পুড়ে গেলে প্রাথমিক চিকিৎসায় আমরা যেসব ভুল করি

শনিবার, ০২ মার্চ ২০২৪ | ১:৪৭ অপরাহ্ণ

পুড়ে গেলে প্রাথমিক চিকিৎসায় আমরা যেসব ভুল করি
apps

ডা. সিএম শামীম কবীর

ঘরে কিংবা বাইরে, যেকোনো সময় যে কোনো জায়গায় দুর্ঘটনাক্রমে আগুন কিংবা অন্য কোনো কারণে পুড়ে যেতে পারে যে কেউই। যদি কখনো এরকম পরিস্থিতিতে কেউ পড়েন তাহলে কী করবেন? অনেক ক্ষতি কমানোর জন্য তড়িঘড়ি করে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন, যার সবটাই সঠিক নয়। কখনো কখনো আগুনে পোড়া চিকিৎসা করতে গিয়ে না বুঝে আমরা ভালোর জায়গায় মন্দ করে ফেলি। আগুনে পোড়া চিকিৎসায় কিছু ভুল কাজ করা কখনোই উচিত নয়। কারণ, ভুল চিকিৎসার কারণে ক্ষতস্থানে ইনফেকশনসহ দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। ঘরে বসেই ছোটখাটো পোড়ার সঠিক চিকিৎসা করা সম্ভব। তবে শরীরের অনেক অংশ পুড়ে গেলে কিংবা গভীর ক্ষত সৃষ্টি হলে অতি দ্রুত ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। ছোটখাটো পোড়ার ভুল চিকিৎসার কারণে ক্ষতস্থানে ইনফেকশনসহ দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।

* পুড়ে গেলে যা হয়

শরীরের কোথাও পুড়ে গেলে তীব্র ব্যথা হতে পারে। এ ছাড়াও পোড়া স্থানে এসব অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে- ত্বক লাল হওয়া, চামড়া উঠে আসা, ফোসকা পড়া, ফুলে যাওয়া, ত্বক পুড়ে কালো অথবা একেবারে সাদাটে হয়ে যাওয়া ও জ্বালাপোড়া হওয়া। উল্লেখ্য, মারাত্মকভাবে পুড়ে গেলেও তেমন ব্যথা নাও হতে পারে। কারণ শরীরের কোথাও গভীরভাবে পুড়ে গেলে ব্যথা অনুভব করার জন্য প্রয়োজনীয় নার্ভ বা স্নায়ুও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই এমন ক্ষেত্রে অবহেলা না করে রোগীকে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত। উচ্চ তাপ ছাড়াও অন্যান্য কারণে শরীর পুড়ে যেতে পারে। যেমন- বৈদ্যুতিক শক, রেডিয়েশন, তীব্র ঘর্ষণ ও অ্যাসিড বা ক্ষয়কারক রাসায়নিকের সংস্পর্শ। সচরাচর আমরা পোড়া বলতে যা বুঝি সেটি এসব পোড়া থেকে ভিন্ন। এগুলোর চিকিৎসা পদ্ধতিও সাধারণ পোড়ার মতো নয়।

* প্রাথমিক চিকিৎসা

উচ্চতাপ দুই ধরনের উৎস থেকে সৃষ্টি হতে পারে-শুকনো ও ভেজা। শুকনো তাপের উৎসের মধ্যে রয়েছে আগুন, গরম তৈজসপত্র ও গরম ইস্ত্রি। অন্যদিকে গরম পানি ও জলীয়বাষ্প হলো ভেজা তাপের উৎস। তবে উভয় ধরনের পোড়ায় একই রকম চিকিৎসা দেওয়া হয়। যে কোনো ধরনের পোড়ার ক্ষেত্রেই যত দ্রুত সম্ভব প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করতে হবে। এর মাধ্যমে ত্বকের ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনা যায়। পোড়ার প্রাথমিক চিকিৎসায় নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করুন-

▶ তাপের উৎস থেকে দূরে সরিয়ে নিন : রোগীকে তাপের উৎস থেকে অতি দ্রুত কোথাও সরিয়ে নিতে হবে। আশপাশে কেউ থাকলে তাকে সাহায্যের জন্য ডাকতে হবে।

▶ গায়ে লাগা আগুন নেভান : মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে, ভারী কম্বল পেঁচিয়ে, পানি কিংবা অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রের সাহায্যে জ্বলন্ত আগুনের শিখা নিভিয়ে ফেলতে হবে। কাপড়ে আগুন ধরলে সেটি সঙ্গে সঙ্গে খুলে ফেলতে হবে।

▶ প্রচুর পানি ঢালুন : আক্রান্ত স্থান ঠান্ডা করার জন্য ট্যাপের পানির মতো প্রবাহমান পানির নিচে কমপক্ষে ২০ মিনিট ধরে রাখতে হবে। এটি সম্ভব না হলে বালতি ও মগের সাহায্যে কমপক্ষে ২০ মিনিট ধরে পানি ঢালতে হবে। সাধারণ তাপমাত্রার অথবা সামান্য ঠান্ডা পানি ব্যবহার করতে হবে। বরফ বা বরফ-ঠান্ডা পানি ব্যবহার করা যাবে না।

▶ কাপড় ও গয়না খুলে ফেলুন : পুড়ে যাওয়া স্থান থেকে কাপড় ও গয়না খুলে ফেলতে হবে। তবে কোনো কিছু চামড়ার সঙ্গে লেগে গেলে সেটি টানাটানি করে খোলার চেষ্টা করা যাবে না।

▶ ক্ষতস্থান ঢাকুন : ক্ষতস্থানটি পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত গজ দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। গজ না থাকলে পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত কাপড় অথবা পলিথিন ব্যবহার করা যেতে পারে।

▶ শরীর কাপড় দিয়ে মুড়ে দিন : রোগীকে একটি পরিষ্কার কম্বল অথবা চাদর দিয়ে মুড়িয়ে শরীরের অনুকূল তাপমাত্রা বজায় রাখতে হবে। ক্ষতস্থানে যেন কোনোভাবেই চাপ অথবা ঘষা না লাগে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

▶ ব্যথানাশক ওষুধ সেবন : ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল অথবা আইবুপ্রোফেন সেবন করা যাবে।

▶ রোগীকে বসিয়ে রাখুন : মুখ অথবা চোখ পুড়ে গেলে রোগীকে বসিয়ে রাখার চেষ্টা করতে হবে। এটি ফোলা কিছুটা কমাতে সাহায্য করবে। অন্যদিকে পা কিংবা শরীরের নিচের অংশ পুড়ে গেলে রোগীকে শুইয়ে দিয়ে পা উঁচু করে রাখতে হবে।

▶ অ্যাসিড অথবা রাসায়নিকের পোড়া : রাসায়নিকে ভেজা কাপড় সাবধানে সরিয়ে ফেলতে হবে। হাসপাতালে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ক্ষতস্থানটি প্রচুর পরিমাণে পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুতে হবে।

* যা করবেন না

▶ ঘরে বসে বড়সড় পোড়ার চিকিৎসা করার চেষ্টা করা যাবে না।

▶ টুথপেস্ট, তেল ও হলুদ ক্ষতস্থানে লাগানো যাবে না।

▶ ক্ষতস্থানে বরফ বা তীব্র শীতল পানি লাগানো যাবে না। এতে ক্ষতটি আরও গভীর হয়ে যেতে পারে।

▶ লম্বা সময় ধরে রোগীর শরীরে ঠান্ডা পানি ঢালা যাবে না। এতে রোগীর শরীর অতিরিক্ত ঠান্ডা হয়ে যেতে পারে।

▶ ক্ষতস্থানে সরাসরি তুলা, টিস্যু কিংবা ক্রিম লাগানো যাবে না।

▶ হাসপাতালে যাওয়ার আগে ফোসকা ফাটানো যাবে না।

▶ ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ক্ষতস্থানের ড্রেসিং করা কিংবা কোনো অ্যান্টিবায়োটিক অথবা অন্য কোনো মলম লাগানো ঠিক নয়।

▶ নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে অন্যকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া শুরু করবেন না। প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পরে রোগীকে হাসপাতালে নিতে হবে কি না সেটি পোড়ার ধরন ও আকারসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর নির্ভর করবে।

* কখন ডাক্তারের কাছে যেতে হবে

পোড়ার মাত্রা বেশি হলে রোগীকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। সম্ভব হলে পোড়ার চিকিৎসায় বিশেষায়িত কোনো হাসপাতাল অথবা নিকটস্থ বড় হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে নিয়ে যাওয়া উচিত। নিচের চারটি ক্ষেত্রে পোড়ার রোগীকে দেরি না করে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে-

▶ বড় অথবা গভীর ক্ষত হলে : আক্রান্ত ব্যক্তির হাতের তালুর চেয়ে বড় আকারের ক্ষত হলে।

▶ বিশেষ অঙ্গ পুড়ে গেলে : হাত, পা, চোখ, মুখ, পায়ের পাতা অথবা যৌনাঙ্গ পুড়ে ফোসকা পড়লে।

▶ চামড়া সাদা কিংবা কালো হয়ে গেলে : পোড়া স্থানের চামড়া পুড়ে সাদাটে হয়ে গেলে অথবা ঝলসে গিয়ে কালো হয়ে গেলে, যত কম বা বেশি-ই হোক।

▶ রাসায়নিক অথবা বিদ্যুতের সংস্পর্শ : রাসায়নিক অথবা বিদ্যুতের সংস্পর্শে শরীর পুড়ে গেলে।

নারী, বয়স্ক ব্যক্তি এবং পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুর ক্ষেত্রে পোড়া সংক্রান্ত জটিলতায় ভোগার ঝুঁকি বেশি থাকে। তাই তাদের যে কোনো ধরনের পোড়ার জন্য ডাক্তার দেখানো উচিত। শ্বাসনালিতে উত্তপ্ত ধোঁয়া প্রবেশ করলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। কখনো কখনো কাশি, গলাব্যথা ও শ্বাসকষ্টের মতো লক্ষণগুলো দেখা দিতে কিছুটা সময় লাগতে পারে। তাই এ বিষয়ে অবহেলা করা উচিত নয়।

* গুরুত্বপূর্ণ তথ্য

কখনো কখনো গুরুতরভাবে পুড়ে যাওয়া রোগীর শরীরে অক্সিজেন মারাত্মকভাবে কমে যেতে পারে। এর ফলে রোগীর জীবন বিপন্ন হতে পারে। একে ডাক্তারি ভাষায় ‘শক’ বলা হয়। এ অবস্থায় নিচের লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে-

▶ শরীর ঘাম দিয়ে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া।

▶ পালস বা নাড়ির গতি বেড়ে যাওয়া। উল্লেখ্য, সাধারণ হিসাবে পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তিদের পালস প্রতি মিনিটে গড়ে ৬০-১০০ হলে সেটিকে স্বাভাবিক ধরা হয়।

▶ শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হয়ে যাওয়া।

▶ চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া।

▶ হাই তুলতে থাকা।

▶ জ্ঞান হারিয়ে ফেলা।

এ ধরনের লক্ষণ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রোগীকে নিকটস্থ হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। জরুরি প্রয়োজনে ৯৯৯ নম্বরে ফোন করতে পারেন। হাসপাতালে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত নিচের তিনটি কাজ করুন-

▶ সম্ভব হলে রোগীকে চিৎ করে শুইয়ে দিয়ে দুই পা উঁচু করে রাখুন। প্রয়োজনে পায়ের নিচে পরিষ্কার বালিশ দিতে পারেন।

▶ রোগীর মুখ ও শরীরের পুড়ে যাওয়া অংশ বাদে শরীরের বাকি অংশ পরিষ্কার কম্বল কিংবা চাদর দিয়ে ঢেকে দিন।

▶ রোগীকে মুখে কোনো ধরনের খাবার অথবা পানীয় দেওয়া থেকে বিরত থাকুন। এগুলো শ্বাসনালিতে গিয়ে ইনফেকশন করতে পারে। এমনকি রোগীর জীবন হুমকির মুখে ফেলে দিতে পারে।

* হাসপাতালে চিকিৎসা

হাসপাতালে রোগীর শরীরের কতটুকু অংশ পুড়েছে সেটি বিশেষ নিয়মে হিসাব করা হবে। পাশাপাশি ক্ষতের গভীরতা যাচাই করা হবে এবং ক্ষত পরিষ্কার করে সঠিকভাবে ড্রেসিং করা হবে। গুরুতর পোড়ার ক্ষেত্রে অপারেশন করে রোগীর ত্বক প্রতিস্থাপনের, অর্থাৎ নতুন করে চামড়া লাগানোর প্রয়োজন হতে পারে। এ ছাড়া পোড়ার কারণে সৃষ্ট পানিশূন্যতা ও অন্যান্য জটিলতা রোধে স্যালাইনসহ বিভিন্ন ওষুধ দেওয়া হতে পারে।

লেখক : মেডিসিন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ, ল্যাবএইড ডায়াগনোস্টিক সেন্টার, উত্তরা, ঢাকা।

Development by: webnewsdesign.com