শীতের সময় নাক, কান ও গলার অসুখ বেশ বাড়ে। এই সময় ভোগান্তিতে পড়ে না এমন মানুষ কম। শীতে এমন কিছু অসুখের লক্ষণ, চিকিৎসা, প্রতিকার বিষয়ে জানিয়েছেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের নাক, কান ও গলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. এম এ মতিন
নাক, কান ও গলার রোগ সব সময়ই কমবেশি দেখা যায়, তবে শীতের সময় এর প্রভাবটা একটু বেশি পরিলক্ষিত হয়। সাধারণত ঠাণ্ডা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, নিউমোনিয়া, গলাব্যথা, স্বরভঙ্গ, শিশুদের কানের সমস্যা—এই সময়ের কমন কিছু রোগ। তবে বড় সমস্যা ভাইরাসজনিত রোগগুলো; বিশেষ করে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস, যা শীতে বেশি দেখা যায়।
ঠাণ্ডা বা কমন কোল্ড
শীতে কমন কোল্ড বা ঠাণ্ডা সব সময়ই লেগে থাকে। বিশেষ করে গলাব্যথা, খুসখুসে কাশি হরহামেশাই দেখা যায়। এ ছাড়া হালকা জ্বরের প্রাদুর্ভাবও দেখা দেয়। এগুলো হচ্ছে ঠাণ্ডা বা কমন কোল্ডের লক্ষণ।
সাধারণত এমনিতেই সর্দি-কাশি, ঠাণ্ডা লাগা, জ্বর ভালো হয়ে যায়। তার পরও যদি না সারে, তবে চিকিৎসকের পরামর্শে অ্যান্টি-অ্যালার্জি, অ্যান্টি-পাইরেটিক ও অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ খাওয়া যেতে পারে। তবে সবচেয়ে ভালো হয় ঠাণ্ডা যাতে না লাগে সেদিকে বেশি খেয়াল রাখতে পারলে। বিশেষ করে সকাল, সন্ধ্যা ও রাতের দিকে শীতের পোশাক বা গরমের জামা-কাপড় পরে থাকা উচিত। টয়লেট ও গোসলের সময় খেয়াল রাখতে হবে, যেন ঠাণ্ডা লেগে না যায়। বেশি ঠাণ্ডা পানি ব্যবহার করা যাবে না। শীতের বাতাসে প্রচুর ধুলা, কল-কারখানা ও যানবাহনের ধোঁয়া বাতাসকে দূষিত করে, যা থেকে সতর্ক থাকতে হবে; বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে। তা ছাড়া রাস্তাঘাটে মুখে মাস্ক ব্যবহার করা উচিত।
ইনফ্লুয়েঞ্জা
শীতের সময় ঠাণ্ডা থেকে ইনফ্লুয়েঞ্জা হতে পারে। এ ছাড়া নাক দিয়ে পানি আসা বা সর্দি আসা, নাক বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো লক্ষণগুলোও এ সময় দেখা দেয়। এসব সমস্যা ভাইরাস দ্বারাই মূলত বেশি হয়। এ জন্য প্রটেকটিভ ট্রিটমেন্টসহ শীতের সময় অ্যালার্জি এবং ঠাণ্ডা পরিহার করার চেষ্টা করতে হবে। শীতে বাচ্চাদের কাপড় পরিয়ে রাখতে হবে। রাতের বেলায় বাচ্চাদের গায়ের ওপর থেকে যেন কাপড় বা লেপ, কম্বল সরে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ছোট-বড় সবাইকেই শীতের সময় ঠাণ্ডা থেকে দূরে থাকতে হবে। যাঁদের গলাব্যথা তাঁরা এই সময় গলায় মাফলার জড়িয়ে রাখতে পারেন। ঠাণ্ডায় যাঁদের বেশি অ্যালার্জি তাঁরা হিটিং নিতে পারেন।
ইনফ্লুয়েঞ্জার চিকিৎসা হিসেবে প্যারাসিটামল, অ্যান্টিহিস্টামিন খাওয়া যেতে পারে। বেশি সমস্যা মনে করলে নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। তবে প্রতিরোধটাই আসল কথা।
এডিনয়েড
এডিনয়েডে ভোগা শিশুদের কিছু কমন লক্ষণ থাকে। যেমন—নাক দিয়ে নিঃশ্বাস নিতে না পারা, সব সময় মুখ খোলা রাখা, মুখ দিয়ে শ্বাস নেওয়া, ঘুমের সময় নাকডাকা, যাকে বলে মাউথ ব্রিদিং ইত্যাদি হয়। এ সময় মুখ দিয়ে লালা ঝরে, পাশাপাশি কানেও কম শোনে। স্কুলপড়ুয়া শিশুদের পারফরম্যান্স, আইকিউ অনেকটাই কমে যায়।
এ রকম সমস্যা মনে হলে একজন নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। মেডিক্যাল ট্রিটমেন্টে কাজ না হলে অপারেশনের মাধ্যমে চিকিৎসা করাতে হয়। কানের সমস্যা থাকলেও সেটা একই সময় অপারেশন করা সম্ভব। অনেক মা-বাবা অপারেশনের কথা শুনেই ভয় পেয়ে যান। কিন্তু জেনে রাখা উচিত, এখন বাংলাদেশেই এডিনয়েডের শতভাগ সফল অপারেশন হচ্ছে এবং শিশুরাও পুরোপুরি ভালো হয়ে যাচ্ছে।
কানে ব্যথা
কানে ব্যথাও এডিনয়েডের সঙ্গে অনেকটা সম্পর্কযুক্ত। যেসব শিশুর এডিনয়েড থাকে তাদের রিকারেন্ট ইনফেকশনও হতে পারে। শিশুদের নাকের পেছন থেকে কানের মিডলারে একটি কমিউনিকেশন লাইন আছে, যাকে আমরা বলি ‘ইস্টিরন টিউব’। শিশুদের ক্ষেত্রে এই টিউব যদি বেশি ডিসফাংশনাল হয় তখন কানের পর্দার পেছনে পানি জমে, কানে ইনফেকশন হয়। অডিওলজি করলে চিকিৎসকরা এটা বুঝতে পারেন।
কানে ব্যথার জন্য কিছু মেডিক্যাল ট্রিটমেন্ট বিশেষ করে সিরয়েড নেসাল ড্রপ বা স্প্রে, অ্যান্টিহিস্টামিন ইত্যাদি দেওয়া হয়। এতেই অনেকটা সুস্থ হয়ে যায়। তাতেও কাজ না হলে অপারেশনের কথা বলা হয়, যা প্রতি কানে দুই থেকে তিন মিনিটের খুবই সিম্পল অপারেশন। এতে কানের পর্দা ফুটো করে পানি বের করে ছোট্ট একটি ভেন্টিলেশন টিউব লাগিয়ে দেওয়া হয়। অনেক শিশুর অভিভাবক ভয় পান বলে অপারেশন করাতে চান না। এতে কিন্তু শিশুরই ক্ষতি হয়ে যায়।
টনসিলাইটিস
টনসিলাইটিসকে আমরা বলি রিকারেন্ট ইমপেনশন, যা শীতকালে বেশি দেখা দেয়। যাদের টনসিল আছে তাদের প্রতিবছর তিন থেকে চার বা পাঁচবার হয়। টনসিলাইটিসের সাধারণ উপসর্গ হলো : কোনো কিছু গিললে গলাব্যথা করা, খেতে না চাওয়া, জ্বর জ্বর ভাব বা প্রচণ্ড জ্বর ইত্যাদি। অনেক সময় শিশুরা স্কুলে যেতে চায় না, মেজাজ রুক্ষ হয়, খেলাধুলা করতে চায় না বা কর্মক্ষমতা প্রদর্শন করে না ইত্যাদি।
টনসিলাইটিস হলে একজন নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞকে দেখিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসা নেওয়া উচিত। আর টনসিলাইটিস প্রতিরোধের উপায় হলো ঠাণ্ডা পরিহার করা। এ ছাড়া অ্যাজমা যাতে না হয় সে জন্য সচেতন থাকতে হবে। হালকা গরম পানি পান করতে হবে। গলায় মাফলার জড়িয়ে রাখতে পারলে ভালো।
পলিপ বা মাংস বেড়ে যাওয়া
শীতের সময় নাকের পলিপ বা মাংস বেড়ে যাওয়াও খুব সাধারণ একটি সমস্যা। অ্যালার্জির সঙ্গে বেশ সম্পর্ক আছে এর। তবে পলিপ কেন হয় এর কারণ অজানা। বিশেষ করে যাদের অ্যালার্জির সমস্যা আছে তাদের পলিপ হতে পারে বেশি। কিন্তু নাকে মাংস বাড়া আর পলিপ এক জিনিস নয়।
মাথাব্যথা বা সাইনোসাইটিস
এটাও শীতের সময় বেশি হয়। ঠাণ্ডায় সাইনোসগুলো ব্লক হয়ে যায়। এটা থেকে বাঁচতে ঠাণ্ডা এবং অ্যালার্জি থেকে দূরে থাকতে হবে। এ ছাড়া ন্যাসাল ড্রপ এবং অ্যান্টিহিস্টামিন দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা। যদি ঘন ঘন সাইনোসাইটিস হয়, তাহলে এন্ডোসকপিক চিকিৎসা নেওয়া যায়, যাকে বলে ‘সাইনাস সার্জারি’।
ফ্যারেনজাইটিস
একটু শীতেই অনেকের গলাব্যথা, জ্বর বা খুসখুসে কাশি হয়ে থাকে। এসব ফ্যারেনজাইটিসের লক্ষণ। অনেক সময় দেখা যায়, শীতের সময় অনেকেই ঘুম থেকে উঠে আর কথা বলতে পারেন না। গলাব্যথাও থাকে। ভাইরাসজনিত কারণে এই সমস্যা হয়।
ফ্যারেনজাইটিস থেকে বাঁচার প্রথম পদক্ষেপ হলো ঠাণ্ডা পরিহার করা। এ ছাড়া আক্রান্ত হলে মেন্থল দিয়ে গরম ভাপ নেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া নাকের ড্রপস, অ্যান্টিহিস্টামিন ব্যবহার করলে উপকার মেলে। কথা বলা খানিকটা সময়ের জন্য পরিহার করলেও অসুখের প্রকোপ কমে।
Development by: webnewsdesign.com