর্ণদিবস কর্মবিরতির ডাক দিয়েছে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন। তবে চলমান পরীক্ষাগুলো এ কর্মসূচির আওতামুক্ত থাকবে।
এর পরও দাবি আদায় না হলে আগামী ১ জুলাই থেকে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালিত হবে বলে জানিয়েছেন সংগঠনটির নেতারা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি এ ব্যাপারে বেশ কিছু যুক্তি তুলে ধরেছে। তাদের মতে, একজন শিক্ষক যদি পাঁচ হাজার টাকা হিসাবে ৩৫ বছর প্রত্যয় স্ক্রিমে টাকা জমা রাখেন, তাহলে অঙ্কটা দাঁড়ায় ২১ লাখ টাকা। কিন্তু বিদ্যমান পেনশনব্যবস্থায় চাকরি জীবনে পেনশন খাতে কর্তনের পরিমাণ শূন্য। একজন অধ্যাপক বিদ্যমান ব্যবস্থায় এককালীন আনুতোষিক পান ৮০ লাখ টাকার ওপরে। কিন্তু সর্বজনীন পেনশনে তা নেই। তবে বর্তমানে একজন অধ্যাপক মাসিক পেনশন পান প্রায় ৪৫ হাজার টাকা। কিন্তু প্রত্যয় স্কিমে তিনি পাবেন এক লাখ ১৩ হাজার টাকা। তবে যার অর্ধেক ৬২ হাজার টাকা নিজের বেতন থেকে কর্তনের জন্য পাবেন।
শিক্ষক সমিতি তাদের যুক্তিতে বলে, বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থায় পেনশনার ও নমিনি আজীবন পেনশন পান। কিন্তু প্রত্যয় স্কিমে পেনশনার আজীবন পেনশন পেলেও তাঁর মারা যাওয়ার পর নমিনি ৭৫ বছর পর্যন্ত পেনশন পাবেন। এতে নমিনি বৃদ্ধ বয়সে একটা ঝুঁকির মধ্যে পড়বেন। বিদ্যমান পেনশনে ৫ শতাংশ হারে বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হয়। এ ছাড়া চিকিৎসা ভাতা, বছরে দুটি উৎসব ভাতা, একটি বৈশাখী ভাতা দেওয়া হয়, যা সর্বজনীন পেনশনে নেই। বিদ্যমান পেনশনে অর্জিত ছুটি অবসরকালীন জমা থাকলে তার পরিবর্তে অর্থ প্রদানের ব্যবস্থা ও এলপিআর সুবিধা থাকে। কিন্তু সর্বজনীন পেনশনে এ ব্যাপারগুলো নেই। বিদ্যমান পেনশনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ ৬৫ বছর, কর্মকর্তাদের ৬২ বছর ও কর্মচারীদের ৬০ বছর। কিন্তু সর্বজনীন পেনশনে অবসরকালীন বয়স ধরা হয়েছে ৬০ বছর। ফলে বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থা সর্বজনীন পেনশনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাই তা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
‘প্রত্যয়’ স্কিম নিয়ে জারি করা প্রজ্ঞাপন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তির তথ্যানুযায়ী, আগামী ১ জুলাই বা তার পরে স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থার চাকরিতে যাঁরা যোগদান করবেন, তাঁদের বাধ্যতামূলকভাবে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় প্রত্যয় স্কিমে যুক্ত করা হবে।
Development by: webnewsdesign.com