পারিবারিক চড়ুইভাতির একটি দৃশ্য কল্পনা করুন। সাধারণত দেখা যায়, বড় সন্তানটি রান্নাবান্নার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে আর ওদিকে ছোটটা খাওয়ার জন্য প্লেট চামচ নিয়ে প্রস্তুত থাকে। আর মাঝেরটি এ নিয়ে কোনো আগ্রহই দেখায় না! জন্মক্রম শিশুর ব্যক্তিত্ব গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে- এটি তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে।
জন্মক্রমের তত্ত্ব নিয়ে অনেকেই কাজ করেছেন। অস্ট্রিয়ার শারীরবিদ ও মনোচিকিৎসক আলফ্রেড অ্যাডলার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে জন্মক্রমের সম্পর্ক নিয়ে সবচেয়ে প্রভাবশালী তত্ত্ব দিয়েছেন। এ তত্ত্ব মতে, জন্মক্রমের কারণে পরিবারে সন্তানের যে আলাদা অবস্থান তৈরি হয় সেটি তার ব্যক্তিত্ব গঠনেও ভূমিকা রাখে। ব্যক্তির আইকিউ এমনকি জীবনে সফলতা ও ব্যর্থতার শর্তও তৈরি হয় এখানেই।
অ্যাডলার বুঝতে চেয়েছিলেন একই পরিবারে বেড়ে ওঠা শিশুদের মধ্যে ব্যক্তিত্বে পার্থক্য কেন হয়। অ্যাডলার নিজেও মেঝো সন্তান ছিলেন। তিনি বাবা-মার সাত সন্তানের মধ্যে ছিলেন দ্বিতীয়। ১৯২৭ সালে তত্ত্ব দেন যে, জন্মক্রম শিশুর ব্যক্তিত্ব গঠনে দারুণভাবে ভূমিকা রাখে। এর কারণ ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, বড় ও ছোট সন্তানদের বাবা-মা আলাদাভাবে দেখেন। তাদের যত্ন আত্তিতেও কমবেশি। তাছাড়া বাবা-মা ও অভিভাবকরা প্রায়ই এমন বাচ্চাদের পরস্পরের সঙ্গে তুলনা করেন। এতে করে হীনম্মন্যতা বোধ তৈরি হতে পারে।
এই তত্ত্বের সম্প্রসারণে বলা হয়, প্রথম সন্তান বাবা-মায়ের আদর, পরিবারের সবার স্নেহ সবকিছুই একা ভোগ করে। সে বাবা-মায়ের অনেক বেশি মনোযোগ পায়। একারণে পরবর্তী ভাই-বোন আসার সঙ্গে সঙ্গে তার এই সাম্রাজ্যে ব্যাঘাত ঘটে। ছোট ভাই বোন আসায় সে মনে করে তার আদর কমে গেছে। নিজেকে উপেক্ষিত মনে হয়। এমন মানসিকতা থেকে অনেক অপ্রীতিকর ঘটনারও জন্ম দেয়।
আবার প্রথম সন্তান কর্তব্যপরায়ণ, নির্ভরযোগ্য এবং সতর্ক হয়। সবাইকে খুশি রাখবে, সচেতন হবে এমনটিই মনে করা হয়। তবে এ সন্তানদের অবশ্য জাঁহাবাজ ও সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রবণতা থাকে।
বিখ্যাতদের মধ্যে জোসেফ স্টালিন, বেনিতো মুসোলিনি, উইনস্টন চার্চিল ও জে কে রাওলিং বাবা-মায়ের বড় সন্তান। অন্যদিকে মাঝের শিশুরা আবেগপ্রবণ হয়ে থাকে। তাদের দিকে সবার নজর একটু কম পড়ে। বড়কে অনুসরণ করাই তার প্রধান কাজ হয়ে পড়ে। এ কারণে এরা হয় সাধারণত পরিবারে শান্তি প্রতিষ্ঠাকারী দূত! বড় সন্তানটি পরিবারে যে স্থান এরই মধ্যে দখল করে ফেলেছে সে পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টায় থাকে সে।
বিখ্যাতদের মধ্যে মাইক্রোসফটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস, পপ সম্রাজ্ঞী ম্যাডোনা ভাই-বোনের মধ্যে মেঝো। অ্যাডলার নিজেও সাত ভাই বোনের মধ্যে দ্বিতীয় ছিলেন।
আর কনিষ্ঠতম শিশুরা উচ্চাভিলাসী, আত্মকেন্দ্রিক, ধান্দাবাজ, আমোদে প্রকৃতির হয়ে থাকে। কারণ মনোযোগ আকর্ষণের জন্য অনেক খাটতে হয় তাকে। এছাড়া নিজের স্বাধীনতা ও পরিবার ও সমাজে আলাদা অবস্থান তৈরি করার জন্যও তাদের কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। বিখ্যাতদের মধ্যে মহাত্মা গান্ধী, কার্ল মার্কস ও হলিউড অভিনেত্রী ক্যামেরন ডিয়াজ ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট।
আর যাদের কোনো ভাইবোন নেই, অর্থাৎ বাবা-মার একমাত্র সন্তান তারা হয় আত্মকেন্দ্রিক, স্বাধীনচেতা এবং পরিপক্ব। এদের মধ্যে আছেন লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ও হ্যারি পটার খ্যাত অভিনেতা ডেনিয়েল র্যাডক্লিভ।
মার্কিন মনোবিজ্ঞানী ফ্রাঙ্ক জে সালোওয়ে ১৯৯০ এর দশকের মাঝামাঝিতে জন্মক্রমের তত্ত্বে চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদের সংমিশ্রণ ঘটান। শিশুর ব্যক্তিত্ব গঠনে পরিবারে টিকে থাকার লড়াই প্রধান ভূমিকা রাখেন বলে তত্ত্ব দেন তিনি। তার ব্যাখ্যায় প্রতিটি শিশু পরিবারের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট অবস্থান তৈরি করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। টিকে থাকার জন্য বাবা-মায়ের মনোযোগ আকর্ষণ এবং পরিবার ও সমাজে অবস্থান তৈরি করতে তাদের যথেষ্ট বিনিয়োগ করতে হয়। অবস্থান তৈরি করতে তারা নিজস্ব কলা কৌশল ব্যবহার করে। যেমন: বড় বা একমাত্র সন্তানদের সমাজে তাদের অস্তিত্ব নিয়ে তেমন মাথা ঘামাতে হয় না। কেননা তার পরিচয়েই পিতামাতা পরিচিত হতে থাকে। নিজের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করার উদ্দেশ্যে বড়রা ছোটদের দেখাশোনা করে, যত্ন নেয়। এর পরেরটাকে এ কাজটি অন্যভাবে করতে হয়। সে হয় অভিযানপ্রিয়। প্রতিযোগিতাটা সহজ করতে সবাই মিলে একটি সহযোগিতার পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করে। ফলে সবারই টিকে যাওয়ার সম্ভাবনা তখন বাড়ে।
১৯৬৮ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রথম সন্তানেরা আঘাত পাওয়ার ভয়ে বিপজ্জনক খেলায় অংশ নেয় কম। ১৯৮০ সালে ১৭০ জন নারী এবং ১৪২ জন পুরুষ স্নাতককে নিয়ে একটি গবেষণায় উঠে আসে, প্রথম সন্তানদের মধ্যে কম উদ্বেগ এবং উচ্চ অহঙ্কার দেখা যায়।
তবে এ নিয়ে বিভিন্ন গবেষণায় পরস্পর বিরোধী তথ্যও উঠে এসেছে। অ্যাডলারের তত্ত্বটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। জার্মানির সারল্যান্ড ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানী ফ্র্যাঙ্ক স্পিনাথ বলেন, ভাইবোন ক্রমের অবস্থানটি ব্যক্তিত্বকে আকৃতি দেয় । তবে প্রতিটি পরিবারে তা সমান নয়। অনেক পরিবারেই ভাইবোনের মধ্যে প্রায় সব দিক দিয়েই মিল পাওয়া যায়।
Development by: webnewsdesign.com