আবদুল্লাহ আল মিরাজ
>> বাল্যবিয়ে ও দেরিতে সন্তান নেওয়ার কারণে জন্মগত ত্রুটি নিয়ে শিশু জন্ম নিচ্ছে
>> জন্মগত ত্রুটি রোধে প্রয়োজন জনসচেতনতা
প্রতিনিয়ত বাড়ছে জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্ম নেওয়া শিশুর সংখ্যা। শিশুর জন্মগত ত্রুটির কিছু রোগের লক্ষণ দেখা যায়। আবার কিছু রোগ চিকিৎসকের দ্বারা বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা ছাড়া বোঝা যায় না। শিশুমৃত্যুর চতুর্থ কারণ হিসেবে জন্মগত ত্রুটিকে বিবেচনা করা হয়।
প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় দুই লাখ ৭০ হাজার শিশু মারা যায় জন্মগত ত্রুটির কারণে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে পৃথিবীব্যাপী জন্মগত ত্রুটির হার প্রতি ১০০ জনে ৩ থেকে ৬ শতাংশ। বিশ্বে প্রতি ৩৩ জন শিশুর মধ্যে ১ জন জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মায়। সারাবিশ্বের মধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জন্মগত ত্রুটির প্রবণতা সবচেয়ে বেশি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) তথ্যে জানা যায়, দেশে যেসব শিশু জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যা নিয়ে জন্মায়। এরপর হৃদযন্ত্র, কিডনি, জননেন্দ্রিয়, ক্ষুদ্রান্ত্র-বৃহদন্ত্র, হাত-পা, ঠোঁট ও তালুর সমস্যা নিয়েও দেশে অনেক শিশুর জন্ম হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, জন্মগত ত্রুটি নিয়ে শিশু জন্মানোর অনেক কারণ থাকতে পারে। তবে রিস্ক ফ্যাক্টর যাদের মাঝে থাকে তাদের শুরু থেকেই সতর্কতা প্রয়োজন। এছাড়া যেসব রিস্ক ফ্যাক্টর আছে তা এড়িয়ে চলা ভালো।
শিশুদের জন্মগত ত্রুটি প্রতিরোধে ও মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধিতে আজ রোববার (৩ মার্চ) পালিত হচ্ছে বিশ্ব জন্মগত ত্রুটি দিবস। ২০১৫ সাল থেকে বাংলাদেশে দিবসটি পালন করা হচ্ছে। এবারের প্রতিপাদ্য ‘প্রতিটি যাত্রা মূল্যবান’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ১১টি দেশের সমন্বয়ে গঠিত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক সায়মা ওয়াজেদ পুতুল বিশ্ব জন্মগত ত্রুটি দিবস উপলক্ষে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
বাংলাদেশের জন্মগত ত্রুটি নিয়ে পূর্ণাঙ্গ কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে বর্তমানে সরকারের অর্থায়নে বিএসএমএমইউতে ভর্তি গর্ভবতী মায়েদের ওপর একটি জরিপ চালানো হচ্ছে।
জানা যায়, ২০২৩ সালে বিএসএমএমইউতে চিকিৎসা নিতে আসা নবজাতক শিশুদের মধ্যে ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশের শরীরে জন্মগত ক্রটি শনাক্ত হয়েছিল। বিএসএমএমইউয়ের নবজাতক বিভাগে ২০২৩ সালে চিকিৎসা নিতে আসা এক হাজার ৭৬৩ শিশুর মধ্যে ১৭৮ জনের (৯. ৮৬%) জন্মগত ক্রটি শনাক্ত হয়েছিল। ওই শনাক্ত শিশুদের মধ্যে ১২ শতাংশের মৃত্যু হয় জন্মের ২৮ দিনের মধ্যে। এর আগে ২০১৫ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এই বিভাগে চিকিৎসা নেওয়া ৭ থেকে ৯ শতাংশেরই জন্মগত ত্রুটি পাওয়া যায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সন্তান মায়ের গর্ভে আসার তিন মাসের মধ্যেই বেশির ভাগ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তৈরি হয়ে যায়। জন্মের পূর্বে ভ্রুণ অবস্থায়, জন্মের সময়, অথবা জন্মের পর যেকোনো সময়ে শিশুর শরীরে এই ত্রুটি দেখা দিতে পারে। তবে অধিকাংশ ত্রুটি জন্মের প্রথম বছরের মধ্যেই দেখা যায়। কিছু ত্রুটি সহজেই চোখে ধরা পড়ে, আবার কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ধরা পড়ে। তাই গর্ভকালীন মায়ের যত্ন নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বিএসএমএমইউয়ের নিওনেটোলজি (নবজাতক) বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সঞ্জয় কুমার দে জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশে এখন হাসপাতাল ডেলিভারি হচ্ছে ৬৭ থেকে ৬৮ শতাংশ। আবার ৩০ শতাংশের কিছু বেশি ডেলিভারি বাসা বাড়িতে হচ্ছে। সেখানেও যে জন্মগত ত্রুটি নিয়ে কেউ জন্মায়নি তা বলা যাবে না। সারাদেশে কত জন শিশু নতুন করে জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মাচ্ছে তার পুরোপুরি তথ্য নেই। তবে গবেষণার জন্য প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া বরাদ্দ থেকে আমরা একটা বাজেট পেয়েছি। এর আওতায় আমাদের একটি জরিপ চলমান আছে যা দুই মাস পর ঘোষণা করা হবে।
তিনি বলেন, বিএসএমএমিউতে ৮ থেকে ৯ শতাংশ শিশু জন্ম নিচ্ছে জন্মগত ত্রুটি নিয়ে। তবে এতে দেশের মূল চিত্র উঠে আসে না। বিএসএমএমইউতে রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ার বড় কারণ এখানে উচ্চ ঝুঁকির গর্ভবতী মায়েরা ভর্তি হয়ে থাকেন। এছাড়া বারডেম হাসপাতালে ডায়াবেটিস আক্রান্ত গর্ভবতীরা ভর্তি হন। ডায়াবেটিস থাকলে শিশুর জন্মগত ত্রুটি থাকার শঙ্কা বেশি থাকে। এজন্য এই দুই প্রতিষ্ঠানে ত্রুটি নিয়ে জন্ম নেওয়া শিশুর সংখ্যা বেশি।
সঞ্জয় কুমার দে বলেন, জন্মগত ত্রুটির কিছু সমস্যা চোখে দেখা যায় আর কিছু চোখে দেখা যায় না। এছাড়া কিছু ত্রুটি সাধারণ এবং কিছু সমস্যা গুরুতর। যেসব সমস্যা শরীরের ভেতরে থাকে তা সাধারণত চিকিৎসকের কাছে না গেলে বাইরে থেকে বোঝা যায় না। গ্রাম-গঞ্জের অনেক রোগী সচেতন না থাকা বা না বোঝার কারণে চিকিৎসকের কাছে যান অনেক পরে। এতে করে বহুসংখ্যক জন্মগত ত্রুটিযুক্ত শিশু চিকিৎসার বাইরে থেকে যাচ্ছে।
নিউবর্ন বার্থ ডিফেক্ট সার্ভিলেন্স ইন বাংলাদেশের (এনবিবিডি) সাবেক প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর ডা. শাহ নিজাম উদ্দীন শাওন জাগো নিউজকে বলেন, বেশির ভাগ জন্মগত ত্রুটির কারণ এখনো অজানা। তবু আমরা প্রাথমিকভাবে কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় আনতে পারি। এসবের মধ্যে রয়েছে পরিবেশ দূষণ, জীবনযাপনের ধরনে পরিবর্তন, বিভিন্ন সংক্রমণ, বংশগত, মায়ের পুষ্টিহীনতা, গর্ভকালীন শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতা। গর্ভকালে মায়ের স্নায়বিক চাপ শিশুর জন্য একটি বড় ঝুঁকি। তাই গর্ভাবস্থায় মায়ের যত্ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে এসময় ফলিক অ্যাসিড ও ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট জন্মগত ত্রুটির হার কমাতে সাহায্য করে।
দেশে ২০২০ সালের আগে জন্মগত ত্রুটির হার জানতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটি জরিপ শুরু করেছিল। ২০ হাসপাতালে কতগুলো জন্মগত ত্রুটির রোগী ভর্তি হচ্ছে তা জানার সুযোগ ছিল। কিন্তু ডব্লিউএইচও একসময় অর্থায়ন বন্ধ করে দিলে সে জরিপ আর চালানো সম্ভব হয়নি।
বাংলাদেশে এ সমস্যা বাড়ছে কি না জানতে চাইলে সঞ্জয় কুমার দে বলেন, আগের থেকে বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে তাই শনাক্ত বেশি হচ্ছে। এছাড়া কিছু বিপজ্জনক কারণ রয়েছে। যেমন বাল্যবিয়ে এবং দেরিতে বিয়ে দুইটাই বেড়েছে। অসংক্রামক রোগ, দূষণও বাড়ছে। এর ফলে জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্ম নেওয়া শিশুর সংখ্যাও বাড়ছে।
জন্মগত ত্রুটি যেসব কারণে হতে পারে
জন্মগত ত্রুটি হওয়ার কারণ হিসেবে নানারকম কুসংস্কার সমাজে প্রচলিত রয়েছে। অনেকে এ সমস্যার জন্য নারীকে দায়ী করেন। তবে এখন পর্যন্ত জন্মগত ত্রুটি হওয়ার পেছনে যেসব কারণ জানা যায় তার মধ্যে রয়েছে রক্তসম্পর্কীয় বিবাহ, বাল্যবিয়ে, দেরিতে সন্তান নেওয়া, অপুষ্টি, গর্ভকালীন ধূমপান ও মদ্যপান, সংক্রামক রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হরমোনজনিত সমস্যা, খিঁচুনি, অপচিকিৎসা, তেজস্ক্রিয়তা, ভেজাল খাদ্যদ্রব্য, চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত ওষুধ সেবন।
জন্মগত ত্রুটি রোধে করণীয়
জন্মগত ত্রুটি প্রতিরোধের উপায়গুলো হলো রক্তসম্পর্কীয় বিবাহ না করা, খুব কম বা বেশি বয়সে মা না হওয়া, গর্ভধারণের আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া, পরিকল্পিত উপায়ে জন্মদান, গর্ভকালীন নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিশ্চিত করা, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ধূমপান থেকে বিরত থাকা, মদ্যপান না করা, ‘অ্যানোমালি স্ক্যানিং’ করা, মাতৃত্বকালীন সেবার মান উন্নয়ন, অপুষ্টি দূরীকরণ।
এছাড়া গর্ভধারণের ক্ষেত্রে রিস্ক ফ্যাক্টরগুলোর কোনোটি আছে কি না তা জেনে ঝুঁকি নির্ণয় ও প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
ডব্লিএইচওর গাইডলাইন বলছে, একজন মা ৮টি প্রসব-পূর্ব চেক আপ করাবেন। তবে বাংলাদেশে কমপক্ষে ৪টি চেক আপ করানোর কথা বলা হয়েছে। প্রথম চেক আপ গর্ভধারণের ১২ থেকে ২২ সপ্তাহে মায়েদের ‘হাই রেজল্যুশন আল্ট্রাসনোগ্রামের’ মাধ্যমে গর্ভের শিশুর বেশির ভাগ ত্রুটি বোঝা যেতে পারে। তাই এ সময়ে গর্ভবতী মায়েদের ‘অ্যানোমালি স্ক্যানিং’ করানো উচিত। এছাড়াও সরকারিভাবে নানা উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এর মাঝে আছে মানুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি, যন্ত্রপাতি ও পরীক্ষা -নিরীক্ষার সহলভ্যতা, এই কেন্দ্রিক গবেষণা বৃদ্ধি।
Development by: webnewsdesign.com